অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখছে এস আলম গ্রুপ

, অর্থনীতি

নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-05 20:56:37

ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে বাংলাদেশকে এখন এশিয়ার অর্থনীতিতে ‘পঞ্চম বাঘ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কয়েক দশক আগেও বিশ্ব মঞ্চে একটি ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ হিসাবে ডাকা হলেও বর্তমানে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।

পূর্বের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিশাপকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। লন্ডন-ভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এর পূর্বাভাস অনুসারে এটি ২০৩৮ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০ তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের অবদান ছাড়া এই অভূতপূর্ব সাফল্য সম্ভব হতো না।

গ্রুপটি ১৯৮৫ সাল থেকে ৩৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিকাশমান অর্থনীতি মজবুতকরণে কাজ করছে। শিল্পগোষ্ঠীটি তার দীর্ঘ যাত্রায় দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য, বিদ্যুৎ খাত, আমদানি ও পরিশোধন, স্থাপত্য, বিস্তৃত শিল্প ও অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোতে সম্পৃক্ত রয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল, স্বাস্থ্য, টেক্সটাইল, আইটি এবং অন্যান্য ব্যবসায় হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সচল রাখছে দেশের অর্থনীতি। সংস্থাটির উন্নয়ন উদ্যোগের ফলে ২ লাখেরও বেশি লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে, যা দেশের আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 

প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও পরিশোধন

এস. আলম গ্রুপ ছয়টি ভোজ্যতেল এবং দুটি চিনি শোধনাগারের কর্ণধার। তেল, গম এবং চিনির বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে দেশের বাজারে চিনি, গম, ছোলা, পেঁয়াজ এবং তেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে এস আলম গ্রুপ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

২০২৩ সালে কোম্পানিটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টন চিনি আমদানি করেছিল, যার মূল্য ৪৯ কোটি ৫ লাখ ডলার। গত তিন বছরে (২০২৩, ২০২২, ২০২১) চিনি আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন, যার মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৮২ কোটি ৬১ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা।

এছাড়া ২০২৩ সালে ৫ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানি হয়েছিল, যার মূল্য ১৪ কোটি ৫৬লাখ ডলার। গত তিন বছরে (২০২৩, ২০২২, ২০২১) গমের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১০ হাজার টন যার মূল্য ৪৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

গত বছর পাম ও সয়াবিন তেলের মোট আমদানি ছিল প্রায় ৩ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন। যেখানে পাম তেল ছিল প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন এবং সয়াবিন তেল ছিল প্রায় ৩৬ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। পাম তেলের আর্থিক বাজার মূল্য ছিল যথাক্রমে ২৫ কোটি ৯১ লাখ ৪৭ হাজার ১৫২ ডলার এবং সয়াবিন তেলের জন্য ৪ কোটি ১৯ লাখ ১ হাজার ৭২ ডলার। গত তিন বছরে (২০২৩, ২০২২, ২০২১) মোট তেল আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১০৬ মেট্রিক টন, যার মূল্য ১৫৬ কোটি ৮২ লাখ ৪২ হাজার ৩৩১ টাকা।

এস. আলম গ্রুপ বর্তমান অভ্যন্তরীণ বাজারের তেল, গম এবং চিনির চাহিদার যথাক্রমে ৩০,২০ এবং ৩৫ শতাংশ পূরণ করে। এই বছর এই হার ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে কোম্পানিটির। এস আলম গ্রুপের ছয়টি ভোজ্য তেল শোধনাগার এবং দুটি সক্রিয় চিনি শোধনাগারের পাশাপাশি আরেকটি নির্মাণাধীন রয়েছে। এই স্ব-অর্থায়নকৃত শোধনাগারগুলোতে ইউরোপীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন ভোজ্য তেল এবং ৫ হাজার ১০০ মেট্রিক টন চিনি পরিশোধন করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে দুটি চিনি শোধনাগার রয়েছে। অন্যান্য মেগা চিনি শোধনাগারের নির্মাণ কাজ ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হবে।

তেল শিল্পে এস. আলম গ্রুপের নিট বিনিয়োগ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং চিনি শিল্পে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কোম্পানিটি ৬ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হয়েছে। বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের একক প্রচেষ্টায় এতবড় সাফল্যের দৃষ্টান্ত কমই পাওয়া যাবে। 

বিদ্যুৎ খাতে বৃহৎ বিনিয়োগ: বাঁশখালীতে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের এসএস পাওয়ার প্লান্ট এবং ৩ বিলিয়ন ডলারের সবুজ ও নবায়নযোগ্য শক্তি

এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট

এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে দেশের প্রথম বৃহৎ বেসরকারি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ১৩২০-মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টটি প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে। এস. আলম গ্রুপের এই প্রকল্পে ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, বাকি ৩০ শতাংশ চীনা কোম্পানি এসইপিসিও ৩ এবং এইচটিজির হাতে রয়েছে।

গত বছর, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডে একীভূত করা হয়েছিল, যেখানে দুটি ইউনিট রয়েছে এর প্রতিটির ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। প্রথমটির বাণিজ্যিক বাণিজ্যিক উৎপাদন ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এবং ২৬ অক্টোবর, ২০২৩-এ দ্বিতীয় ইউনিটের উদ্বোধন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের বিশেষ দিক হল, এটির উৎপাদিত শক্তি অন্যান্য অনেক পাওয়ার প্ল্যান্টের তুলনায় বেশি সাশ্রয়ী।

সবুজ ও নবায়নযোগ্য শক্তি

এস. আলম গ্রুপের হাতে নেয়া সাম্প্রতিক মেগা প্রকল্প হল সবুজ ও নবায়নযোগ্য শক্তি। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে স্থাপিত কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টের প্রত্যাশিত ক্ষমতা হবে ৩ হাজার মেগাওয়াট। সূচনা থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৫০% সবুজ শক্তি দিতে সক্ষম হবে এবং পরে ধীরে ধীরে এটি ১০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হবে। এই প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার এবং এটি ২০২৭ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। এটি সম্পন্ন হলে, এই প্রকল্পটি প্রায় পাঁচ হাজার লোকের জন্য সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া সেখানে পরোক্ষভাবে এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। জিই, সিমেন্স এবং মিতসুবিসি-এর মতো নেতৃস্থানীয় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে এই সবুজ এবং পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তিতে নিযুক্ত করা হবে। এই প্রকল্পের অনন্য প্রকৃতির কারণে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কার্বন ট্যাক্সের সুবিধা পাবে দেশ। যা টেকসই শিল্পোন্নয়ন প্রচেষ্টার এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। 

অবকাঠামো নির্মাণ খাতে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্প: দেশে উৎপাদিত হচ্ছে বিশ্বমানের ইস্পাত ও সিমেন্ট

এস. আলম গ্রুপ ১৯৯৫ সালে গ্যালভানাইজিং এবং স্টিল শিট প্রক্রিয়াজাত প্রক্রিয়া শুরু করে। এই কারখানাগুলি চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত।জাপানি এবং ইতালীয় প্রযুক্তিভিত্তিক এই ফ্যাক্টটোরিগুলিতে, 'সিআই এবং জিপি শিট', 'কালার কোটেড সিজিআই শিট,' 'কোল্ড রোল্ড স্টিল শিট' এবং আরও অনেক কিছু তৈরি করা হয়।

এই গালভানাইজিং প্ল্যান্ট এবং ফ্ল্যাট রোলিং প্ল্যান্টগুলিতে ৬৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং ২০০০ এরও বেশি কর্মচারী এই শিল্পে কাজ করে। গ্যালভানাইজিং শিল্পের চারটি প্ল্যান্টের মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রতিদিন প্রায় ৯৩০ মেট্রিক টন। এছাড়া, দুটি ফ্ল্যাট রোলিং প্ল্যান্টের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন।

একটি উল্লেখযোগ্য স্ব-অর্থায়নে এস. আলম গ্রুপ ২০০০ সালে চট্টগ্রামের চরপাথরঘাটায় 'পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট ফ্যাক্টরি' শুরু করে। ১৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠানটিতে ১৫০০ জনেরও বেশি কর্মী রয়েছে। জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করা এই প্ল্যান্টে দৈনিক উৎপাদন হয় ১২০০ মেট্রিক টন সিমেন্ট।

৫৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২ শিল্পাঞ্চলে ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি

সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, এস. আলম গ্রুপ দুইটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা করেছে। এগুলো হচ্ছে ১৮৪ একর জমি উপর 'বাঁশখালী এস. আলম অর্থনৈতিক অঞ্চল ১' এবং ২৫৯ একর জমি উপর 'বাঁশখালী এস. আলম অর্থনৈতিক অঞ্চল ২' ।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়িক শিল্পগোষ্ঠী এই গ্রুপের ৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ হাজার কোটি, এইচআর কয়েল খাতে ১৫ হাজার কোটি, ডিআরআই প্ল্যান্ট খাতে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা এবং বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে গ্রুপটির।

শিল্পাঞ্চল দুটির কার্যক্রম শুরু হলে ৫০ হাজারের বেশি নতুন কর্মসংস্থান তৈরিসহ বিপুল পরিমাণের বিদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও সরকারের রাজস্ব আহরণের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে আরও ৪০০ একর ভূমি ‘বাঁশখালী এস আলম ইকোনমিক জোন ২’-এ যুক্ত করা এবং জাপানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বেশ কিছু মাঝারি ও ভারী শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে এস আলম গ্রুপের।

শিল্পাঞ্চল দুইটি বাস্তবায়ন হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে এবং সরকারের রাজস্ব খাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যসেবা তহবিল: ৫ লাখেরও বেশি মানুষকে সেবা দিতে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ

এস. আলম গ্রুপ তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে দেশে প্রধান প্রধান শহরে ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা এবং স্বাস্থ্যসেবাকে সবার কাছে আরও সহজলভ্য করা। দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়িক শিল্পগ্রুপের উদ্যোগে চট্টগ্রামে ‘এস. আলম ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এটি অনকোলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, এন্ডোক্রিনোলজি, অর্থো-পেডিক্স, পেডিয়াট্রিক্স, গাইনোকোলজি এবং মাতৃত্বকালীন যত্নসহ বিভিন্ন মতো সেবা প্রদান করবে।

গ্রুপটি দেশের বিভিন্ন স্থানে মেডিকেল ও নার্সিং কলেজ এবং অন্যান্য চিকিৎসা সুবিধা স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেছে। এখন পূর্বাচল, বসুন্ধরা এবং অন্যান্য এলাকায় ভূমি উন্নয়নে কাজ করছে। এস আলম গ্রুপের এসব উদ্যোগে ৫ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে। ইউরোপীয়, ভারত এবং পূর্ব এশীয় ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হচ্ছে, যা ৫ লাখেরও বেশি লোককে সেবা দেবে। এসব প্রয়াসের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল এশিয়াতেই নয়, এক সময় বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠবে, এই প্রত্যাশা দৃঢ়ভাবেই করা যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর