শ্রাবণের মেঘকাটা আলো ঝলমলে সকালটায় মোটেও টের পাওয়া যায়নি দিনটি এতটা রক্তাক্ত হবে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রোববার দেশজুড়ে অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা এসেছিল গত শনিবার। অসহযোগ একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ধরন। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে অসহযোগ কর্মসূচি পালনের যে চরিত্র আমরা দেখেছি, তার সঙ্গে রোববারের (৪ আগস্ট, ২০২৪) কর্মসূচির সামান্যতম মিল আমরা খুঁজে পেলাম না।
এই কর্মসূচিকে ঘিরে দিনভর ভয়াবহ এক নৈরাজ্য ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সারা দেশে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়েও সংঘর্ষ সংঘাত হয়। তাতে ২৬ জন প্রাণ হারায়। কিন্তু দিন শেষে সবশেষ খবর আসে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ১৩ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর সবমিলিয়ে নিহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। দেশজুড়ে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছেন কয়েকশ’ মানুষ।
ফলে নিঃসন্দেহে বলা যায় অসহযোগ আন্দোলন নয়, দিনভর চলেছে সহিংস সন্ত্রাসের আন্দোলন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবারও দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারিসহ আগামী তিন দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে।
গণমাধ্যমের খবরে আমরা এও জেনেছি, আন্দোলনকারীরা ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পটভূমিতে দাঁড়িয়েও তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি একদিন এগিয়ে সোমবারে ‘মার্চ টু ঢাকা’ অব্যাহত রেখেছে। এদিকে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এই আন্দোলনে ‘ছাত্রদের অংশগ্রহণ আর নেই’ এবং সন্ত্রাসী-জঙ্গীদের হাতে আন্দোলনটি বেহাত হওয়ার দাবি করে যেকোন মূল্যে একে প্রতিহত করার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নাশকতা দমনে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। রাতে ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছে, কারফিউ জারির পর যারা আর পথে নামবে, অরাজকতা করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।
আমার প্রশ্ন অসহযোগ আন্দোলনকে ঘিরে। দেশে রোববার ঘটে যাওয়া নৈরাজ্যকর এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে দিন পার করার পর প্রশ্ন উঠেছে, চলমান এই আন্দোলনে ‘অসহযোগ’ চরিত্রটি কোথায় টিকে আছে?
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে যে অসহযোগ আন্দোলন ছিলো তার মধ্যেও কোনো জঙ্গিপনা ছিলো না। জ্বালাও পোড়াওয়ের উষ্কানি ছিলো না। ছিলো বর্জনের শক্তি। আরও পরে মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশের জন্য লড়েছেন তখনও তারা এতদাঞ্চলের সম্পদ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেননি। তারা ততটুকুই করেছেন যা করলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য যুদ্ধ পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন জ্বালাও পোড়াও যা হয়েছে তা পাকিস্তানিরাই করে গেছে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর। অথচ রোববার আমরা দেখেছি আন্দোলনকারীরা জ্বালিয়ে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন। গাড়ি ভাঙচুর চালিয়েছে।
যদি এই অঞ্চলের আরও পেছনের একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করি, তা থেকেও চলমান এই পরিস্থিতির খানিকটা মূল্যায়ন করতে পারব। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে চলমান এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে সৃষ্ট বহু জিজ্ঞাসায় ঐতিহাসিক সেই ঘটনাটি সহায়ক হতে পারে।
বলছিলাম, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ঐতিহাসিক ‘চৌরিচৌরা’র অসহযোগ আন্দোলনের কথা। সেই ঘটনার আগে থেকেই ভারতজুড়ে দাঁনা বেধেছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরি-চৌরায় মাংসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে স্থানীয়রা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, ২ ফেব্রুয়ারি স্থানীয়দের আন্দোলনে ব্রিটিশ পুলিশ নির্বিচার প্রহার করে এবং তাদের কয়েকজন নেতাকে কারাগারে নিয়ে যায়।
এর প্রতিবাদে ২ দিন পর ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে চৌরিচৌরা বাজারে প্রতিবাদকারীরা গেলে সেখানেও তাদের নেতাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা বৃহৎ জমায়েত করে এবং পুলিশের উপর মারমূখি হয়। সেদিন পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে ৩ জন আন্দোলনকারী নিহত হন। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা থানা জ্বালিয়ে দেয় এবং ২৩ জন পুলিশ সদস্য পুড়ে মারা যান। সেই ঘটনায় দেশজুড়ে থমথমে হয়ে উঠে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারও নড়েচড়ে বসেন। আন্দোলনে হিংসার প্রয়োগে মর্মাহত মহাত্মা গান্ধী সঙ্গে সঙ্গেই অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।
নিঃসন্দেহে এটি শতাব্দি প্রাচীন ঘটনা। আমরা পরবর্তী সময়ে; বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলন-কর্মসূচিতে এই ঘটনার ছাপ লক্ষ্য করব। বিগত দিনগুলোতে দেশের অনেক প্রবীণ রাজনীতিক ও ঐতিহাসিকগণ আড্ডা-আলোচনায় অন্তত একথা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন যে, গণতান্ত্রিক যে কোন আন্দোলন যতক্ষণ শান্তিপূর্ণ ততদিনই সফল। যখনই তা সহিংস হয়ে উঠে তখন তা আর কিছুতেই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থাকে না। অসহযোগ তো নয়-ই। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম, জুলাইয়ে (২০২৪) শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলন কিভাবে একটি ভয়ংকর সহিংস আন্দোলনে পরিণত হল। পরিণতিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এবং রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র আমাদের দেখতে হল।
কিন্তু আন্দোলনকারীদের অনেক দাবি পূরণ করলেও কিভাবে পটভূমি পরিবর্তিত হয়ে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে তা গড়িয়ে গেল, এ নিয়ে সমাজ ও রাজনীতিসচেতন অনেকেরই প্রশ্ন জেগেছে। বিশেষ করে সবশেষ আজ রোববার একটি থানারই ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যাসহ অর্ধশতাধিক মৃত্যুর পরেও এই আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার ঘোষণায় অনেকের মনেই প্রশ্ন, এই আন্দোলনে আসলে কারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন? এই আন্দোলন থেকে গত কয়েক দিন অনেক রাজনৈতিক আকাঙ্খার কথা উচ্চারিত হতে শোনা গেছে। দৃশ্যমান এই অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে চলমান আন্দোলনের ভবিষ্যত নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে সংশয়।
এদিন দুপুরে রাজধানীর বাংলামটরে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগের দৃশ্য দেখছিলাম। এ আন্দোলনকারীদের গতিপথ আসলে কোন দিকে গড়াচ্ছে তা বুঝতে অনেকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা দেশের একজন বিশিষ্ট গবেষকের কাছে জিজ্ঞাসা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগই সব সংকটের সমাধান ? চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গণমানুষের মতো তাঁর কণ্ঠেও ছিল উদ্বেগ।
তিনি যা জানালেন তার মর্মার্থ, পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে তাকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নই বলা যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি অবশ্য তা মনে করেন না। তাঁর এই মনে না হওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলছিলেন-আন্দোলনকারীরা সরকার পরিবর্তনের প্রশ্নে সোচ্চার থাকলেও তাতে পুরো বিষয়ের মধ্যে দেশের সাধারণ মানুষের সামগ্রিক সংকটের গুরুত্ব কতখানি? তিনি প্রশ্ন তোলেন, আন্দোলনকারীরা কি দ্রব্যমূল্য নিয়ে কোন কথা বলছেন? আন্দোলনকে ‘বৈষম্যবিরোধী’ বললেও এতে দেশে বর্তমানে কি ধরণের বৈষম্য বিরাজমান তা নিয়ে বিশদ কোন ব্যাখ্যা নেই।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের কার্যকারণ হিসেবে দেশজুড়ে নাশকতা হচ্ছে-ক্ষমতাসীনরা এমন দাবি করলেও জ্যেষ্ঠ ওই গবেষক এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন। তাঁর ভাষ্যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে শক্ত অবস্থান দীর্ঘদিন থেকেই নিয়েছেন, এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে এসব কর্মকাণ্ড। এই আন্দোলনের পেছনে শতভাগ আন্তর্জাতিক সংযোগ থাকার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না-দাবি তাঁর। বাংলাদেশের সরকার প্রধানের উপর যেখানে ডোনাল্ড লু, পিটার হাসের মতো অনেক মার্কিন কুটনীতিক ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ, এমনকি বাংলাদেশের অগ্রগতিকে থামাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই তৎপর; সেখানে এমন কিছু ষড়যন্ত্র অমূলক নয়-এ দাবি জোরের সঙ্গেই করেন তিনি।
গেল কয়েক দিন, সীমাহীন গুজবের মধ্যে বসবাস করতে হয়েছে আমাদের। এর মধ্যে অনেক তথ্যই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যেমনটি হয়েছে, স্যোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে আসা ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের প্যাডে চলমান এই আন্দোলনে সহযোগিতা প্রদানে তাদের স্বীকারোক্তির বিষয়টি। যেখানে আমরা ‘এডভাইসরি’র নামে তাদের (ঢাকাস্থ পাক দূতাবাস) সঙ্গে যোগাযোগ করা কয়েকজন আন্দোলনকারীর সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, দূতাবাসের কাছে সহযোগিতা চাওয়া আন্দোলনকারীদের সব রকম সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
বিষয়টি আমাদের রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবেন, তবে ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাস যে অতীতেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এবং এদেশে সন্ত্রাস ছাড়াতে নানা গোপন তৎপরতা চালিয়ে এসেছে তা অজানা নয়। পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা বার বার দৃশ্যমান হয়েছে। তাই পাক দূতাবাস যে কুটনৈতিক শিষ্টাচার লংঘন করে এ ধরণের ধৃষ্ঠতাপূর্ণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতে পারে-সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
বিশ্ব অর্থনীতির নাজুক সময়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংঘাতময় পরিস্থিতি দেশের আর্থ-সামাজিক সংকটকে আরও প্রবল করে তুলবে তাতে কোন সংশয় নেই। এ অবস্থা চলমান থাকলে মুখ থুবড়ে পড়বে বৈদেশিক বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানিসহ সামগ্রিক অর্থনীতিই। তাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। সংশ্লিষ্ট সকলকেই দেশের এই বাস্তবতাকে অনুধাবন করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে জোরাল ভূমিকা রাখা উচিত। মনে রাখতে হবে, দেশ যদি ব্যর্থ হয় তবে তাতে কারোরই মঙ্গল নেই। আন্দোলনকারীদের তো নয়-ই।
গবেষক ও পর্যবেক্ষকদের অনুমান এবং অতীত ইতিহাস হাতড়ে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলকে ঘিরে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে। কিন্তু ফের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আন্তর্জাতিক কোন কুট-চক্রান্তের বলি না হোক তা সবারই কাম্য হওয়া উচিত। সেজন্য জনগণের মাঝে সচেতনতা ও জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যেমন জরুরি; সেইসঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতির নিরিখে রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিকে কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ পটভূমিতে না রেখে আরও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন।
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, এডিটর-অ্যাট্-লার্জ, বার্তা২৪.কম