করোনাকালের অর্জন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-25 05:35:14

রূপ ও মাত্রাভেদে একেকটি দুর্যোগ একেক রকম। বন্যা, খড়া, ঝড়-তুফান এক রকম, মহামারি আরেক রকম। একেকটি দুর্যোগ একেকভাবে মানুষকে আঘাত করে। তাই একেকটি দুর্যোগে মানুষের প্রতিক্রিয়াও হয় একেক রকম। বর্তমানে মহামারি আঘাত হেনেছে পুরো দুনিয়া জুড়ে। পুরো দুনিয়ার মানুষই কমবেশি তাই একই রকমভাবে এই ভাইরাস মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছে। বাইরে বের না হওয়া, বের হলে মাস্ক পরে বের হওয়া, নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদিই মোটাদাগে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।

করোনা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আঘাত হেনেছে। চীনে প্রথম আঘাত হানার পর বাকি দেশগুলো চীনের নাজুক অবস্থাটা দেখতে পেয়েছে। ফলে ওই দেশগুলোতে এ ভাইরাস আঘাত হানার পর মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। আঘাত হানার অল্প ক'দিনের মধ্যেই সব দেশ লকডাউন হয়ে যায়। ফলে মানুষ খাদ্য ও অন্যান্য ভোগ্য পণ্য কেনার জন্য দোকানে ভিড় জমায়। সাধ্যমতো সবটুকু দিয়ে জিনিসপত্র কিনে বাসায় জমা করে রাখে। অপরের কথা কেউ ভাবেনি। সব দেশে প্রায় একই অবস্থা দেখা গেছে।

আমাদের দেশেও মানুষ বস্তা বস্তা চাল আর জিনিসপত্র কিনে গাড়ির পেছনে ভরে বাড়ি নিয়ে গেছে। আরেক জন খেতে পারবে কিনা সে চিন্তা করেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেই প্রবণতা কিছুটা কমেছে। এই করোনাকালে আমাদের দেশে একদিকে যেমন মানবিকতার বিপর্যয় দেখছি, তেমনি একই সঙ্গে দেখছি মানবিকতা জয়ের চিত্রও। একদিকে দেখেছি গরিব, নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষদের হাহাকার, অন্য দিকে অনেক মানুষই আজ একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে সব কিছুই নির্ভর করে মহামারির গতি প্রকৃতির ওপর। মহামারির অবস্থার উন্নতি হলে মানবিকতারও উন্নতি হয়। কিন্তু অবস্থা খারাপ হলে মানবিক বিপর্যয়ও নেমে আসতে পারে। কারণ, মানুষের কাছে নিজের জীবনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, আমাদের দেশে সে রকম মানবিক বিপর্যয় কখনোই যেন না আসে। মানুষ যেন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই এ বিপদ মোকাবিলা করতে পারে। এটাই মহামারির শিক্ষা। সবাই মিলেই বেঁচে থাকতে হয়। একা একা বেঁচে থাকা যায় না।

কোনো মহামারি মোকাবিলাই একা রাষ্ট্রের কাজ না। একা রাষ্ট্রের পক্ষে এই মহাযজ্ঞ সম্পাদন করা সম্ভবও না। সেই উপলব্ধি থেকেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু মানুষ চুরি করতে মাঠে নেমেছে। সরকার গরিবের সহায়তার জন্য রাষ্ট্রের গুদাম খুলে দিয়েছে, মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, আর ঐ চোররা সেই ত্রাণ চুরির জন্য ওতপেতে বসে আছে। সরকারি মাল, রাষ্ট্রের ধন চুরির করার জন্য একটি শ্রেণিই সমাজে থাকে। তারা সরকারি মাল লুটেপুটে খায়। কেউ পুকুর চুরি করে, কেউ সাগর চুরি করে। সরকারি গুদাম থেকে মাল খালাস করে সে মাল নিজের গুদামঘরে তোলে। এরা সব সময় অন্যের ধান নিজের গোলায় তুলতে চায়। এরা মানুষের কথাও ভাবে না, সরকারের কথাও ভাবে না। এর সরকারকে বিব্রত করে, বেকায়দায় ফেলে।

কৌটিল্য আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বলে গেছেন, ঠোঁটের আগায় যদি কারো মধু তুলে দেওয়া হয়, সে মধু চেটে দেখবে না, এমন সাধু ভূ–ভারতে মিলবে না। আমরা তাদেরই উত্তর পুরুষ। কাজেই আমাদেরও হয়েছে আজ সেই দশা। কিন্তু পার্থক্য শুধু আমাদের ঠোটের আগা পর্যন্ত আসা দরকার নেই, রাষ্ট্রে গুদাম থেকে, সিন্দুক থেকে মাল চুরি করতেও আমাদের কসুর নেই।

এ দেশে মানুষকে আইন মানানো খুব কঠিন। ট্রাফিক সিগনাল থাকলেও সেই সিগনাল মানাতে রাস্তার চার কোণে ছয় পুলিশ মোতায়েন করতে হয়। বাতির সিগনাল এক দিকে আর পুলিশের সিগনাল আরেকদিকে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রকে আইন করতে হয়, দণ্ড দিতে হয়। চোরের জন্য আইন আছে, চুরির জন্য দণ্ড আছে। আইনের প্রয়োগ দরকার। মানুষের এই মহাদুর্দিনে যারা মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় তারা কোনো সাধারণ চোর নয়। সব চোর এক নয়। এরা স্পেশাল চোর। তাই এদের জন্য সাজাটাও হওয়া চাই স্পেশাল।

শুধু আইনি সাজা দিয়ে এদের হবে না। এদের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সাজারও ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিকভাবে এদের ত্যাজ্য করতে হবে, ঘোষণা করতে হবে রাজনীতির ত্যাজ্যপুত্র। আইনি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সাজা দিয়ে ত্রাণ চোরদের প্রকৃতভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। সরকারকে একদিকে ভাইরাস মোকাবিলা করতে হচ্ছে অন্যদিকে চুরিও ঠেকাতে হচ্ছে। এ ভাইরাস হয়তো একদিন চলে যাবে। কিন্তু এই চোররা সমাজেই থেকে যাবে। তাই সমাজকেই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

কিন্তু এতো কঠিন সময়েও অনেকে গোপনে-প্রকাশ্যে যে যেভাবে পারছে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এটাও একটা বড় অর্জন। সবাই চুরি করে না। দুর্যোগে কেউ হয় আলিবাবা, কেউ হয় চল্লিশ চোর। এ সংকট একদিন কেটে যাবে। সংকটের বুকে একেকজন একেকভাবে নাম লিখে যাচ্ছে। এটাই থেকে যাবে। এ সংকটের দিনেও যারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, করোনাকালের এ এক বড় অর্জন।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর