দর প্রস্তাবের চেয়েও ৪ মিলিয়ন ডলার বেশি পরিশোধ!

, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2024-10-27 21:15:39

সাধারণত প্রাথমিক প্রস্তাবের পর আলোচনার মাধ্যমে দর কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ভোলায় ৩টি কূপ খনন প্রকল্পে গ্যাজপ্রমকে উল্টো ৪ মিলিয়ন ডলার অর্থ বাড়িয়ে দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্যাজপ্রমের মূল প্রস্তাবে টবগী, ইলিশা ও ভোলা নর্থ-২ খনন প্রকল্পে ৬০.৮১ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাব জমা দেয়। টেকনিক্যাল কমিটি ওই দরকে বেশি উল্লেখ করে কমিয়ে আনার সুপারিশ দিয়েছিল। দাম না কমিয়ে গোপনে কয়েক মিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বাপেক্স সুত্র জানিয়েছে। একটি সুত্র দাবি করেছে, ৪ মিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে ৬৫ করার কথা, আরেকটি সুত্র ২ মিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে ৬৩ মিলিয়ন ডলার করার কথা দাবি করেছে।

দরের বিষয়ে বাপেক্স কখনই মুখ খোলেনি, যখনই দামের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে কৌশলে এড়িয়ে গেছে। এমনকি এখনও ওই দর গোপনে করতে মরিয়া বাপেক্সের লোকজন। বাপেক্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শোয়েব এর কাছে দর জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, বিষয়টি আমার যোগদান করার আগের, সঠিক অংক জানা নেই।

একটি ইংরেজি দৈনিকে ৭৭ মিলিয়ন ডলার লেখার হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাপেক্স এমডি বলেন, আমি নিশ্চিত ৭৭ মিলিয়ন ডলার অংকটি সঠিক নয়। তবে ঠিক কতো না জেনে বলতে পারছি না।

দরের পাশাপাশি ভোলায় রিগ থাকা অবস্থায় টবগী, ইলিশা ও ভোলা নর্থ-২ খনন প্রকল্পে গ্যাজপ্রম রিগ মোবিলাইজেশনের বরাদ্দ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল খোদ টেকনিক্যাল কমিটি। সেই কমিটির আপত্তি উপেক্ষা করে গ্যাজপ্রমকে ৪০ লাখ ডলার বিল দেওয়া হয়।

বিশেষ আইনে বিনা দরপত্রে দেওয়া ওই কাজে টেকনিক্যাল কমিটির মতামতকে পাত্তাই দেওয়া হয়নি তখন। গ্যাজপ্রম কূপ খননের প্রস্তাব দিলে ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর পেট্রোবাংলা, বাপেক্স ও বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করা হয়েছিল।

পেট্রোবাংলার তৎকালীন পরিচালককে (অপরেশন এন্ড মাইন্স) আহ্বায়ক করে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মন্ত্রণালয় ও বিজিএফসিএল এর প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি হয়েছিল। কমিটির তার রিপোর্টে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করে, মোবিলাইজেশন খাতে টবগী-১ অনুসন্ধান কূপের জন্য ড্রিলিং রিগ, টেকনোলজিস ইকুইপমেন্ট এন্ড টুলস, টেনলোজিক্যাল মেটরিয়াল এন্ড পারসনালের বিপরীতে ৪০ লাখ ৬২ হাজার ৫৭৬ ডলার বরাদ্দের পরিমাণ উল্লেখ করেছে। বাস্তবে ড্রিলিং রিগ ও যন্ত্রপাতি ভোলা এলাকায় সংরক্ষণ করায় মোবিলাইজেশনের পরিবর্তে শিফটিং উল্লেখ করাই গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচ্য। রিগটি আগে থেকেই ছিল।

ওই রিপোর্টের পরও গ্যাজপ্রমকে তাদের চাওয়া অনুযায়ী মোবিলাইজেশনের জন্য ৪০ লাখ ৬২ হাজার ৫৭৬ ডলার প্রদান করা হয়।

কমিটি রিগ মোবিলাইজেশনের পাশাপাশি কূপ খননের বরাদ্দ নিয়েও আপত্তি তুলেছিলেন। রিপোর্টে গ্যাজপ্রমের মাধ্যমে করানো আগের কূপ খননের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর‌্যন্ত বাপেক্সের ৮টি কূপ (শ্রীকাইল-৩, বেগমগঞ্জ-৩, সেমুতাং-৬, শাহবাজপুর-৩, শাহবাজপুর-৪, শ্রীকাইল-৪ শাহবাজপুর ইস্ট-১, ভোলা নর্থ-১) খননের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ৩টি কূপ ভার্টিক্যাল ও ৫টি কূপ ডিরেকশনাল ড্রিলিং করা হয়। মোবিলাইজেশনসহ ভার্টিক্যাল ৩টি কূপের দর ছিল যথাক্রমে ১৭.৬৯ মিলিয়ন, ১৬.৭২ মিলিয়ন ও ১৬.৪৮ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে টবগী ২০.২৮ মিলিয়ন ডলার, ইলিশা-১ জন্য ২০.২৮ মিলিয়ন ডলার এবং ভোলা নর্থ-২ কূপ খননের জন্য ২০.২৫ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ ৩টিতে কূপ আগের কূপ খননের দরের চেয়ে গড়ে ৩.২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার করে বেশি দর প্রস্তাব করা হয়েছে।

