বাজেটের উন্নয়ন দর্শনে শিক্ষা খাত

, অর্থনীতি

ড. মোঃ আইনুল ইসলাম | 2024-06-11 18:27:15

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে জীবনের প্রথম বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এই বাজেট নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা চলছে। এসব বিশ্লেষণ-একদিকে পর্যালোচনায় বরাদ্দ ও কর-শুল্ক বিষয়ক আলোচনায় বলা হচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটের কৃষি উপকরণ ও সারের ওপর কোনো বাড়তি শুল্ক না বসানো, নির্মাণসামগ্রীতেও নতুন করে কোনো শুল্ক আরোপ না করা, অপ্রয়োজনীয় কথা বলা কমাতে মোবাইল ফোনের কলচার্জের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো, এডিপিতে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সরকারের ব্যয় কমানোর চেষ্টা এবং মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখা, যাদের আয় বেশি তাদের আয়কর বেশি দেওয়া ইত্যাদি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

অন্যদিকে যারা বাজেটের গভীরে গিয়ে বাজেটে রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন এবং যারা মনে করেন আর্থিক বিবরণী বা বার্ষিক বাজেট শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, দিগ্দর্শনও বটে। এরা বাজেটে বরাদ্দ নয়, বাজেটের গতিপথ-প্রবণতা ও দর্শন দেখে ভিন্ন কথা বলছেন। এই দলে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশ্লেষকেরাও রয়েছেন। তারা প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাজেটে শিক্ষা খাতের অর্থ বরাদ্দ ক্রমশই কমিয়ে ফেলা এবং শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রের দর্শনে দৈন্যতার বাড়বাড়ন্ত রূপ দেখে নীরবে আক্ষেপ করছেন। 

তারা বলছেন, বাজেট নামে সরকারের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী বা রাষ্ট্রের বার্ষিক উন্নয়ন দলিলে শিক্ষাদর্শন ও প্রবণতা এভাবে চলতে থাকলে বঙ্গবন্ধুর আমরণ আরাধ্য সোনার বাংলা ও স্বদেশের মাটি-উত্থিত উন্নয়ন দর্শন থেকে অনেক দূরে চলে আসা বাঙালি জাতি একসময় ‘জ্ঞানখাটো’ জাতিতে পরিণত হবে, যেখানে নানা উপায়ে বিত্ত-বিভবের মালিক হওয়া শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের সুবিধা নিয়ে সংখ্যাস্বল্প মানুষের একটি দল জ্ঞানখাটো বাঙালিদের দাসের চোখে দেখবে। ২০২৪-২৫ বাজেটে শিক্ষা বিষয়ক বরাদ্দ ও প্রবণতা বিশ্লেষণের আগে শিক্ষাবিদদের এমনতর আক্ষেপের কারণ কী, সেদিকে আলোকপাত করা যাক। 

তাদের মতে, ১,০৭২.১৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপি নিয়ে বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ার বড়াই করলেও, সস্তামূল্যের পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় হওয়ার বড়াই করলেও, মাছ-আলু-পটলে উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশ হওয়ার বড়াই করলেও     জ্ঞান ও শিক্ষার সমগ্রক বিচারে বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বের নিকৃষ্টদের মধ্যে অন্যতম। ২০২৩ সালের বিশ্ব জ্ঞান পরিকাঠামো ও পৃষ্ঠপোষকতা সূচক বা গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১৩৩ দেশের মধ্যে ১১২তম, যা মাঝারি মানব উন্নয়নের ২৫টি দেশের মধ্যে ২১তম। শুধু জ্ঞানের ভার বহনে অক্ষমই নয়, বাংলাদেশ সামগ্রিক শিক্ষা বিচারে বিশ্বে ১২০তম (ওয়ার্ল্ড এডুকেশন র‌্যাংকিং ২০২৩)। ২০২৩ গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে সামগ্রিকভাবে ১৩২ দেশের মধ্যে ১০৫তম, এর মধ্যে মানবপুঁজি ও গবেষণায় ১২৫তম ও উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানে ১০৮তম। 

শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশ্লেষকেরা জ্ঞানখাটো জাতি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের স্পষ্ট লক্ষণ বুঝতে আরও তিনটি বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ের কথা বলছেন। প্রথমটি হচ্ছে, মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাংলাদেশ ৮ নম্বরে, ইন্টারনেট ব্যবহারে ৯ নম্বরে। এই দুটি র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে থেকে যারা সুখ পেতে চাইছেন, তাদের জানা প্রয়োজন এই দুটি ব্যবহার করেই বাংলাদেশ ‘সময় নষ্টে ওস্তাদ’ ফেসবুক ব্যবহারে বিশ্বে ১০ নম্বরে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার ও দেশি-বিদেশি সংস্থার করা যৌথ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১০-১৯ বয়সী ছেলেদের ৭২ শতাংশ, মেয়েদের ৬৩ শতাংশ মেয়ে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এদের বেশির ভাগ আবার ১০-১৫ বছর বয়সী। এই শিশু  ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহারকারীর ৯৮ শতাংশ অন্তত ১ বার অশ্লণীল ভিডিওর পর্নোগ্রাফিক সাইটে প্রবেশ করেছে। করোনাপরবর্তী এই উপাত্ত এখন আনুষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে নতুন পাঠ্যক্রম চালু করার পর থেকে। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে বেশি সময় দিতে গিয়ে এই শিশুরা খাদ্য-বস্ত্রের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করছে, যে কারণে এদের মধ্যে খিটখিটে স্বভাব ও চোখে কম দেখার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। 

ওদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোবাইলে জুয়া-লুডু খেলার প্রবণতা বাড়ছে, যা ব্যস্ত ফুটপাতে একটি মোবাইল ঘিরে ছোট ছোট জটলা দেখলে সহজেই বোধগম্য হবে। শুধু তা-ই নয়, রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা এখন ব্যাচ করে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও জুমে কোচিং করাচ্ছেন। আর নারী শিক্ষকদের উঠতি প্রজন্মের কেউ কেউ শ্রেণিকক্ষে ও টিচার্স রুমে বসেই  ফেসবুকে লাইক-কমেন্ট শেয়ার করছেন, ফেসপাউডার আর ফর্সা হওয়ার ক্রিম বিক্রি করছেন। আইন প্রণয়ণের সংসদে বসে, কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে হিসাব-কিতাবে নিজেদের ভাগে বেশি বরাদ্দ রেখে বাজেট বরাদ্দ প্রণয়ন করলে শিক্ষা ব্যবস্থার গভীরে ঘটমান এসব অবক্ষয় চোখে পড়ার কথা না। 
  
এমন এক পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছর এবং এর আগের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রবণতায় আলোকপাত করলে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শিক্ষায় মোট বরাদ্দের তুলনায় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। তবে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা এই বৃদ্ধিকে ‘লোকদেখানো’ অভিহিত করেছেন। কারণ, শিক্ষার এই বরাদ্দের কিছু অংশ এমন কিছু সরকারি কর্মকা-ে চলে যায় এবং যাবে, যার সঙ্গে শিক্ষা খাতের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই। এ রকম অতীতে দেখা গেছে। 

উপরন্তু, টাকার আন্তর্জাতিক মানে বড় অবমূল্যায়ন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছাড়াও ২০২৩ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় উপকরণ ব্যয় যথাক্রমে ২৫ ও ৫১ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে আবার প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। যেখানে শিক্ষায় বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫-৬ শতাংশ হওয়া জরুরি, যেখানে মেধাবীদের শিক্ষক হওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে নির্বিঘেœ জীবনধারণের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন;  সেখানে প্রতিবছর এসব কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা শিক্ষাকে বাজারের পণ্যে পরিণত করার জন্য এবং ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নামান্তর মাত্র।  

অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট নাগরিকরা সহায়ক হবে।  তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।”  শিক্ষা সম্প্রসারণে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও উন্নয়ন, ছাত্র ও শিক্ষকদের বৃত্তি-উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা, মেধার বিকাশে নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। শিক্ষার সম্প্রসারণে সহায়ক নীতিমালা ও পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী নতুন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের ১৬০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাগিয়ে ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এ কথা বলা হয়নি যে, আর গত বাজেটে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২০ কোটি টাকা পেলেও এবারের বাজেটে মাত্র ১ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। বলা হয়নি, রংপুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলেও রাখা হয়নি কোনো বরাদ্দ।

