জ্বালানি নিরাপত্তার ঘাটতিতে জীবন বিপন্ন হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র! এই ঘাটতি সৃষ্টি করা সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল, যার দায় রাষ্ট্র এবং সরকারের ওপর বর্তায়।
রোববার (৩০ জুন) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণে জ্বালানি সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ক্যাব প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি’ শীর্ষক সেমিনারে ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম এ মন্তব্য করেন।
শামসুল আলম বলেন, সরকার চরমভাবে আর্থিক ঘাটতির মুখোমুখি। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল দিতে পারছে না। কয়লার বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না ঋণের, কিন্তু ২০২৬ সাল থেকে দিতে হবে।
জ্বালানির অধিকার মৌলিক মানবাধিকার উল্লেখ করে এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, জ্বালানির অধিকার মৌলিক মানবাধিকার কিনা এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার এই রকম যত ধরনের মৌলিক অধিকারের কথা বলা হোক না কেন, কোনোটির ঘাটতি জ্বালানির ঘাটতির মতো বেশি বিপদজনক নয়!
তিনি বলেন, উষ্ণমণ্ডলীয় দেশের অধিবাসী বলে ‘হিটিং এনার্জি’র আবশ্যকতা নিয়ে আমাদের অধিকাংশের ধারণা নেই। শীতার্ত অঞ্চলে এমনকী ঘরের ভেতরে তাপমাত্রা সহনসীমার নিচে নেমে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। কাজেই, কাম্য জ্বালানি সরবরাহ রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। নইলে দুর্ভাগ্যজনক অনিবার্য মৃত্যুর দায় নিতে হয়।
ব্যক্তি কখন এমন মৃত্যুন্মুখ অবস্থায় পড়ে, যখন জ্বালানি অবিচার তাকে জ্বালানি দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়! সে কারণে সর্বমহলের জ্বালানি দারিদ্র্য সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ধারণা থাকা প্রয়োজন।
সেমিনারে ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম আরো বলেন, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবয়ব বিশেষ করে জ্বালানিখাত যদি লুণ্ঠণমূলক শোষণের চিত্র ধারণ করে, তাহলে দুটি বিষয় অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে- একটি জ্বালানি অবিচার এবং অন্যটি জ্বালানি দারিদ্র্য।
এ দুটি নিবিড়ভাবে পরস্পর সম্পর্কিত অর্থাৎ জ্বালানি অবিচার থেকে জ্বালানি দারিদ্র্য উদ্ভুত। জ্বালানি দারিদ্র্য নাগরিকের সার্বিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করে বলে জ্বালানি অবিচার ক্রমবর্ধমান হারে বিস্তার লাভ করতেই থাকে। মৌলিক মানবাধিকারের প্রত্যেকটি উপাদানই সম্পূর্ণভাবে জ্বালানিনির্ভর। খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষাসহ যে প্রতিপাদ্যই সামনে আনা হোক না কেন, প্রত্যেকটিই জ্বালানিনির্ভর। কেবল বাসস্থানের কথাই যদি বলা হয়, জ্বালানি দারিদ্র্য ‘হাউসহোল্ড এনার্জি ইনসিকিউরিটি’ সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, মূল্যহারে জ্বালানি সরবরাহ হচ্ছে বা সরবরাহের জন্য প্রস্তাবিত, তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে কি না, সে বিবেচনা অপরিহার্য। যদি তা না হয়, তাহলে ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশাধিকার সেই সব মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন।
জ্বালানি দারিদ্র্য কার্যত জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতারই বহির্প্রকাশ। জ্বালানি দারিদ্র্যের বেড়ে যাওয়া মানে ‘জ্বালানিতন্ত্র’ কাজ করছে না।
‘জ্বালানিতন্ত্র’ মানে জ্বালানি আহরণ থেকে চূড়ান্ত ব্যবহারকারী পর্যন্ত সরবরাহের কাম্য পদ্ধতি। যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি জ্বালানি দারিদ্র্য রোধ করে না বরং বাড়ায়, সে প্রক্রিয়ার উন্নয়ন কোনোভাবেই জাতীয় প্রত্যাশা নয়।
তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তিকে ‘জ্বালানি দরিদ্র’ বলা যাবে, যদি রান্নার প্রয়োজনে বছরে মাথাপিছু ৩৫ কিলোগ্রাম এলপিজি না পান বা ব্যবহার করেন এবং মাথাপিছু বার্ষিক ১শ ২০ ইউনিট বিদ্যুৎ না পান বা ব্যবহার করেন!
‘জ্বালানি দারিদ্র্য’-এর এই মাপকাঠিতে আমরা আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করিনি। সে লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যমান ‘জ্বালানিতন্ত্র’ উন্নয়ন বা রূপান্তরের জন্য জ্বালানি নীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ ব্যতিত দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। স্মার্ট বাংলাদেশও নয়।
জ্বালানি হচ্ছে, জনগণের মৌলিক মানবাধিকার। কোনো ভোক্তা খাবেন, নাকি ঘরের হিটিং চালাবেন, নাকি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালাবেন, এসব পৃথকভাবে বাছাই করার সুযোগ নেই। যাই করুন, প্রত্যেকটিতেই জ্বালানিসম্পৃক্ত। সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মূল্যহার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় আমরা জ্বালানি অধিকার বঞ্চিত ও জ্বালানি দারিদ্র্যের শিকার।
ড. শামসুল আলম বলেন, ‘বিইআরসি আইন-২০০৩’ এর ৩৪ ধারা পরিবর্তন দ্বারা গণশুনানি রদ করে মূল্যহার নির্ধারণের ক্ষমতা সরকার নিজের হাতে নেওয়ায় সরবরাহ ব্যয় ও মূল্যহার উভয়ই অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, ন্যূনতম ব্যয়ে জ্বালানি সরবরাহ ও ন্যায্য মূল্যহারে ভোক্তার জ্বালানি প্রাপ্যতা বিপন্ন এবং ভোক্তা জ্বালানি অধিকার বঞ্চিত। এই পরিস্থিতি জনগণকে চরম জ্বালানি দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
জ্বালানি সুবিচার হচ্ছে, জ্বালানিখাতে বিরাজমান প্রকাশ্য ও গুপ্ত অবিচার এবং অসাম্য প্রতিরোধে গৃহীতব্য কল্যাণমুখী বহুস্তর পদক্ষেপ। জ্বালানিখাতে ন্যায্যতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জ্বালানি আহরণ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ব্যবহার ও ভোগ পর্যন্ত সব স্তরে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ।
জ্বালানিখাতে উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বিতরণ ও মূল্য নির্ধারণ পর্যন্ত সব স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা। এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল সূত্র একই।
বাংলাদেশে চলমান জ্বালানি রূপান্তরে কতটা জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত হয়, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা করার জন্য এই নাগরিক সংলাপ থেকে সংসদ সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।