সুরক্ষা বা নিরাপত্তা শব্দটি একটি বিস্তৃত ধারণা যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নিরাপত্তা বোঝায়। প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি জাতীয় সুরক্ষা নীতি রয়েছে যেগুলো রাষ্ট্রকে হুমকি এবং সহজাত দুর্বলতা থেকে রক্ষা করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকি দুই দিক থেকে আসতে পারে যেমন প্রথাগত এবং অপ্রথাগত সুরক্ষা। প্রথাগত নিরাপত্তা হুমকি সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি থেকে আসতে পারে।
স্নায়ুযুদ্ধের পূর্বে বা পরে মূলত সামরিক শক্তি ও পারমাণবিক শক্তিকে প্রথাগত নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করা হতো। স্নায়ুযুদ্ধের পর নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা কৌশল নতুন সংযোজন হয়েছে। যেখানে পণ্ডিতরা মানবিক সুরক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষার মতো আরও অনেক দিকগুলোতে নিরাপত্তা বলয় অন্তর্ভুক্ত করে নিরাপত্তা ধারণাকে আরও প্রশস্ত করা হয়েছে আর এই খাতের নিরাপত্তাকে অপ্রথাগত নিরাপত্তা বলা হয়।
নিরাপত্তা কোন স্থায়ী বিষয় নয় বা স্থায়ী কোন উপাদানের ওপর নির্ভর করা যায় না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সময় এবং ঘটনাবলী প্রমাণ করে দিয়েছে যে সুরক্ষা স্থির নয়; নিরাপত্তা হুমকির পরিবর্তিত প্রকৃতির সাথে এবং সুপ্ত বা আসন্ন ঝুঁকির মুখে বিকশিত হয়। যেমন পরিবেশগত নিরাপত্তাহীনতা, মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, সন্ত্রাসবাদ, জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তাহীনতা, সাইবার নিরাপত্তাহীনতা ও কোভিড-১৯ এর মতো মহামারি বর্তমান সময়ে আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য অপ্রচলিত সুরক্ষা হুমকি।
যদিও বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোর নিরাপত্তার কেন্দ্রবিন্দু তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিক শক্তি বাড়ানোর দিকে। প্রত্যেক রাষ্ট্র তাদের প্রথাগত নিরাপত্তা বা সামরিক খাতে অভাবনীয় ব্যয় বাড়লেও যখন কোভিড-১৯ এর মতো মহামারি মোকাবেলার জন্য ব্যয় বাড়ানো বা তেমন প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি।
যেসব রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক প্রযুক্তি যেমন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী যেখানে সর্বদা পারমাণবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে, যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানেও ভেন্টিলেটর এবং নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট ছিল না।
যদিও বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর ধরে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে জলবায়ু পরিবর্তন রোগের ভেক্টরদের পরিবর্ধনের মাধ্যমে মহামারির সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে। রাষ্ট্রের জাতীয় সুরক্ষার কেন্দ্রবিন্দু মানব সুরক্ষার বিষয়গুলোকে কখনোই যেরকম প্রাধান্য দেয়া দরকার ছিল তা দেয়া হয়নি যদিও ইতোপূর্বে অনেকগুলো মহামারির সম্মুখীন হয়েছে বিশ্ববাসী।
মানব সুরক্ষার বিষয়গুলোকে অবজ্ঞা করা চরম অজ্ঞতা এর ফলে জীবনের মূল্য যেরকম দিতে হয় অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হয় আরও অনেক বেশি। মানব সুরক্ষাকে এই অজ্ঞতার মূল্য এখন বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে চরম ধাক্কা, বিশ্বব্যাপী লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন এবং বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের মৃত্যু।
এই পরিসংখ্যানগুলো প্রকাশ করে যে অপ্রচলিত নিরাপত্তার হুমকিগুলো সরাসরি গতানুগতিক জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষতি করতে পারে না, তবে এর প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে প্রভাবিত করতে অনুঘটক হতে পারে।
ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য, জনসংখ্যার ঘনত্ব, মাইগ্রেশন, মানব বাস্তুচ্যুতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন উজানের কারণে আমরা আজ যে বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বাস করছি তা সংক্রমণমূলক সংক্রমণের মতো ঝুঁকি দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে যার ফলাফল আজকের কোভিড -১৯।
