২০২০ সালের পরিবর্তে ২০২১-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল টোকিও অলিম্পিক্স। সেই বছর সারা বিশ্বে থাবা বসিয়েছিল মহামারী কোভিড। এবার আয়োজক দেশ প্যারিসে শুরু হয়েছে অলিম্পিক প্রতিযোগিতা ২০২৪ (২৬ জুলাই- ১১ আগস্ট) বা ৩৩তম অলিম্পিক্সের আসর। ১৮৯৬ সালে এথেন্সে অলিম্পিক্সের সূচনার পরেই ১৯০০ সালে দ্বিতীয় অলিম্পিকের গন্তব্যও হয়েছিল জাঁকজমকপূর্ণ প্যারিস শহর। এই নিয়ে তৃতীয় বার অলিম্পিক্সের আয়োজক হয়েছে প্যারিস।
‘এক চলমান মহোৎসবের নাম প্যারিস', বলেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। শহর জুড়ে সব বিশ্ববিখ্যাত ইমারত, শিল্প সামগ্রী, সাহিত্য সম্পদ, সমৃদ্ধ মোহাফেজখানা। বৈশ্বিক স্মৃতি ও আবেগের টগবগে লাভাস্রোত এভিনিউ ও চত্বরে। ইতিহাস জমাটবদ্ধ প্যারিসে দেয়ালে, হর্ম্যে, সৌধে। রোম্যান্সের মৌতাত শহরের চারদিকে। বিশ্বের সবচেয়ে রোম্যান্টিক শহর প্যারিস। ট্যুরিস্টের সেরা গন্তব্য। বলাই হয়, বাকিদের জন্য একটি দেশ, ভ্রমণপিপাসুদের দু’টি দেশ। একটি তার নিজের, অন্যটি ফ্রান্স।
প্যারিসে এবারই প্রথমবারের মতো অলিম্পিক্সের সূচনা হল খোলা আকাশের নিচে, কোনও স্টেডিয়ামে নয়। পাশে ছিল বহমান স্যেন নদী। নদীটি এতোটাই আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিক যে, সারা পৃথিবীর লোকে ছুটে আসে দেখতে। একশো বছর ধরে এই নদীতে গোসল করা নিষিদ্ধ। জোয়ান অব আর্কের চিতাভস্ম এই নদীতে ছড়ানো। জোয়ান অব আর্ককে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল মেয়ে হয়েও ছেলেদের পোশাক পরার অপরাধে। যুদ্ধের কোনও পাঠ না থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে চমকে দেওয়া কিশোরীর বিরুদ্ধে বিচারসভায় আর কোনও অপরাধ খুঁজে পাওয়া যায়নি। জোয়ান অব আর্কের প্যারিসেই এই প্রথম সমসংখ্যক পুরুষ ও মহিলা প্রতিযোগী অংশ নিয়ে লিঙ্গ-সাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে অলিম্পিক্সের ইতিহাসে।
প্যারিসের ঐতিহাসিক সব জায়গায় অলিম্পিক্সের ইভেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুস্তাভে আইফেলের তৈরি ৩৩০ মিটার লম্বা মিনারের পাশে হচ্ছে বিচ ভলিবল। আইফেল টাওয়ারের স্পর্শ সেখানেই শেষ হচ্ছে না। প্রতিযোগীরা যে পদক পাচ্ছেন, তাতে আইফেল টাওয়ারের ধাতব টুকরো থাকছে।
শ্যাম্প দে মার্সে হবে জুডো, কুস্তি। গ্রাঁ প্যালেস, যার ‘গ্লাসরুফ’ দেখতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ট্যুরিস্টরা ছুটে আসেন, সেখানে বসে ছাদের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকানোর পাশাপাশি দেখা যাবে ফেন্সিং ইভেন্ট। ট্রোকাদেহোতে পুরুষ ও মহিলাদের রোড সাইক্লিং রেস।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কবরগাহের কাছাকাছি শেষ হবে প্রতিযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট ম্যারাথন। জায়গাটির নাম প্লেস দে লা কনকর্ড। যেখানে গিলোটিন হত। ষোড়শ লুই ও রানি আন্তোনেয়াৎ, যিনি ফরাসি বিপ্লবের উত্তাপ আঁচ করতে না পেরে বলেছিলেন ‘‘ওরা রুটি পাচ্ছে না তো কী, কেক তো খেতে পারে’’। দু’জনেরই ফরাসি বিপ্লব-উত্তর গিলোটিন হয় এখানে।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি টমাস বাক সূচনা-বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘প্যারিস আসর এমন সময়ে বসছে যখন শতসহস্র সংঘাত ও বিভাজনে পৃথিবী ছিন্নভিন্ন এবং মানুষ সর্বত্র ঘৃণা, যুদ্ধ ও আগ্রাসনে ক্লান্ত’। খোদ ফ্রান্সও রাজনৈতিক দোলাচলে টালমাটাল। সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বদলে জোড়াতালির কোয়ালিশন। তারপরেও উদ্যোক্তারা দমে নেই। মরিয়া প্যারিসও তৎপর ঐতিহ্যের সঙ্গে খেলার মেলবন্ধনে। অলিম্পিক কমিটি জানিয়ে দিয়েছে, ‘তাদের দেশ যদি কোনও সংঘাতে লিপ্ত থাকে, এমনকি যুদ্ধেও থাকে, তারাও একই নিয়মে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবেন। অলিম্পিক ভিলেজে সকলে শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকবেন।’
প্রথাগতভাবে ‘অলিম্পিক ট্রুস’ নামক যে শান্তিচুক্তি হয়ে থাকে, তাতে এ বার ২০৬টি আইওসি সদস্যই প্রতিনিধিত্ব করছে। রাশিয়া আর আফগানিস্তান ব্যতিক্রম- প্রথম দেশের অংশগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে শর্ত, তারা ইউক্রেন যুদ্ধের সমর্থক হতে পারবেন না, আর দ্বিতীয় দেশের অ্যাথলিটরা দেশ থেকে নির্বাসিত। প্যারিসে খেলার ছলে বিশ্বশান্তির প্রণোদনা স্পষ্ট।
শান্তি খুবই দরকার এই শঙ্কা ও সংঘাতের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে। নির্বাচন-উত্তর অশান্ত প্যারিস। অলিম্পিক্সের সময় স্থায়ী সরকার নেই ফ্রান্সে। রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা নিয়ে প্রতিবাদ চলছে। গাজ়া যুদ্ধের প্রভাবে সর্বত্র নিন্দার ঝড়। বিশ্বব্যাপী সংঘাত ও যুদ্ধ অব্যাহত। মৃত্যু ও ধ্বংস সমান্তরালে চলমান। প্যারিস অলিম্পিক্সের উদ্বোধনের কয়েক ঘণ্টা আগে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফ্রান্সের ট্রেন পরিষেবা ব্যবস্থা। রাতের অন্ধকারে বেশ কয়েক জায়গায় ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তবু প্যারিস থেমে থাকেনি। সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্যারিস ফরাসি সৌরভে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের সর্বত্র।
ঠিক একই সময়কালে ঢাকার পরিস্থিতি ছিল অবর্ণনীয়। পোস্ট-মর্ডান ঢাকার আইকন মেট্রোরেল বিধ্বস্ত। রেল ব্যবস্থা আক্রান্ত। সরকারি অফিস আর নগর স্থাপনা ধ্বংসপ্রাপ্ত। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বিক্ষোভের আগুন। দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উভয়পক্ষ। সবচেয়ে মর্মান্তিক ও অপূরণীয় যে ক্ষতি হয়েছে, তা হলো অসংখ্য মানুষের মৃত্যু। সরকারিভাবে যা দেড় শ‘র কাছাকাছি আর বেসরকারি মতে দুই শতাধিক। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। প্রায়-সবাই হয় অগ্নিদগ্ধ, নয় বুলেটবিদ্ধ কিংবা মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত। চোখ হারিয়েছেন অনেকেই। নিখোঁজ বহু। এক সপ্তাহে দুই শতাধিক আন্দোলনকারী, পথচারী, ছাত্রলীগ ও পুলিশের মৃত্যু এবং সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের মানবিক ও বস্তুগত ক্ষতির কোনও সীমা-পরিসীমা নেই।
এতো মৃত্যু, এতো রক্ত, এতো ধ্বংস, এতো তাণ্ডবের সম্মিলিত চেহারাটা ছিল বড় বীভৎস, ভয়ঙ্কর এবং করুণ। মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের জেরে দগ্ধ ও রক্তাক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। দেশবাসীর তাজা স্মৃতি ছুঁয়ে ছিল আতঙ্ক, ভীতি ও উদ্বেগ, যা ক্রমশ স্বস্তির দেখা পেলেও এক দুঃস্বপ্ন হয়ে বেদনা জাগাচ্ছে।
প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন ১৯৭৩ সালে লিখেছিলেন, ‘...আমি চাই না যে আমাকে পিটিয়ে হত্যা করা হোক। আমি চাই না আমার সে বিকৃত দেহটা দেখে কাঁদুক আমার স্বজন। অশ্রুর প্লাবন নামুক আমার আপনজনের চোখে। আমি চাই না আততায়ীর গুলি বিদ্ধ করুক আমাকে এক অসতর্ক মুহূর্তে। আমি চাই না যে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা একদিন থানা-পুলিশ করুক আমার জন্য। আমি চাই না নিরুদ্দেশ তালিকায় ভিড় জমাতে।’ তিনি ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন।
নেপোলিয়নের কবরগাহে ম্যারাথন এবং শহরের যাবতীয় দ্রষ্টব্যস্থানে অলিম্পিক্সের নানা ইভেন্ট আয়োজন করে প্যারিস যখন বিশ্বশান্তির আহ্বান করে, ঢাকা তখন নগরের নান্দনিকতাকে তছনছ করে আর রক্ত-মৃত্যুর তাণ্ডবে ভেসে কোন বার্তা দেয়?
প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে (২৯ জুলাই) জানিয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী বিক্ষোভ-সংঘর্ষে বেশি মৃত্যু হয়েছে শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষের। নিহত ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশ শিশু, কিশোর ও তরুণ। হাসপাতাল, স্বজন ও মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের সূত্রে সংঘর্ষ-সংঘাতে এখন পর্যন্ত ২১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বয়স, পেশা ও আঘাতের ধরন এবং কোন এলাকায় আহত অথবা নিহত হয়েছিলেন, তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে ১৫০ জনের। এর মধ্যে ১১৩ জন শিশু, কিশোর ও তরুণ।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিহতদের বেশির ভাগের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। ছররা গুলি বা প্যালেট, রাবার বুলেটের ক্ষতচিহ্ন এবং অন্যান্য আঘাত কম। মৃত্যুর কারণ ও গুলির ধরন নিশ্চিত করতে ময়নাতদন্ত দরকার। অনেক ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত হয়েছে, তবে প্রতিবেদন তৈরি হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ শুরু হয় ১৫ জুলাই। ওই দিন কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। ১৬, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে (১৭ জুলাই কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি)। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে ও পরে গণ-আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও তরুণেরাই বেশি অংশ নিয়েছেন এবং এবারও সেটাই হয়েছে বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে গেল, তখন মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল। সর্বস্তরের মানুষ নেমে এসেছিলেন। তার মধ্যে কিছু লুটপাটকারী হয়তো ছিল, সেটা সব সময় থাকে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে সন্ত্রাসের কথা বলা হচ্ছে। মানুষ ক্ষুব্ধ কেন, সেটার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।