কমিটি তার সুপারিশে দর নিয়ে আলোচনা করার কথা বলে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। গ্যাজপ্রম মোবিলাইজেশনসহ ৬৩ মিলিয়ন মতান্তরে ৬৫ মিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ করে রেকর্ড করেছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। অর্থাৎ গ্যাজপ্রম চাইতে ভুল করলেও বাপেক্স দিতে কার্পণ্য করেনি। রিপোর্টে দেখা গেছে কয়েক মাস আগে খনন করা ভোলা নর্থ-১ কূপের চেয়েও ৩.২৯ মিলিয়ন বেশি ডলার দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে।

সাধারণত কোন প্রকল্পের কাজের ধরণ ও মালামাল ক্রয়ের খরচ বিবেচনায় ডিপিপি চুড়ান্ত করা হয়। কিন্তু গ্যাজপ্রমের ক্ষেত্রে হয়েছে কতটাকা দিতে হবে সে মোতাবেক ফরমায়েশি ডিপিপি। গ্যাজপ্রমকে বিনা দরপত্রে দেওয়া কূপ খননের কাজের ক্ষেত্রে দর নির্ধারণ হতো মন্ত্রণালয়ে বসে। পরে সে অনুযায়ী প্রত্যেকটি কূপেই ১০০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা বেশি দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আর সেই খরচের অংক মেলাতে আজগুবি সব খাত দেখানো হয়।

দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনে গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সম্পাদিত সবগুলো চুক্তি যাচাই-বাছাই করার দাবি উঠেছে। চড়াদরে দেওয়া দরপত্রে দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। লুটপাটে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করতে বিশেষ আইনে সম্পাদিত চুক্তি পর‌্যালোচনা কমিটির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় যে কাজ করতে পারে, সেই কাজ ২০০ কোটি টাকায় দেওয়া হয়েছে। গাজপ্রমকে যখন কূপ প্রতি ২০০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়, ওই সময়ে বাপেক্স রূপগঞ্জ (২০১৫ সাল) কূপ খনন করেছে ৬১ কোটি টাকা খরচে। ওই প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রাক্কলিত দর ছিল ৯৭ কোটি টাকা, সেই কাজ বাপেক্স ৬১কোটি টাকায় শেষ করে বাকি টাকা ফেরত দিয়েছে। শ্রকাইল ইস্ট-১ ও সালদা নর্থ-১ (২০১৬ সাল) কূপ দূটি খননে ব্যায় হয়েছে ১৪৪ কোটি টাকা। এতে করে কূপ প্রতি খরচ পড়েছে ৭২ কোটি টাকা।

গ্যাজপ্রমের কমিশনভোগীরা বিভিন্ন রকম যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, বাপেক্স যেহেতু নিজের রিগ ব্যবহার করেছে সে কারণে রিগ ভাড়া দিতে হয় নি, তাই খরচ কম। রিগ ভাড়া যোগ করলে ধারের কাছে নেই গ্যাজপ্রমকে দেওয়া দর। একটি কূপ খনন করতে আদর্শ সময় বিবেচনা করা হয় ৪৫দিন (যদিও ৩০ দিনে শেষ হয়ে থাকে) সে হিসাবে রিগ (দৈনিক ভাড়া ২০ হাজার ডলার/১২০ টাকা) ভাড়া দাঁড়ায় ১০ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ সবমিলিয়ে দাঁড়ায় ৮২ কোটি টাকা ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনও সব নজীর রয়েছে যা একইসঙ্গে ভয়ানক বলা যায়। তবুও সেই ভয়াবহ কাজ করে গেছেন তৌফিক ই-ইলাহী চৌধুরী সিন্ডিকেট। ২০১৪ সালে বাপেক্সের ৩৫৪তম বোর্ড সভায় শ্রীকাইল-৪ কূপ খননের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ৫৫৬তম বোর্ডসভায় ৬৪টি কোটি টাকার ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) অনুমোদন করা হয়। অনুমোদিত ডিপিপি পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করে। নিয়ম হচ্ছে পেট্রোবাংলা অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ শুরু হবে।

কিন্তু পেট্রোবাংলায় ৬৪ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন না দিয়ে ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি প্রেরণ করার ফরমায়েশ দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে একই কাজের (একই গভীরতা) জন্য ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি করা হয়। আর সেই কাজটি দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে।

এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ন্যাশনাল গ্রুপের চেয়ার‌ম্যান রাশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী আব্দুস সাত্তার মিয়া (মিয়া সাত্তার)। রহস্য মানব মিয়া সাত্তার এক সময় রাশিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আওয়ামী লীগের উপরে মহলে দহরম মহরম থাকায় যা খুশি তাই করেছেন। অনেক বিতর্ক হলেও তার অপকর্ম থেমে থাকেনি।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভোলার কূপ খননের বিষয়টি বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ১০ টাকার কাজ একশ টাকায় দেওয়া হচ্ছে এমন অরাজকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোথাও খুজে পাওয়া যাবে না। গ্যাজপ্রমকে কাজ দিতে যে সব অন্যায় করা হয়েছে সেগুলো ফৌজদারি অপরাধ, এগুলোর জন্য ফৌজদারি আইনে বিচার হওয়া উচিত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর