রাকাবকে ভাতের হোটেল বানিয়েছেন কর্মকর্তারা, লাঞ্চ ভাতা সোয়া ৪ কোটি!

, অর্থনীতি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2024-10-17 19:21:45

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি উপেক্ষা করে লাঞ্চ ভাতার নামে প্রায় সোয়া ৪ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেতন-ভাতার নিয়ম লঙ্ঘন করে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেখানো হয় বাংলাদেশের কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেলের এক প্রতিবেদনে। অডিট আপত্তি সত্ত্বেও এই ভাতা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে ব্যাংকটি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাকাব এখন ভাতের হোটেলে পরিণত হয়েছে। যেন বাংলাদেশের সব থেকে দামি ভাতের হোটেল। নয়তো তারা সোয়া চার কোটি টাকার লাঞ্চ খেতেন না।

অডিট প্রতিবেদনে জানা গেছে, রাকাবের ২য় থেকে ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তারা দৈনিক উপস্থিতির জন্য ২০০ টাকা হারে লাঞ্চ ভাতা গ্রহণ করে। তবে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা আদেশ অনুযায়ী, শুধুমাত্র ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা মাসিক ২০০ টাকা হারে টিফিন ভাতা পাবেন। যে সকল কর্মচারী লাঞ্চ ভাতা অথবা বিনামূল্যে দুপুরের খাবার পান, তাদের টিফিন ভাতা দেওয়ার নিয়ম নেই।

তবে রাকাবের প্রধান কার্যালয় এবং এর আওতাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁসহ অন্যান্য শাখাগুলো ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থ বছরে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কর্মকর্তাদের লাঞ্চ ভাতা প্রদান করে। এতে চাকরি (ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান) (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ লঙ্ঘিত হয় এবং ৪ কোটি ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।

অডিট কমিটি জানিয়েছে, অভিযোগের জবাব যথেষ্ট নয় এবং এর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের বেতন ও ভাতার বিধানে ১১ থেকে ২০ নং গ্রেডের কর্মচারীদের লাঞ্চ ভাতার কথা বলা থাকলেও সকল কর্মকর্তাদের ভাতা প্রদান করা হয়েছে, যা নিয়মের বাইরে।

২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি অডিট কমিটি রাকাবের প্রধান বরাবর অনিয়মের বিষয়ে সওজ জারি করে এবং ৯ ফেব্রুয়ারি তাগিদপত্র দেওয়া হয়। পরে ১ মার্চ রাকাবের প্রধান নির্বাহী বরাবর আধা সরকারি পত্র পাঠানো হয়, কিন্তু কোনো নিষ্পত্তিমূলক জবাব পাওয়া যায়নি। অডিট আপত্তির পরও রাকাবের কর্মকর্তারা লাঞ্চ ভাতা গ্রহণ করতে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাকাব কর্মকর্তা জানান, অডিট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সব গ্রেডের কর্মকর্তাই নিয়মিত লাঞ্চ ভাতা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, "সব ব্যাংকেই লাঞ্চ ভাতা চালু আছে। আমাদের ব্যাংকেও এটি চালু রয়েছে।"

রাকাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, "আমি ঢাকায় মিটিংয়ে আছি। এরকম একটা অডিট আপত্তি ছিল, সেটা আমি জানি। অফিসে ফিরে বিস্তারিত জানাতে পারবো। এই ভাতা সব ব্যাংকেই চালু আছে এবং আমাদের এখানেও নিয়ম অনুযায়ী প্রদান করা হয়েছে।"

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়ম ভেঙ্গে রাকাবের ২য় থেকে ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তারা এখনও লাঞ্চ ভাতা পাচ্ছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি কোনো মন্তব্য দেননি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, রাকাব এখন যেন ভাতের হোটেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি ভাতের হোটেল বললেও ভুল হবে না, কারণ ৪ কোটি টাকার লাঞ্চ কোনো সাধারণ বিষয় নয়। রাকাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতিকরণ ও দলীয় স্বার্থের কারণে ব্যাংকটি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছে। হুট করেই ব্যাংকটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যা আসলে একটি বড় দুর্নীতির অংশ। এ ধরনের দুর্নীতি ও লুটপাটের ফলে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের পথে হাঁটছে। ৪ কোটি টাকার অনিয়ম হয়তো অঙ্কের হিসাবে ছোট মনে হতে পারে, তবে এ ধরনের অনিয়মগুলো ধীরে ধীরে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়। জরুরিভিত্তিতে এসব দুর্নীতি বন্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, এই ব্যাংকটি কৃষকদের ঋণ সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ঋণের সুবিধা কৃষকদের বদলে বড় বড় ধনী ব্যক্তিরা পাচ্ছেন। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শুধুমাত্র নিজেরা সুবিধাভোগী হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের নীতি থেকে সরে যাচ্ছেন। কৃষকদের ঋণ সুবিধা না দিয়ে তারা ধনী ব্যাংক খেকোদের তুষ্ট করার চেষ্টা করছে। এই ধরণের অপব্যবহারের মাধ্যমে তারা ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যারা এত বিপুল পরিমাণ অর্থ তছরুপ করেছেন, তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা উচিত বলে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর