ব্যবসা-বাণিজ্য উৎপাদন বিনিয়োগে স্থবিরতায় উদ্বেগ অর্থনীতিবিদদের

, অর্থনীতি

ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-10-20 11:01:43

দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান, পণ্য সরবরাহ ও মূল্যে। খাদ্য ও নিত্যপণ্যের মজুত পর্যাপ্ত কি না, তা নিয়ে সংশয় বিরাজ করছে। বেসরকারি পর্যায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের দাপট রয়েই গেছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় আমদানিকারকদের অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন। খেলাপি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে আইনগত পদক্ষেপের মুখোমুখি অনেকেই। এর আওতায় তাদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন আমদানি ঋণপত্র খুলতে পারছে না। অনেক ব্যাংকও তাদের আস্থায় নিতে পারছে না। এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে আগামী মাসগুলোতে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের বাজারে সম্ভাব্য সংকটের আশঙ্কা করেছেন দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এদিকে সবচেয়ে বড় খাত পোশাকশিল্প মালিকরা অভিযোগ করে বলেছেন, চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকেই কারখানা ঠিকমতো খোলা রাখতে পারছেন না। তা ছাড়া ঢালাওভাবে মামলার আসামি হওয়ার কারণে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট গ্রুপসহ সারা দেশে অসংখ্য ব্যবসায়ী আত্মগোপনে রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী উপস্থিত না থাকায় কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তও স্থগিত হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ শ্রমজীবী-কর্মজীবীর পরিবার আর্থিক অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির একটি চিত্র পাওয়া যায় ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে। গত বছরের জুলাইয়ে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৫০৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের। এ বছর জুলাইয়ে তা প্রায় ৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৪৯৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট দুই মাসে আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার কমেছে নিত্যপণ্য ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ, মধ্যবর্তী পণ্য ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, পেট্রোলিয়াম ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামাল ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং অন্যান্য ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ।

এ ছাড়া মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার কমেছে ৩৩ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং নতুন ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণকে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান সূচক হিসেবে ধরা হয়। এদিকে বিদেশি বিনিয়োগের সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষণে সময় নিতে পারেন বলে অর্থনীতিবিদরা মন্তব্য করেছেন।

এদিকে জুলাই মাসে জাতীয় সঞ্চয় কমেছে ৭৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বা পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় হলো সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, এনআরবি বন্ড এবং অন্য সব সরকারি সঞ্চয়ের প্রকল্পগুলোয় গ্রাহকের সমন্বিত বিনিয়োগ। জাতীয় সঞ্চয় কমার পাশাপাশি অর্থনীতি খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ব্যবসায়ীরা নিজেরাই দায়ী। আগের সরকারের সময় ব্যবসায়ীরা একেকজন ‘অলিগার্ক’ হয়ে লুটপাট করেছেন। এ জন্য সারা দেশে আয়বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি চরমে উঠেছে। অলিগার্করা বৃহৎ সব ব্যবসার মালিক হয়ে রাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রভাব বিস্তার করে খাতভিত্তিক ব্যবসা নিজেদের কবজায় নিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রও একাধিকবার ‘অলিগার্কদের’ দাপটে অর্থনৈতিক ক্রান্তিকাল কাটিয়েছে। রাশিয়াতেও একই অবস্থা হয়েছিল একাধিকবার। বাংলাদেশে গত ১৫ বছর একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থেকে এই ‘অলিগার্কদের’ সৃষ্টি করেছে। এর বিরুদ্ধে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সম্মিলিত গণ-অভ্যুত্থান হলে ওই সরকারের পতন হয়। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে।

সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক লুট ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ব্যবসায়ীদের অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে দেশ থেকে পালাতে চেষ্টা করেন। তাদের কেউ কেউ সফল হলেও অনেকেই আটক হয়েছেন। আবার অনেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন। শুধু ঢাকা মহানগরে প্রায় ৩০০ মামলায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েক শ ব্যবসায়ীর। সারা দেশে মামলায় জড়িয়েছেন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান পুলিশ সদর দপ্তরও প্রকাশ করেনি। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হাজার হাজার ব্যবসায়ী এ তালিকায় রয়েছেন। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে গেছে বা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ জন্য দায়ী ব্যবসায়ীরাই। শুধু ব্যবসা করলে এতটা ক্ষতি ব্যবসায়ীদের হয়তো হতো না। সেই অর্থে অর্থনীতির এত ক্ষতিও হতো না। তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দের সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এগুলো তো এমনি এমনি হয়নি। একজন ঘুম থেকে উঠেই তো বলছে না যে, আজকে অমুক অমুক এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হলো। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের অতীতটা দেখতে হবে। একেকজন অলিগার্ক হয়ে লুটপাট করেছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এখন অভিমান করে বসে আছেন। সেদিন এক অনুষ্ঠানে একজন (নাম অপ্রকাশিত) বললেন, আপনারা বলেন তো আমরা সবকিছু বন্ধ করে দিই, সবকিছু বিক্রি করে চলে যাই। আসলে এটা তাদের অভিমান।’

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সরকার চাচ্ছে যেন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত না হয়। একই সঙ্গে এটাও দেখতে হচ্ছে, কেউ যেন অর্থ সরিয়ে নিতে না পারে। একটা সুবিধা দেওয়া হলে তার যে সদ্ব্যবহার হবে, তা কিন্তু সরল করে ভাবলে হবে না। যেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা পর্যবেক্ষণাধীন রয়েছে, তারা তো আর বসে নেই বা থাকছেন না। তারাও নানা উপায়ে অর্থ বের করে নিতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সরকার এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার পথ খুঁজছে। আপনি যদি ধরে নেন যে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে অলিগার্কদের কারসাজিও বন্ধ হয়ে গেছে, তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’

ড. জাহিদ বলেন, ‘এখন বিষয়টা হলো, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে সচল করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কী কী করা দরকার। এই মুহূর্তে বড় ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলা প্রথম কাজ। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর আসলে ঘর গোছানো, আগুন নেভানো; এগুলোতেই সময় চলে যাচ্ছে। এমন একটা সপ্তাহ নেই যে আইনশৃঙ্খলা অবনতির কোনো ঘটনা নেই। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন কার্যক্রম ঠিকমতো চলতে পারেনি, তেমনি উৎপাদকদের কাছে অর্থও ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারেনি। এ কারণে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটেছে এবং তার প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যে। জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে। আবার বহু পেশাজীবী, বিশেষ করে সেবা ও উৎপাদনে নিয়োজিত লোকদের নিয়মিত আয়ের পথ রুদ্ধ হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘জনজীবনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে না আসা পর্যন্ত অর্থনীতি সচল হবে না।’ উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক বলেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে হবে। এই যে প্রথমবারের মতো একটা রেঞ্জ দেওয়া হলো, অর্থাৎ প্রায় ২-এর একটা গ্যাপ রেখে দিল, এটি শঙ্কাজনক। এর অর্থ হলো একটা অনিশ্চয়তা আছেই। বিদ্যমান অনিশ্চয়তা না কাটাতে পারলে প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশে নেমে যাবে। এটি কাটিয়ে উঠতে পারলে প্রবৃদ্ধি মাঝামাঝি পর্যায়ে বা ৪ শতাংশ কিংবা তারও বেশি ৫ শতাংশ হতে পারে। আর তা কাটিয়ে উঠলে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হবে। এটি হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। কিন্তু কথা হলো, সরকার তো এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। জনপ্রশাসন, পুলিশ এবং সেবা যারা দেবে সেখানে শূন্যতা রয়েছে। এটি তো রাতারাতি হবে না, সময় লাগবে। তবে কোন কাজগুলো আগে করা প্রয়োজন তার একটা তালিকা করতে হবে সরকারকে। খাত অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।’

গত সপ্তাহে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বিজনেস রেডি ২০২৪ (বি-রেডি ২০২৪) প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা তো শুধু অর্থ চান। সুযোগ পেলেই বলেন আমাকে প্রণোদনা দাও। আবার ওদিকে করও দিতে চান না। কর আবার কমাতে বলেন। বিষয়টা এমন যে আমাকে দাও আর দাও। আমি কেন দেব!’

আগে ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট যেটা করা হতো সেটাই এখন বিজনেসরেডি রিপোর্ট। এখানে বংলাদেশকে পাকিস্তান ও নেপালের চাইতে কম স্কোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দেশ দুটি বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। এখানে কর পরিশোধ ও সরকারি সেবা পেতে হয়রানি এবং সময়ের অপচয়ের কথা বলা হয়েছে। ঠিক এই জায়গাটায় সংস্কার করতে পারলে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হবে। সরকারকে তো করদাতা, নাগরিক ও সেবা গ্রহণকারীর ইচ্ছা মাথায় রেখেই নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, সরকারও যাতে আয় না হারায়।’

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন অনিশ্চিত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ দরকার হয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এ পরিবেশ সৃষ্টির প্রধান অনুষঙ্গ।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. এম মাসরুর রিয়াজ গত সপ্তাহে মেট্রোপলিটন চেম্বারের একটি প্রকাশনায় বলেছেন, ‘অর্থনীতি জুলাইপূর্ব অবস্থায় ফিরতে সময় লাগব।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে একটা অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। এ জন্য অনেক কারণ দায়ী। অভ্যন্তরীণ তো আছেই, বৈশ্বিক কারণও আছে। কয়েক বছর ধরেই বিশ্বে একটা যুদ্ধাবস্থা চলছে। এর কারণে জ্বালানির দাম বাড়ায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। অনেকে বিনিয়োগ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলেও শেষ পর্যন্ত মাঠে নামেননি। বিগত সরকার চেষ্টা করেও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। বরং পদে পদে সরকারসংশ্লিষ্টরা বিনিয়োগকারীদের হয়রানি করেছেন। এখন একটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অর্থনীতি খুবই বিপর্যস্ত হয়েছে। এখন নতুন সরকারের জন্য এই বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বা ট্র্যাকে ফেরানো সহজ কাজ নয়। তবে আশার কথা হলো যে সরকার চেষ্টা করছে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে বেগবান করতে।’

খবরের কাগজ’র সৌজন্যে 

এ সম্পর্কিত আরও খবর