সরকার পতনের তিন দিনের মাথায় নতুন সরকার পেল বাংলাদেশ। বিশ্বের সকল দেশই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। চীনও সমর্থন দিয়েছে। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেছেন, আমি আজকে সকালে (৯ আগস্ট) এখানে এসেছি। বৈঠক করেছি বিএনপির সঙ্গে। আপনারা জানেন গতকাল রাতে (৮ আগস্ট) ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার গঠন হয়েছে। এতে জাতিংঘের গুরুত্ব ভূমিকা রয়েছে, আমরা এই সরকারকে সমর্থন করেছি।
দেশের মধ্যেও শুভেচ্ছার ঢেউ বইছে। আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারী ১৪ দলীয় জোট ছাড়া বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি প্রায়-সকল রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছে নতুন সরকারকে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা অভিনন্দন জানিয়েছে। বলা যেতে পারে যে, একটি বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির পর দেশে-বিদেশের সকলের সম্মতিতে গঠিত হয়েছে নতুন সরকার। মজার বিষয় হলো, অতীতের কোনও নির্বাচিত সরকারও ভঙ্গুর গণতন্ত্র আর বিতর্কিত নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে সর্বমহলের এতো সমর্থন ও শুভেচ্ছা পায়নি, যা পেয়েছে এই নতুন সরকার।
ফলে এই সরকারের প্রতি মানুষের আশা ও প্রত্যাশা স্বাভাবিক কারণেই অনেক বেশি। ব্যক্তি-মানুষের প্রত্যাশা মূলত আবর্তিত হচ্ছে সুশাসন, সু-অর্থনীতি এবং ঘুষ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থার অবসান কামনার মতো জরুরি ও মৌলিক বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে। তাছাড়া, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার পুননির্মাণ এই সরকারের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এসব তাৎক্ষণিক ও জরুরি প্রত্যাশা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের কাছে দেশ শাসনের ভার তুলে দেওয়ার দায়িত্বও এই সরকারকে নিতে হবে।
নিশ্চয় এসব কাজ সম্পন্ন করা সহজ ও মসৃণ হবে না। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক ভাবে বিভাজিত ও সংঘাত-স্পর্শকাতর দেশে তা আরও কঠিন। সেই কঠিন কাজকে আরও দুরূহ করতে পারে অদক্ষ ও দলীয় ভাবাপন্ন প্রশাসন। কাজের বদলে অনেকেই এখন মহাসমারোহে আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি বা আওয়ামী-বিরোধী সাজার ইঁদুর দৌড়ে লিপ্ত। আর সেটা সচিবালয় থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এমনকি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তথা ইউনিয়ন পরিষদ হয়ে হাট, বাজার, গুদারা ঘাট, বাসস্ট্যান্ড, আড়ৎ ইত্যাদি আর্থিক লাভজনক ক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে।
(আমার বাসার কাছে বড় রাস্তার মোড়ে আওয়ামী লীগে একটি অস্থায়ী অফিস রাতারাতি বিএনপির অফিসে পরিণত করে আগের লোকগুলোকেই অম্লান বদনে বসে থাকতে দেখলাম। এরা আগে রিকশা, টেম্পু, সবজিওয়ালা, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নিও। ভবিষ্যতে একই কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যন্ত এরাই রয়েছে সিন্ডিকেটের মতো বহাল তবিয়তে।)
অতএব, নতুন সরকারের সামনে অপেক্ষা করছে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। আশাবাদী ড. ইউনূস ও তাঁর উপদেষ্টাগণ 'দুস্তর পারাবার' দেখে মোটেও থমকে যাবেন না। সেটা অতিক্রমণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন তারা। তবে, একটি চরম সঙ্কুল ও রক্তাক্ত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়ার ফলে তাদেরকে চেষ্টা ও দক্ষতার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই সাহসের পরিচয়ও দিতে হবে। বিশেষ করে, সুশাসন ও জনকল্যাণের প্রশ্নে তাদেরকে মোটেও আপস করার সুযোগ থাকবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কঠিন ও সাহসিক পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, ব্যাংকিং, বাজার ব্যবস্থা, সিন্ডিকেট-মাফিয়া, আইন-শৃঙ্খলা, মিডিয়া ইত্যাদির সংস্কারের মাধ্যমে আগাছামুক্ত (পড়ুন দুর্নীতি ও অসাধুতা মুক্ত) করার বিষয়েও তাদেরকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
দীর্ঘদিনের দলীয় শাসনে একদিকে যেমন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে, তেমনিভাবে তাবেদার, চাটুকার, তেলবাজ, মোসাহেব গোষ্ঠীরও চরম বিকাশ হয়েছে। তারা যে দলবদল করে নতুন সরকারকে ঘিরে ধরবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
তাজা আরেকটি উপরের পর্যায়ের উদাহরণ হলো, ব্যাংক মালিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বলছেন, চাপের মুখে তারা আগের সরকারের বৈধ-অবৈধ কাজের সমর্থক ও সহযোগী হয়েছিলেন।
একই কথা যদি আমলা, প্রশাসক, উপাচার্য, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তথা সকল পেশাজীবী ও কর্মচারীরা বলতে শুরু করে নতুন সরকারের অনুগ্রহভাজন হতে চান, তাহলে এই অসৎ স্রোত নতুন সরকারের বারোটা বাজিয়ে দেবে। তাদেরকে দলবাজি, তেলবাজি না করে নিজের কাজটি ঠিক ঠিক মতো করার উপযুক্ত শিক্ষা যদি সরকার দিতে পারে, তাহলে অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি হ্রাস পেয়ে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বেড়ে সুশাসন নিশ্চিত হবে।
'দুস্তর পারাবার' বা কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া মানে এসব অসঙ্গতি বা দীর্ঘ বছরে যে পরজীবীরা রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজের নানা স্তরে রক্ত চুষছে, সেগুলোকে ঝেঁটাপেটা করাকেও বুঝতে হবে। দলীয় অন্ধত্বের কারণে অতীতে এসব উচ্ছেদ না করে পরিচর্যা করা হয়েছে। নতুন সরকারকে তেমন পক্ষপাত দেখানোর কারণ নেই। বরং এদের প্রতি কোমল হলে পরিবর্তনের নামে একই বিষয় পুনরাবৃত্তি হওয়াই আশঙ্কা থাকবে। একজন কাজের মানুষ ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমলা, প্রশাসকরা গাড়ি, বাড়ি, সুযোগ, সুবিধায় 'মিনি মুঘল' হয়েই যদি থেকে যায় এবং মাঠে-ময়দানে মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ না করে, তাহলে জনতার সকল স্বপ্ন নস্যাৎ হয়ে যাবে। শীর্ষ থেকে শেকড় পর্যন্ত যদি মাস্তান, মাফিয়া, সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য চালায়, তাহলে জনতা স্বস্তি পাবে কেমন করে? জনস্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী যাবতীয় বিষয়াদি এই সরকারেই সমূলে উৎখাত করে নিজেদের সাফল্য নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৭টি মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখে উপদেষ্টাদের মধ্যে আরও ১৮টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দিকে আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারা দেশ, সারা বিশ্ব, জনতা। সকলের আশা পূরণে তারা সফল হোন, এ কামনা করি।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।