অথচ একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো দেখা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা কতটা শক্তিশালী। উন্নত ও ধনী দেশের বাজেটে শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে না‑ই বা গেলাম। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশ, যারা উন্নত দেশে পরিণত হতে চাইছে, তাদের বেশির ভাগেরই শিক্ষাখাতের বরাদ্দ অনেক বেশি। মালয়েশিয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ছিল শিক্ষাখাতে, যার পরিমাণ ছিল ৫০ দশমিক ৪ বিলিয়ন মালয়েশিয়ান রুপি, যা সরকারি ব্যয়ের ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। 

আমাদের পাশ্ববর্তী নেপাল ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রেখেছে মোট বাজেটের ১১ শতাংশ, যা জিডিপির ৪ শতাংশ। দীর্ঘদিন গরিব দেশের রাজা তকমাধারী ভুটান ২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রেখেছিল শিক্ষাখাতে, যার পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন নেপালি রুপি, যা সরকারি ব্যয়ের ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ১ শতাংশ। এ ছাড়া শিক্ষাখাতে ব্রাজিলে জিডিপির ৬ শতাংশ, আফ্রিকার দেশ ঘানায় জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। অন্যদিকে স্বাধীনতাপরবর্তী বঙ্গবন্ধুর সরকারের ঘোষিত প্রথম বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ২১ শতাংশ। এ নিয়ে পরে বলা যাক। 

২০২৪-২৫ বাজেটে জিডিপি বিচারে কমিয়ে দেওয়া শুধু নয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশনে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষকদের প্রতিবাদ-অসন্তোষের মধ্যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সঞ্চয়ের ওপর বাজেটে কর বাড়ানো হয়েছে, যা শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রমে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করার ক্ষমতাকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ, এর মাধ্যমে শিক্ষককে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে পাঠদানের বাইরে অতিরিক্ত কাজ করার দিকে যেতে বাধ্য করবে। এমনিতেই মেধাধীদের শিক্ষা পেশায় আসার প্রবণতা কমে যাচ্ছে, সবাই উচ্চ বেতন-সুবিধার সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে না-হয় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তার ওপর শিক্ষকদের সৈয়দ মুজতবা আলীর পাদটীকা গল্পের প-িত মশাইয়ের ‘তিন ঠ্যাঙ্গা সারমেয়’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 

জ্ঞানতত্ত্বের গুরু মহাজ্ঞানী প্লেটো (খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭-খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৭) তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে মানুষের শিক্ষা, শিক্ষক ও সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে (জাতি-রাষ্ট্র) শিক্ষার গুরুত্ব-মাহাত্ম্য উপলব্ধি করাতে অনেক উক্তি করে গেছেন, সর্বকালীন যুগোপযোগিতার কারণে তাঁর সেসব উক্তি জ্ঞানসমাজে এখনো বেদবাক্য হয়ে আছে। বাংলাদেশের শিক্ষাযাত্রার চলমান প্রবণতায় মহাজ্ঞানী প্লেটোর তিনটি উক্তি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য হতে পারে। শিক্ষা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সবচেয়ে কার্যকর ধরনের শিক্ষা হলো তা, যা একটি শিশুকে সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার পথে নিয়ে যায়।” 

শিক্ষক সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “একটি শিশুকে শাসন ও তাচ্ছিল্য করে শেখার প্রশিক্ষণ দেবেন না; তাদের মনকে যা আনন্দ দেয়, তার মাধ্যমে নির্দেশনা দিন; যাতে করে আপনি সঠিকভাবে কার্যকরতার সাথে প্রত্যেকের প্রতিভার অদ্ভুত বাঁককে আরও ভালোভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন।” আর জাতি-রাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কে বলেছিলেন, “শিক্ষা যে দিশায় শুরু হয়, তা দিয়ে ভবিষ্যৎ বিনির্মিত হয়।” বাংলাদেশের মানুষকে আমরা কোন দিশায় নিয়ে যাচ্ছি, তা বাঙালিরা দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে দেখে-শুনে-বুঝে নিলেই ভালো হয়। তবে ২৪০০ বছর আগে একজন শিক্ষক হিসেবে প্লেটো পাশ্চাত্যের মানুষের উন্নত ও সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার জন্য কী কী করণীয়, তা প্রচার করে এবং সে মতো চলে কী পাওয়া গেছে, তা জেনে নিতে পারেন। মহাজ্ঞাণী প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এথেন্সের অ্যারিস্টোনিমাস, এরিস্টটল, এথেনিয়াস, চিয়ন, করিসকাস, যাঁরা পরে শিক্ষক হয়ে প্লেটোর জ্ঞানের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। দার্শনিক সক্রেটিসের কথা এবং তিনি যে প্লেটোর জ্ঞানচক্ষু ছিলেন, তা বিশ্ববাসী প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের মাধ্যমেই জেনেছেন। সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের পরের কয়েক শত বছরে পাশ্চাত্যের সমাজে দর্শন, সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, সমর ও প্রকৌশলসহ নানা বিদ্যায় অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটতে থাকে। 

