বিরল ও আশা জাগানিয়া রমজানের সাক্ষী আমরা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-24 23:58:10

বিশ্বের ইতিহাসের নতুন এক বিষয়ের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা, বিরলতম ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে বিশ্ব। রমজানের রোজা ফরজ হয়েছে দ্বিতীয় হিজরি সনে। এখন চলছে হিজরি ১৪৪১। সে হিসেবে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছরে এমন ঘটনা ঘটেনি। যা এবারের রমজানে ঘটল। অনেকটা নিঃশব্দে, নীরবে, আয়োজনহীনভাবে রমজান মাস বরণ করতে হলো। এমন বেদনা-বিধুর ও দুঃসহ রমজান আগে কখনও দেখেননি ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা।

ইসলাম ধর্মের পাঁচ মূলস্তম্ভের একটি রোজা। রমজান মাসে যারা রোজা পালন করেন, তারা সুবেহ সাদিকের আগে আগে খাবার খেয়ে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকেন। রমজান মাসে মুসলিমরা শুধু খাদ্য ও পানি গ্রহণ করা থেকেই বিরত থাকে না, বিশেষ এই মাসটিতে তারা দৈনন্দিন জীবনাচরণের নানা অভ্যাসেও লাগাম টানেন, গরিব দুস্থদের মধ্যে দান-খয়রাত ও জাকাত দেন, তারাবির নামাজ আদায় করেন, ইফতার করেন, কোরআন তেলাওয়াত করেন। আচার-আচরণ থেকে শুরু করে পোষাকেও পরিবর্তন আনেন।

২০১৯ সালে পিউ রিসার্স সেন্টার পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বয়স বিবেচনায় প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলিমই রোজা রাখেন। রোজার মাসে পালনীয় অনেক ইবাদত সম্মিলিতভাবে আদায় করা হয়। তন্মধ্যে তারাবির নামাজ ও ইফতার আয়োজন অন্যতম।

বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব ব্যবস্থা। মহামারির কারণে অনেক দেশের মসজিদে জামাত-জুমা বন্ধ, কোথাও সীমিত। মক্কা-মদিনার দুই প্রধান মসজিদের কর্মসূচি সীমিত, উমরা বন্ধ; তাওয়াফ নিয়ন্ত্রিত। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় শরিয়তের বিধানের আলোকেই গৃহীত হয়েছে এসব সিদ্ধান্ত।

তারপরও পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম বিশ্ব রমজানকে স্বাগত জানিয়ে তারাবিসহ রমজানের বিশেষ ইবাদত-বন্দেগিতে মনোনিবেশ করেছে। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম তাদের ঐতিহ্য বাদ দিয়ে ঘরোয়াভাবে তারাবি আদায় করেছেন এবং আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন ছাড়া ঘরে ইফতার করবেন।

বাংলাদেশেও রহমত বরকত মাগফিরাত বা নাজাতের বার্তা নিয়ে এসেছে পবিত্র রমজান। করোনার প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে, মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্তের খবর শুনে শুনে ঘরবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে আমাদের। কিন্তু এমন সঙ্কটময় মুহূর্তেও বাংলাদেশে সৌভাগ্যের রমজানের আগমন। সৌভাগ্য এই কারণে যে আল্লাহতায়ালার অশেষ দয়ায় বৈশাখে প্রকৃতি রুদ্র না হয়ে সহনশীল হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে হওয়া বৃষ্টি আর ঝিরঝিরে বাতাস- এই সময়ে রোজাদারদের জন্য আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহই বটে।

করোনাজনিত আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে মসজিদে গমন, জামাতে নামাজ ও তারাবির জামাত হতে বিরত থাকতে হবে। প্রত্যেককে এসব আমল নিজ নিজ ঘরে পালন করতে হবে। ইফতারের বাহারি আয়োজন বন্ধ, শেষ দশকের ইতেকাফ করা যাবে না মসজিদে। যেহেতু ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে রমজান কাটাতে হবে, তাই রমজানের জন্য একটি পরিকল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান, এর একটি মুহূর্তও যেন নষ্ট না হয়- সেজন্য এই পরিকল্পনা।

রমজানের অন্যতম আমল তারাবির নামাজ। এদেশের তিন লক্ষাধিক মসজিদে এবার তারাবি হবে সীমিত আকারে। আর ৯৯ ভাগ নামাজি এ বছরের তারাবি পড়বেন নিজ নিজ পরিসরে। সরকারের নির্দেশনা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতি অনুসরণ করে। এতে নামাজ ও পবিত্র কোরআনের বরকত ছড়িয়ে যাবে ঘরে ঘরে। নামাজের বাইরের তেলাওয়াত ছাড়া এবার ঘরে ঘরে কোরআন খতম হবে। স্বভাবতই মানুষ বিপদের দিনে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করে, ঘরে সন্তানাদি, স্ত্রী, ভাইবোন, বাবা-মাকে নিয়ে পারিবারিক পরিসরে নামাজের আয়োজন- এটাও আল্লাহতায়ালার দয়া বিশেষ।

দরিদ্র, অভাবী ও শ্রমজীবী মানুষের পাশে আপনিও দাঁড়াতে পারেন, ছবি: সংগৃহীত

করোনার প্রভাবে দরিদ্র, অভাবী ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর দুর্দিন। তারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনপাত করছেন। এসব মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। সেই বিবেচনায় এবারের রমজান মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে ধরা দেবে গতানুগতিকতার বাইরে কোরআনে কারিমের প্রকৃত শিক্ষায়। করোনাকালের ছুটি পরবর্তী সময় থেকে সাধ্যমতো অভাবীদের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছেন সম্পদশালীরা; এবার রমজানে আরও বেশি পরিমাণে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করবেন তারা। যাতে দরিদ্রদের প্রয়োজন কিছুটা হলেও পূরণ হয়। কারণ পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা হলো- সচ্ছল কিংবা অসচ্ছল উভয় অবস্থায় দান করতে হবে।

বলা হয়, বিপদ একদিক দিয়ে রহমত। প্রতিটি মন্দেরই ভালো দিক থাকে। এ সময়ে সবচেয়ে বড় অর্জন হতে পারে বিপন্ন মানুষের সেবা করে আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করা। অভাবীর মুখের হাসিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, দান-সদকা ও জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে এটা করার চেষ্টা করা।

অন্যদিকে রোজা পালন করা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাই রোজাকে অর্থবহ করে তুলতে রমজানের শিক্ষা নিজের ভেতরে ধারণের পাশাপাশি কোরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞান লাভ করা, নামাজ নিয়মিত আদায় করা, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসায়ালা-মাসায়েলসহ ইসলামের সঠিক জ্ঞান লাভে সচেষ্ট হওয়া। ঘরে শুয়ে-বসে না থেকে, অহেতুক সময় নষ্ট না করে তাহাজ্জুদ আদায় ও বেশি বেশি দোয়ায় মনোনিবেশ করা।

হায়াত থাকলে আবার রমজান পাওয়া যাবে, কিন্তু এবারের রমজানের মতো আত্মিক উন্নয়নের সুযোগ আর পাওয়া যাবে কিনা- বলা মুশকিল। রোজার অন্যতম শিক্ষা সহনশীলতার উদাহরণ দেখানো যাবে কিনা সেটা বলার উপায় নেই।

তাই এই রমজানে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় আন্তরিকভাবে রোজা, নামাজ, তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মধ্যদিয়ে পালন করা। দোয়া-দরূদ, তওবা ও জিকির বেশি বেশি করা। দানের হাত বন্ধ না রাখা। ভালো কথা কিংবা হাসি দিয়ে হলেও মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করা। জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ তাকদিরের ওপর বিশ্বাস করে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ঈমান আস্থা ভরসা রেখে নিজ নিজ কর্তব্য করে যাওয়া। রমজানের আনুষ্ঠানিকতার অনেক কিছু নেই, তাতে কী? আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার, তার ভালোবাসা পাওয়ার রাস্তা তো বন্ধ হয়নি? আর আমাদের নামাজ, আমাদের রোজা, আমাদের ইবাদত- সবকিছু তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই। সুতরাং হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

ইসলাম শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়, এর মূল শিক্ষা হচ্ছে মানবতার উৎকর্ষ। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য আর মানুষসহ সকল সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা। পবিত্র রমজানে মুসলমানের জীবন-জীবিকার সর্বত্র সততা, সংযম ও পবিত্রতা রক্ষা করা। জীবনের সবক্ষেত্রে ইসলামের অনুসরণ, ইসলামের কোনো একটি মূল্যবোধকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য মূল্যবোধগুলোর ব্যাপারে উদাসীন না হওয়া ও এসবক্ষেত্রে চরমপন্থা বর্জন, নিয়মানুবর্তিতা এবং জ্ঞান-অর্জন, আত্মোন্নয়ন ও আত্মসংশোধনের পরিকল্পিত কর্মসূচি বজায় রাখাও রোজার শিক্ষা।

করোনার কারণে এবারের রমজানের অনেক আনুষ্ঠানিকতায় হয়তো কিছুটা ছেদ পড়বে, কিন্তু শুদ্ধচারিতা এবং সংযম সাধনার পরীক্ষায় করোনাভাইরাস মুসলমানের সৌভাগ্যকে ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না। বরং খাঁটি মুসলমান হিসেবে ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের আলোকে আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ! মানবজাতিকে আপনার ক্ষমা, করুণা ও অনুগ্রহে নতুন জীবনের সন্ধান দিন। মানুষের তৎপরতা বিবর্জিত এ ভীতিকর সময়কে আপনার কুদরত দ্বারা আমাদের জন্য লাভজনক ও উপকারী বানিয়ে দিন। বিপদের দিনে শুরু হওয়া পবিত্র রমজানের প্রারম্ভে এটাই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা।

মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর