ত্রাণ চোরদের থেকে পরিত্রাণ চাই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-09-01 12:39:28

লেখাটি যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশে করোনা রোগী দিন দিন ধীর গতিতে বাড়ছে। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাও বাড়ছে। বৈশ্বিক মহামারি, মহাদূর্যোগ কিংবা মহান আল্লাহর গজব-যে নামেই করোনাকে ডাকি না কেন; অন্তত এ কথা সত্য যে পৃথিবীর মানুষ এমন ক্রান্তিকাল তাদের জীবদ্দশায় আর দ্বিতীয়বার দেখেনি। সত্যিই পৃথিবী আবার আগের মত হবে কি না বা হলেও কবে হবে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শেষ নেই।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে যার মত গুজব কিংবা আজগুবি সব তথ্য ছড়ায়। আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরাসহ তার সাথে আরো যারা প্রতিদিন নিয়ম করে করোনার সংক্রমণ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তথ্য গণমাধ্যমকে জানান, মানুষ তাদের কাজের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে সেব্রিনা ফ্লোরার শাড়ি নিয়ে সমালোচনা করছেন। এই মহামারি দুর্যোগের মধ্যেও ত্রাণের চাল নিয়ে নয়-ছয়, সরকারি ত্রাণের বস্তায় নিজের ছবি ছাপিয়ে দিয়ে বাহবা নেওয়ার কি অমানবিক প্রচেষ্টা কিছু কিছু মানুষের মধ্যে স্পষ্টত দৃশ্যমান। মানুষের এই মনুষ্যত্ববোধহীনতার চর্চা কি চলতেই থাকবে?

দুই.
সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বারবার চোখের সামনে ‘দিন আনে দিন খায়’ এমন খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের দৃশ্যপট চোখে ভাসছে। রিকশা-ভ্যান চালক, অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাওয়া গৃহ পরিচারক-পরিচারিকা, শ্রমিক, মজুর, দরিদ্র, সমুদ্রতীরবর্তী জনগোষ্ঠী, চা শ্রমিক, হত দরিদ্র কৃষক প্রভৃতি নানা শ্রেণি-পেশার অসহায় মানুষ খাদ্য ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছেন। যাদের চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাবার কথা নয়। সর্বশেষ পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের সাথে ‘মজুরি-দাসত্ব’ নিয়ে মালিকদের শোষণ ও নিপীড়ন কার্ল মার্কসের তত্ত্বকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। বেশ কিছু মালিকের কর্মকাণ্ড সত্যিই অবাক করেছে। বেতন দেবে বলে বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটিয়ে ডেকে এনে ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় বন্দী দশার মধ্যে ফেলে দেওয়ার এক অমানবিক নাটক মঞ্চস্থ হলো। পোশাক শ্রমিককে ‘মজুরি-দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষ হিসেবে গণ্য করার সংস্কৃতি’ চালু না হলে ‘মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও উন্নয়নের বাংলাদেশ’ সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে।

তিন.
মানবতার এই ক্রান্তিকালে চিকিৎসক, নার্স, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিগণ যেভাবে আর্ত মানবতার সেবায় নিজেদেরকে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন তার সব কিছুর প্রতিদান সরকার স্বাস্থ্যবীমাসহ আর যা দিক না কেন স্বয়ং আল্লাহ দিবেন তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তবে,অনেক অঞ্চল থেকে খবর পাওয়া গেছে কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্স হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে করোনা রোগী সন্দেহে সাধারণ রোগীদের সেবা দিচ্ছেন না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্সদের নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্য সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে সরাসরি জড়িত জনবলই শুধু ‘পার্সোনাল প্রটেকশন ইক্যুইপমেন্ট’ (পিপিই)ও অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী ব্যবহার করতে পারবেন। এমনকি প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি যারা মাঠ পর্যায়ে রয়েছেন তাদেরও প্রয়োজন না থাকলে পিপিই পরিধান করা নিষেধ। কাজেই চিকিৎসক ও নার্সদেরকে মানবতার এই দু:সময়ে রোগীদের পাশে দেবদূত হয়ে দাঁড়াতে হবে।

চার.
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে যেভাবে ছড়িয়েছে এবং তার মরণ কামড় দিয়েছে, তাতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে। যাদের অনেকের শরীরে করোনা সেভাবে প্রকাশও পাচ্ছে না। ভাইরাসটি যখন চীনে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, তখনও পৃথিবীর অনেক দেশ সচেতন হয়নি।

চীনের স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা বা কাঠামো কাছ থেকে যা দেখেছি, তাতে অন্তত এতটুকু বুঝেছি যে, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ না করতে পারায় চীনের যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, তাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্ষয়-ক্ষতি কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। এ পর্যন্ত মোট বিশ (২০) বার করোনা ভাইরাসটি তার রূপ পরিবর্তন করার কারণে ‘গরমে সংক্রমণ কম হয়’, কিংবা ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে করোনা ছড়ায় কম’-এ জাতীয় ধারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে ভাবার পাশাপাশি প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সতর্কতা করোনা সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি বাহ্যত কমিয়ে আনতে পারে। সময় এখন প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতকে যে কোন দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সচল ও সক্রিয় করা। কেননা এটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে মজবুত করার পাশাপাশি জাতীয় স্বাস্থ্য খাতকে টেকসই করে।

করোনা প্রতিকারে সরকারের প্রচেষ্টাও দিন দিন বাড়ছে যা আগের তুলনায় প্রশংসনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেকটা নিয়ম করেই তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে সার্বিক দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায় এবং এমনকি প্রয়োজনে প্রত্যন্ত অঞ্চল ভিত্তিক খোঁজ-খবর প্রায় প্রতিদিন নিচ্ছেন। সম্ভব হলে প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাইরে সরকারের অন্য মন্ত্রীদের করোনার ব্যাপারে অনর্থক কোন কথা-বার্তা না বলাই ভালো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থা করা যেন কেউ গুজব ছড়াতে না পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময়কালে এখনো যখন শুনি ত্রাণের পণ্য নিয়ে একদল লোভী ও নিষ্ঠুর মানুষ তার লোলুপ দৃষ্টি ও কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না, তখন মনে হয় মানুষগুলো আর কবে ‘মানুষ’ হবে? কিছুদিন আগেও যে পৃথিবীতে আমরা ছিলাম, আর সামনে আমাদের জন্য যে পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে, তার ব্যাপারে আমরা কেউ কিছু জানি না। অথচ এখনো লোভ কিছু মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে, যেখান থেকে তাদের কঠিন শাস্তি ব্যতীত মুক্তি মিলবে না। সত্যি যদি লোলুপতা থেকে তাদের মুক্তি না আসে তবে তাদেরকে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য পরিষেবা বিষয়ক পিএইচডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ

এ সম্পর্কিত আরও খবর