উগ্র ইমেজের ট্রাম্পের জয়ধ্বনি!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসেসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-11-07 15:33:01

কয়েক মাস ধরে কমলা হ্যারিস সম্পর্কে বর্ণবাদী মন্তব্য, সীমান্তে আক্রমণ এবং লক্ষ লক্ষ অভিবাসীর ক্ষতি করার হুমকি দেওয়ার পরেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক সমর্থনের কোনও ক্ষতি হয় নি। একরোখা, উগ্র ইমেজের জয়ধ্বজায় আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন তিনি। তার নগ্ন বর্ণবাদ ও দুর্ব্যবহার এবং তার রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর আক্রমণের মানসিকতা সত্ত্বেও আমেরিকান জনগণ তাকে হোয়াইট হাউসে ফেরত পাঠাতে বেছে নিয়েছেন।

আমেরিকার ভোটে প্রার্থীরা তাদের প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে জনগণের সামনে তাদের চূড়ান্ত অভিমত তুলে ধরেন। তারা এমন কথা বলেন, যা ব্যালটপেপার হাতে ভোটারদের মনে থাকবে। ট্রাম্প চেয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ আমেরিকানকে তার প্রচারণায় 'ধর্মান্ধতার একটি কোলাহল' শোনাতে। মানুষ তার কথা শুনেছে। তার যাবতীয় অসঙ্গতিকে মেনে নিয়েছে। দেশের ভার তার হাতে তুলে দিয়েছে।

ট্রাম্প নিউইয়র্ক সিটিতে একটি সমাবেশের আয়োজন করতে এমন কিছু বিষয় বেছে নিয়েছিলেন, যা সেখানে ৮৫ বছর আগে অনুষ্ঠিত নাৎসি সমাবেশের বীভৎস স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি তার নিজের শহরেও হাজার হাজার ভক্তের সামনে কথা বলেছেন দক্ষিণ পন্থার কণ্ঠস্বরে। আশ্চর্য, এসবের কিছুই তার জয়কে আটকে দেওয়ার বদলে তাকে বিজয়ীর আসনে বসিয়েছে।

ট্রাম্প বাজিমাৎ করেছেন 'সুইং স্টেট’ বা ‘ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেট’-এ। আমেরিকার ভোট-রাজনীতিতে ‘সুইং স্টেট’ বা ‘ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেট’ নামে পরিচিত সাত প্রদেশের ফলাফল নিয়ে কৌতূহলী ছিল গোটা বিশ্ব। কারণ এগুলোর ফলের উপরেই নির্ভর করছিল, হোয়াইট হাউসে কে প্রবেশাধিকার পেতে চলেছেন। এমন সাতটি প্রদেশের ফলাফল ট্রাম্পের পক্ষে চলে আসে। ফলে কোনও অঘটন ছাড়াই জাদুসংখ্যা ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটের মার্জিন ক্রস করেন তিনি।

ট্রাম্প বারবার সুইং স্টেটগুলোতে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যে রাজ্যগুলোর কথা কেউ কখনও শোনেনি, তিনি শুনতে এসেছেন। লোকেদের তিনি তথাকথিত শত্রুর কাল্পনিক আক্রমণের ভয় দেখিয়েছেন। ক্রমাগত সতর্ক করে করে তিনি মানুষকে ভয়ের আবহে হিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ডানপন্থী জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছিলেন ভোটারদের মধ্যে। এই বলে গুজব পুনরাবৃত্তি করেছিলেন যে, ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের দ্বারা রাজ্যগুলো দখল করা হয়েছিল। তার কৌশল কাজে লেগেছে।

তিনি তার প্রচারাভিযান সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্ণবাদী মেমস পোস্ট করেছেন। বলেছেন, কমলা হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার অর্থ হ'ল কালো লোকদের দল আপনার আশেপাশে চলে আসবে। তিনি বলেছিলেন, যে কোনও ইহুদি ব্যক্তি যিনি তাকে ভোট দিচ্ছেন না তাদের মাথা পরীক্ষা করা দরকার। ট্রাম্প বারবার বলেছিলেন, ভোটে তারই জয়ী হওয়া উচিত। কারণ, সীমান্তে আসা অভিবাসীরা "কালো চাকরি" নিচ্ছে। তিনি এসব ঠেকাবেন।

ট্রাম্প তার প্রচারের সুর বেঁধেছিলেন ‘আমেরিকা প্রথম’ এবং ‘আমেরিকাকে ফের শ্রেষ্ঠ করে তোলো’— এই দুই স্লোগানের উপর ভর করে। ২০১৬ এবং ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও উগ্র জাতীয়তাবাদী এই ভাষ্য এব‌ং স্লোগানের উপর ভর করে প্রচার সেরেছিলেন ট্রাম্প। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হল না।

খুব বড় অঘটন না ঘটলে আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হতে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর বুধবারই ফ্লোরিডার পাম বিচে প্রথম বিজয়-ভাষণ দিলেন তিনি। তার বক্তব্যের সিংহভাগ জুড়ে ছিল, আমেরিকাকে জগৎসভায় ফের শ্রেষ্ঠ করে তোলার আশ্বাস। ট্রাম্পের সঙ্গেই মঞ্চে উঠেছিলেন তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প এবং পরিবারের অন্য সদস্যেরা। ছিলেন আমেরিকার সম্ভাব্য হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও।

মঞ্চে উঠেই ‘বিপুল জয়ের’ জন্য আমেরিকাবাসীকে ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প। বলেন, “সমালোচকদের ভুল প্রমাণিত করে আমরা জয়ী হতে চলেছি। আমেরিকা অভূতপূর্ব এবং শক্তিশালী রায় দিয়েছে।” তার পরেই ফের ‘আমেরিকাকে আবার শ্রেষ্ঠ করব’ স্লোগানটি দেন ট্রাম্প। ট্রাম্প যখন ভাষণ দিচ্ছেন, তখন তার সমর্থকেরা একনাগাড়ে ‘আমেরিকা-আমেরিকা’ স্লোগান দিতে থাকেন। ট্রাম্প উদ্বেলিত সেই সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, “সব সমস্যার সমাধান করব। আমরা আবার আমেরিকার সোনালি যুগ ফিরিয়ে আনব।”

ভোটপ্রচারে আমেরিকায় অনুপ্রবেশ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বারের জন্য হোয়াইট হাউসে ঢোকার আগে বুধবার বিজয়-ভাষণের মঞ্চ থেকেও ট্রাম্প বলেন, “আমরা সীমান্ত বন্ধ করব। অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হবে।” নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে জানিয়ে খানিক আবেগতাড়িত হয়েই ট্রাম্প বলেন, “আমি প্রতিটি দিন আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য এবং আপনার ভবিষ্যতের জন্য লড়়াই করব। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমি আপনাদের হয়ে লড়াই করব।”

উগ্র ও একরোখা ট্রাম্প যে জাতীয়তাবাদী বলয় তৈরি করে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে সফল হয়েছেন, তাতে বর্ণবাদ আছে, জাতি বিদ্বেষ আছে, অভিবাসী বিদ্বেষ আছে, নারী বিদ্বেষও আছে। বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক বর্ণালীর আমেরিকা তার মতো রাজনৈতিক চরিত্রের নেতৃত্বে কোনও পথে চলে এবং স্বদেশে ও বিশ্বে কেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর