কোভিড-১৯ মহামারীকালীন সময়ে বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটি বড় ধাক্কা। ঝুঁকিগ্রস্ত হয়েছে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক সরবরাহ ব্যবস্থা। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বেশ কিছু উৎপাদনশীল শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন উৎস চীন থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিল জাপান।
এর পিছনে জাপান যে কারণগুলোকে তুলে ধরেছে তা হলো- জাপানি পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা গতিশীল রাখা এবং চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা কমানো। স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়ায় জাপানিজ কারখানার দুইটি সম্ভাব্য নতুন গন্তব্য ঠিক করা হয়েছে। ১) কারখানার একটি বড় অংশ জাপানে ফিরিয়ে নেয়া, ২) যেসব কারখানায় অধিক শ্রমের দরকার তা দক্ষিণপূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তর করা। এ লক্ষ্যে জাপান সরকার ইতিমধ্যে দুইটি ভিন্ন অর্থনৈতিক প্রণোদনাও ঘোষণা করেছে। যার পরিমাণ জাপানে ফিরিয়ে নেয়া কোম্পানির জন্য প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য দেশে স্থানান্তরের জন্য প্রায় ১ হাজার ৭শ কোটি টাকা।
তবে বিশ্লেষকদের মতে চীনে জাপানিজ কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত বা শিল্প প্রতিষ্ঠান অন্যত্র স্থানান্তরের ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০০৫ সালে চীন জুড়ে জাপান-বিরোধী বিক্ষোভের কারণে জাপান ‘চীন প্লাস ওয়ান’ পলিসি গ্রহণ করে তার কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তর করেছিল। এমনকি ২০১২ সালে পূর্ব চীন সাগরের সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে সৃষ্ট অস্থিরতার জের ধরে চীনে পুনরায় জাপান-বিরোধী বিক্ষোভ ফুঁসে উঠে। যার ফলশ্রুতিতে তখন ক্যানন এবং প্যানাসনিকের মতো শীর্ষস্থানীয় জাপানিজ কোম্পানি তাদের উৎপাদন কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি পূর্বের তুলনায় কিছুটা হলেও ভিন্ন। এক্ষেত্রে জাপানিজ পণ্যের সরবরাহ গতিশীল রাখা এবং চীনের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা ব্যতীত আরো কিছু বিষয় সামনে চলে আসছে। যেমন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র ‘বাণিজ্য-যুদ্ধের’ দরুন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধি, পূর্ব এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রভাব, হংকং এবং তাইওয়ান নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা এবং এই প্রক্রিয়ায় শিনজো আবের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এর কার্যত রাজনৈতিক ভিত্তি আরো শক্তিশালী করা। জাপানিজ কারখানা প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত যে কারণেই হোক না কেন, তা যে সস্তা শ্রমের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কাছে বড় প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
জাপান সরকার চীন থেকে তাদের কারখানা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরপরই ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত সহ অনেক দেশ জাপানের এই নতুন বিনিয়োগ তাদের স্ব স্ব দেশের মাটিতে টানার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা শুরু করে দিয়েছে। উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ এশিয়ার অনগ্রসর অর্থনীতি এবং পণ্য বিক্রির জন্য আদর্শ বাজার না হওয়ার দরুন একটি লম্বা সময় ধরে জাপান এই অঞ্চলকে অর্থনৈতিক সহযোগী অঞ্চল হিসেবে বিবেচনায় নেয় নি। কেননা, জাপান তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে সবসময় অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষত ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা তে একটি মধ্য শ্রেণির উত্থান এই অঞ্চলে জাপানি পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে তুলেছে। পাশাপাশি সস্তা শ্রম, নতুন উঠতি বাজার, বিনিয়োগের উত্তম পরিবেশ; অর্থাৎ স্বল্প খরচে পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের সুবিধা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ এশিয়া জাপানের কাছে বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হতে চলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে জাপানের কারখানা স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের সামনেও একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। যদিও কৌশলগত এবং আর্থিক দিক বিবেচনায় এই অঞ্চলে ভারতকে এগিয়ে রাখতে হবে, তবে বাংলাদেশ যে অনেকটা পিছিয়ে আছে সেটা বলারও সুযোগ নেই। বিগত কয়েক বছর ধরেই জাপান বাংলাদেশের একক উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যার মূল ভিত্তি সূচিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাপানের প্রেরিত বিশেষ প্রতিনিধি দল ‘স্পেশাল গুডউইল এনভয়’ (Special Goodwill Envoy) এর মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে, ২০১৪ সালে, দুই দেশের মধ্যে হওয়া ‘কম্প্রিহেন্সিভ পার্টনারশিপ’ (Japan-Bangladesh Comprehensive Partnership Treaty) চুক্তি জাপানের এই উন্নয়ন সহযোগিতার ধারাবাহিকতাকে আরো বেগবান করে তুলেছে, যার বাস্তবিক প্রমাণ হচ্ছে ‘বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি)’ এর মত জাপানিজ মেগা প্রকল্প।
তবে, প্রশ্ন জাগতে পারে যে জাপান-বাংলাদেশের মধ্যকার এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কি চীনত্যাগী জাপানি কারখানার নতুন বিনিয়োগ প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট কিনা অথবা জাপানি নতুন বিনিয়োগকে বাংলাদেশমুখী করতে আমরা কতটা উদ্যোগী।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, জাপান কোন দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ঃ ক) সরকারের বিনিয়োগ বান্ধব পলিসি; খ) অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিরতা; গ) কাঁচামালের সহজলভ্যতা; ঘ) শ্রম বান্ধব এবং শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা সংশ্লিষ্ট কঠোর জাতীয় আইন; ঙ) সস্তা শ্রম এবং জাপানি পণ্যের উপযুক্ত বাজার; চ) বিনিয়োগ প্রাপ্তির লক্ষ্যে সরকারের সুনির্দিষ্ট এবং ফলপ্রসূ প্রস্তাব ইত্যাদি।
যদি বাংলাদেশের দিকে একটু তাকাই তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশে বিগত কয়েকবছর ধরে একটি রাজনৈতিক স্থিতিরতা বিরাজমান। যদিও ২০১৬ সালের হলি আরটিসানে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে জাপান এখনো বাংলাদেশকে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি মনে করে, তথাপি সরকারের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স কিছুটা হলেও জাপানি বিনিয়োগকারীদের মনে সাহসের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে শ্রমিকদের কম মজুরি, উঠতি মধ্য শ্রেণির জন্য জাপানি পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এদেশে জাপানি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে প্রায় ১,০১০ একর জমির উপর ‘জি-টু-জি’ ভিত্তিক ‘জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে তোলার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা ২০১৯ সালের ৫ মার্চ একনেকে অনুমোদিত হয়। এছাড়া মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রায় ২৫ একর জমিতে জাপানি হোন্ডা মোটর কর্পোরেশন এর জন্য কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে প্রায় ১২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা বিনিয়োগে জাপান টোব্যাকো বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কিনে নেয়। এছাড়াও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য জাপানের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইয়ামাহা আগ্রহ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের এই বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির কারণে দেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জাপানের প্রায় তিন শতাধিক কোম্পানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সর্বাধিক কম। বিগত কয়েক বছরে জাপানে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
তবে, দেশে কল-কারখানার পরিবেশ, শ্রম বান্ধব আইনের অনুপস্থিতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসবাদের উপস্থিতি দেশে জাপানি বা বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়াতে পারে।
নতুন উদ্ভূত জাপানি বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন আশার আলো দেখালেও বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে খুব সাবধানে পা ফেলার বিকল্প নেই। যদিও জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার রাষ্ট্র, তথাপি জাপানের নতুন এবং অতীব জরুরি এসব পণ্যের বিনিয়োগে জাপান যে সতর্কতা এবং অনেক হিসেব নিকেশ করেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, জাপানি নতুন বিনিয়োগ ধরার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি। এখন পর্যন্ত মাত্র বাংলাদেশের দুইটি সংস্থা জাপানি বিনিয়োগ প্রাপ্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেঃ বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন্স অথরিটি (বেজা) এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা)। এরমধ্যে একমাত্র বেজা দেশে প্রায় ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, যার মধ্যে জাপানের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের পরিকল্পনাও করছে, যা নিঃসন্দেহে কার্যকরী উদ্যোগ।
যাইহোক, যেহেতু জাপানের এই বিশাল বিনিয়োগ ধরার লক্ষ্যে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো মুখিয়ে আছে, সেহেতু বাংলাদেশকেও বসে থাকলে চলবে না। কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ বান্ধব নীতি এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানি বিনিয়োগকারীদের বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে সরকারীভাবে কিছু প্রণোদনা এবং আরো বিশেষায়িত অঞ্চল প্রদান করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধার্থে দেশের ভূমি, শ্রম এবং কর আইনকে প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি পণ্যের গুণগত মান রক্ষায় দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এখন থেকেই একনিষ্ঠতার পরিচয় দিতে হবে, এবং সরকারকে এ বিষয়ে তদারকি জোরদার করার কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ কতটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ কে নিয়ন্ত্রণ করে বিনিয়োগ বাজারে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।অন্যথায়, চীনত্যাগী জাপানি পণ্যের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশের সামনে যে সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
সর্বোপরি, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন বুনছে সেক্ষেত্রে জাপান এবং জাপানি বিনিয়োগ হতে পারে প্রধান সহযোগী।
মো. সাইফুল্লাহ আকন, শিক্ষক, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়