তাই রাষ্ট্রগুলো অপ্রচলিত সুরক্ষা হুমকির মোকাবেলা করা অপরিহার্য। এই হুমকির পরিণতি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য হবে আরও ক্ষতিকারক, যেখানে রয়েছে জনসংখ্যার ঘনত্ব, চিকিৎসা সুবিধার অভাব, দুর্বল অর্থনীতি, দুর্নীতি ও অসচেতনতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) এর মতে, বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে, সরকার স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোতে বেশি ব্যয় করছে না এবং সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষমতাও গত দুই দশকে হ্রাস পেয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ যেখানে বিশ্বব্যাপী গড জিডিপির ১০% থাকার কথা সেখানে বাংলাদেশে জিডিপির মাত্র ২% ব্যয় করছে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায়। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক সুরক্ষাও কঠিন, বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় বিশ্বব্যাপী গড় ১১% এর তুলনায় বাংলাদেশ ২% এরও কম। তদুপরি, সমস্ত সেক্টর এবং বিশেষত সরকারের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সহযোগিতারও অভাব রয়েছে। খাদ্য ও ব্যবসায়িক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের প্রচেষ্টাসহ বাংলাদেশ যদিও ৯৬ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
যাই হোক বাংলাদেশ সরকারের এই সমস্ত প্রচেষ্টা কোভিড-১৯ এর প্রভাবগুলো মোকাবেলা করতে প্রাথমিক উদ্যোগ। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন হবে পরিবেশ নিরাপত্তাহীনতা থেকে উদ্ভূত হুমকির মোকাবিলায় সক্রিয় কৌশল অবলম্বন করা যাতে দেশে দীর্ঘমেয়াদে মানবিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থানরত যে কোনও সরকারের পক্ষে বা ভবিষ্যতে কোভিড়-১৯ এর মতো মহামারি করা কঠিন নয় অসম্ভবও বটে। এখন সময় এসেছে যে প্রথাগত জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনাকে প্রাধান্য দেয়া যাতে অপ্রচলিত সুরক্ষা হুমকির মোকাবেলায় জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করা যায়। এই প্রয়োজনীয় খাতগুলো হলো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ, গবেষণা প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে এই সকল খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া।
করোনার ভাইরাসের উত্থানের আগে রাষ্ট্রগুলো সামরিক শক্তি এবং পারমাণবিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছিলো বা অনেকে এখনো করে যাচ্ছে। বিশ্বের নেতৃত্বের মনে এমন জায়গা ছিল না যে তারা এই ধরনের সংক্রমণের মুখোমুখি হবে।
চীনের উহান শহর থেকে শুরু করে এখন বিশ্বের বাকী অংশে মহামারিটি সামগ্রিক সুরক্ষার দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিয়েছে। এখন প্রতিটি দেশ একটি শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে যা সামরিক উপায় ব্যবহার করে বা তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে এবং ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব ব্যবহার করে পরাজিত করতে পারে না।
তবে, করোনার ভাইরাসজনিত মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং প্যারামেডিকসের প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে চীনে প্রথম এ ভাইরাস আবির্ভূত হওয়ার পর ছয় মাস কেটে গেছে, বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর নিরাময়ের উদ্ভাবনের জন্য দিন-রাত কাজ করছেন, তবে এখনও পরিপূর্ণতা পায়নি।
সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে এটি এক বা এক বছরের বেশি সময় নিতে পারে এমন কয়েকটি প্রতিবেদন রয়েছে।
ভাইরাসের ঘন ঘন প্রসারণ রোধ করতে, লকডাউনটি প্রাথমিক নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসাবে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ভাইরাস মোকাবেলা করার জন্য উন্নত বিশ্বেও কঠোর লকডাউন ছাড়া আর কোনও উপায় খুঁজে পাইনি। তাদের সমস্ত শক্তি এবং প্রভাব এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিরর্থক। তাই জাতীয় নিরাপত্তা চিন্তাধারায় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক উপায়, অস্ত্র, বাহিনী, আর্টিলারি ও পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন হয় না।
এটির জন্য টেকসই ব্যবস্থা, দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মী, পরীক্ষাগার, গবেষণা ও এক ঝাঁক মানবিক নাগরিক দরকার।
অন্যথায় এ করোনাভাইরাসের মতো ভাইরাস যে কোনও সময়ের মধ্যেই সমাজের গভীরে প্রবেশের ক্ষমতা রয়েছে এবং পৃথিবীকে ব্যাপক ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে।
সুতরাং, এই জাতীয় মানবিক ধ্বংস এড়ানোর জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রত্যেক জাতি আজ এ ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে। মহামারিজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী দেশগুলোকে ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্য খাতে মনোযোগ দিতে বাধ্য করেছে। এমনকি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ব্যাপক চাপের মধ্যে রয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে রোগীদের থাকার জন্য বিছানার অভাব ছিল ব্যাপক, উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকাতে ৭ লাখ ৭২ হাজার রোগীর প্রয়োজনের তুলনায় কেবল ২ লাখ ৭২ হাজার ভেন্টিলেটর রয়েছে। আবার ব্রিটেনের শ্বাসকষ্টের রোগীদের মোকাবেলা করার জন্য ২০ হাজার ভেন্টিলেটর প্রয়োজন থাকলেও এ তুলনায় মাত্র ৫ হাজার ৯ শ' ভেন্টিলেটর রয়েছে।
ইতালিতে প্রতিটি ভেন্টিলেটরের বিপরীতে চারজন শ্বাসকষ্টের রোগী রয়েছে। আর আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলির পরিস্থিতি আরও হতাশাজনক এবং ভয়াবহ। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা না-ই বললাম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য মাত্র ৮টি শয্যা রয়েছে, দেশের পুরো জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ৪৩২টি আইসিইউ বেড রয়েছে যার মধ্যে ১১০টি রাজধানীর বাইরে রয়েছে, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত আরও ৭৩৭ যুক্ত করার খবর শোনা গিয়েছে।
নিঃসন্দেহে, ইতিহাস ২০২০ সালকে এক নতুন ধরণের নিরাপত্তাহীনতার জন্য বিশ্ববাসী স্মরণ করবে যা পূর্ববর্তী সমস্তগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। এই মহামারিকে সামনে রেখে বিশ্ব নেতারা তাদের ভবিষ্যৎ কোন ধরনের জাতীয় নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া হবে বা দেওয়া উচিত তা চাইলে বুঝতে পারবেন।
অনেকেই আবার স্বাস্থ্য খাতের এ ধরনের বেহাল অবস্থার পরও নির্লজ্জভাবে স্বাস্থ্যসেবার প্রশংসা করা ও করোনা মোকাবেলায় তারা সফল বলে এ করুণ অবস্থার প্রশংসা শুরু করতে পারে। এরকম হলে হবে তাদের চরম বোকামি এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ভবিষ্যৎ হুমকি। আসলে স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণাকে জাতীয় প্রতিরক্ষার সমান গুরুত্ব দিয়ে এক্ষেত্রে মনোনিবেশ করা দরকার।
এ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর এগিয়ে আসা এবং দরিদ্র দেশগুলিকে সহায়তা করা তাদের প্রধান দায়িত্ব। স্বল্পোন্নত দেশগুলো অতি সামান্য অর্থনৈতিক সম্পদ, ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্য খাত এবং দুর্বল প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল কর্মীদের কারণে মহামারি দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। স্বাস্থ্য সঙ্কটের সময়ে তাদের চিকিৎসা সরঞ্জাম, তহবিল এবং নৈতিক সহায়তার গুরুতর প্রয়োজন।
এর সাথে দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিষয় যেমন দুর্নীতি রাজনীতিকীকরণ ও গণতান্ত্রিক মানসিকতা এবং বাহ্যিক দ্বন্দ্বগুলো স্বাস্থ্যের দুর্বল অবস্থার মতো বাস্তব সমস্যাগুলো থেকে তাদের মনোযোগ পরিবর্তন করতেও সমানভাবে দায়ী। তবে অবশ্যই তাদের বুঝতে হবে যে করোনার ভাইরাসের মত অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকি সকলের জন্য ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হবে। আর এজন্য বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
ড. মো. কামাল উদ্দিন: প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।