সমাজে বসবাসকারী মানুষজনের মধ্যে যে জ্ঞানের এই বিকাশ বাধাহীনভাবে চলেছে, তা নয়। শাসকশ্রেণির লোভ-লালসা আর মানুষজনকে দাস বানিয়ে রাখার প্রবণতা কোনো কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশ থমকে দিয়েছে। তবু জ্ঞানের আলো পাওয়া পাশ্চাত্যের বিকাশধারা কখোনোই বন্ধ হয়ে যায়নি। এই বিকাশ দিয়েই পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো বাকি বিশ্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, যা এখন বলা যায় একচ্ছত্র আধিপত্যে রূপ নিয়েছে। পাশ্চাত্যের শিক্ষাকে প্রগতির বাহন করার সুফল উপলব্ধি করে এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশ স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ পেয়েই শিক্ষাকে সবার আগে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে এবং তারা অল্প সময়েই পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সমকক্ষ হয়ে উঠেছে যেমন এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া। এসব দেশের মানুষ শাসকগোষ্ঠীর শোষণপ্রক্রিয়া বন্ধ করার সুুযোগ পেয়েই সবার আগে কার্যকর শিক্ষা অর্জনকে ধ্যানজ্ঞান করেছে।

এসব জ্ঞানের কথা বলে, শিক্ষাবিদদের আক্ষেপের কারণ শুনিয়ে বঙ্গবন্ধু কাছে ফিরে গিয়েই সান্ত¡না পেতে হয়। কারণ, তিনি শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের অন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দূর করতে গিয়ে সে বছর আর তা করা যায়নি। তাঁর নির্দেশে তৈরি কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ৫-৭ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করেছিল সেই সময়েই। বঙ্গবন্ধু কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশমতো পর্যায়ক্রমে বরাদ্দ বৃদ্ধির চিন্তাভাবনা করেছিলেন, আরও বাড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট শহীদ হওয়ায়, তাঁর সেই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আর এরপর থেকে সবকিছুই উল্টোরথে চলেছে। তবে আফসোস-পরিতাপের বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুরই হাতে গড়া আওয়ামী লীগের আমলেও শিক্ষার প্রতি অবহেলার মানসিকতার দৈন্যতা চলছে।

শিক্ষাঙ্গনের কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ ব্যবহার করতে পারে না বলে বছর বছর অর্থ কমিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই শোভন নয়, বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমরা পৃথিবী ছেড়ে গেলেও, আমাদের সন্তানেরা তো এ দেশেই বড় হবে। সরকারের অনেক বিভাগ ও মন্ত্রণালয় তো ৭-৮ মাস চলে গেলেও বাজেট বাস্তবায়ন ও বরাদ্দ ব্যবহার করতে পারে না। শেষ সময়ে এসে তড়িঘড়ি করে খরচ করার নামে দুর্নীতি ও অদক্ষতার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। অনেক অর্থ আবার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সন্তানেরা আমেরিকা-ব্রিটেনে ঘর বাঁধলেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেখানে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকবে। আর যদি পাশ্চাত্যে ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলন শুরু হয়, ট্রাম্পের মতো উগ্র স্বদেশপন্থী লোকজন পাশ্চাত্যের ক্ষমতা নেয়, তাহলে তো এই দেশেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ফিরে আসতে হবে। 

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

এ সম্পর্কিত আরও খবর