ধানটা যেন ঠিক মতো গোলায় ওঠে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-30 11:32:28

বাংলাদেশের সুযোগ ছিল করোনা থেকে মুক্ত থাকার। বিমানবন্দরে যদি আমরা কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারতাম, প্রবাসীদের সঠিক ডাটাবেজ তৈরি করতে পারতাম; তাহলেই আমরা নিরাপদ থাকতে পারতাম। তার মানে নিজের পা দুটি ঢেকে দিলে ধুলার ভয়ে পুরো দেশ কর্দমাক্ত করতে হতো না। তারপর সঠিক সময়ে কঠোর লকডাউন আরোপ করতে পারলেও কমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকানো যেতো।

যেহেতু আমাদের দেশে মানুষ বেশি, ঘনবসতি। তাই ছড়িয়ে পড়ার আগেই বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। কিন্তু আমরা সাধারণ ছুটি দিলেও লকডাউন বা কারফিউ দেইনি। তাই মানুষও ছুটির আমেজে আরাম করেছে, বাড়ি গেছে, ছুটি পেয়ে প্রতিদিন বাজারে গেছে টাটকা খাবার খেতে। বিজিএমইএ গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে মেতে উঠেছিল। তাই

অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিনের পর দিন সাধারণ ছুটি চালিয়ে গেলেও তার পুরো ফায়দা আমরা তুলতে পারিনি। বরং বারবার আমাদের ভুলে কমিউনিটি সংক্রমণ বেড়েছে।

তবে গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খেলাফত মজলিশের নায়েবে আমির আল্লামা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় লক্ষাধিক লোকের সমাগমের পর আমি আসলে করোনা নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর আমি কোনো আশা দেখি না। সাধারণ ছুটি দেয়া না দেয়ায় আর কিছু যায় আসে না। যারা বিশ্বাস করে, রাখে আল্লাহ মারে কে, তাদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। আমি বুঝে গেছি, করোনার বিস্তৃতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই। এখন যার সামর্থ্য সে বাঁচবে, দুর্বলরা মরবে।

করোনা নিয়ে নয়, আমার এখন সব ভাবনা করোনা পরবর্তী সময় নিয়ে। মাসের পর মাস অর্থনীতির চাকা অচল থাকলে করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়েই ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা প্রকট হবে। দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষও। কেউ কেউ এমন শঙ্কাও করছেন, করোনা যত লোক মারা যাবে, দুর্ভিক্ষে মারা যেতে পারে তারচেয়েও বেশি। অনেকের হাতে খাবার কেনার টাকা থাকবে না। এমনও হতে পারে, টাকা থাকবে কিন্তু খাবার থাকবে না। নিজেদের খাবার নিজেদেরই উৎপাদন করে নিতে হবে। সামনে হয়তো কোনো দেশ জরুরি খাদ্য পণ্য বিক্রিও করবে না। অন্য দেশের কথা জানি না, আমি শুধু বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তিত।

খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে করোনার প্রভাবে শস্য উৎপাদনও কম হবে। তাই যেটুকু উৎপাদন হবে, তার পুরোটাই নির্বিঘ্নে ঘরে তুলতে পারাটা খুব জরুরি। খাদ্য শস্যের মধ্যে ধানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত চাল থাকলে আলু ভর্তা দিয়ে, ডিম ভাজি দিয়ে, আর কিছু না পেলে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ভাত খেয়েও বেঁচে থাকা সম্ভব। দুর্ভিক্ষের সময় ভাতের মাড়ও মহার্ঘ্য হয়ে যায়। সামনের দিনগুলোতে দু বেলা দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করার এখনই সময়।

এখন চলছে বোরো ধান কাটার মৌসুম। বোরো হলো আমাদের অন্যতম প্রধান ধান। সারাদেশে চাহিদার অন্তত ৩০ ভাগ আসে বোরো থেকে। আর বোরোর অন্তত ২০ ভাগ আসে হাওর এলাকা থেকে। হাওরাঞ্চলসহ দেশের বিস্তৃত এলাকায় এখন দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। পাকা ধানের ক্ষেতে বাতাসে যখন ঢেউ তোলে, সোনালী সমুদ্র যেন। এই ধান আমাদের আশাবাদী করে। কৃষকের মুখে হাসি ফোটায়।

কিন্তু এবার তাদের মুখে শঙ্কার কালো মেঘ- এত ধান কাটবে কে? সাধারণত বোরো মৌসুমে দেশের অন্য এলাকা থেকে শ্রমিকরা হাওর এলাকায় আসে। কিন্তু এবার সাধারণ ছুটির কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিক পরিবহনে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। তবে আশার কথা হলো, সমস্যাটি আগে থেকেই নজরে ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।

ধান কাটা শ্রমিকদের নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কৃষকের পাশে

দাঁড়াতে বলেছেন। অন্য জেলা থেকে পর্যাপ্ত ধান কাটা শ্রমিক আসতে না পারলেও সব জেলাতেই এখন বাসায় বসে থাকা অন্য কাজের শ্রমিক আছে। তাদের সবাইকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিক সংকট সামাল দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজনে শ্রমিকদের বাড়তি প্রণোদনা দিতে হবে। ধান এমন একটি ফসল, পাকার পরে মাঠে ফেলে রাখার সুযোগ নেই। একবার ঝরে গেলে আর কিছু করার নেই। আর হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যার আশঙ্কা আছে। তাই দ্রুতই ক্ষেতের ধান গোলায় তুলে ফেলতে হবে।

সরকারি দল এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের আমরা নানান সময়ে গালি দেই। ন্যায্য কারণেই দেই। কিন্তু এবার তারা সত্যিকার অর্থেই কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

নিছক ফটোসেশন বা লোক দেখানো নয়, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগের কর্মীরা ধান কাটা থেকে শুরু করে গোলায় তোলা পর্যন্ত কৃষকের পাশেই থাকছে। ধান কাটায় সহায়তা করতে কৃষক লীগ হটলাইন চালু করেছে।

তবে ধান কাটার শ্রমিক হোক, কৃষক হোক, ছাত্রলীগ হোক, কৃষক লীগ হোক; সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সবাই যেন শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করে কাজ করেন তা নিশ্চিত করতে হবে। সবার জন্য পর্যাপ্ত সাবান, হ্যান্ড

স্যানিটাইজারের সরবরাহ রাখতে। মনে রাখতে কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। ধান বাঁচলে আপনি বাঁচবেন।

আগাম বন্যার আশঙ্কা হাওর অঞ্চলে ধান রোপণ করা হয় আগে, পাকেও আগে। হাওর এলাকায় অধিকাংশ জমি এক ফসলী। তাই বোরোর ওপরই তাদের নির্ভর করতে হয়। তবে হাওর অঞ্চলের ধান কাটা শেষ হলে নজর দিতে হবে দেশের অন্য অঞ্চলের দিকেও।

বোরোটা ঠিকমত গোলায় তুলতে পারলে এবং দাম ঠিকমত পেলে এই কৃষকরাই আমনে মন দেবে। এই দামের বিষয়টাও কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে। প্রতিবছর ধান কাটার মৌসুম এলে শুরু হয় কৃষকের হাহাকার। গত দুই বছর ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে এবার বোরো ধান কম চাষ করেছে কৃষক। এবার যেন সেটা না হয়। সরকার যে ধান চাল কেনে তার সুবিধাটা যেন কৃষকের পকেটে যায়।

বোরো ধানটা যদি আমরা ঠিক মতো গোলায় তুলতে পারি, যদি বেঁচে থাকি, অন্তত না খেয়ে মরার ভয় থাকবে না।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর