কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাপ ধীরে ধীরে পূঞ্জীভূত হয়ে রাজধানীসহ দেশজুড়ে এক গণবিস্ফোরণের পরিণতি পেয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সবশেষ আপডেটে যা জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে।
গত রোববার (১৩ জুলাই) রাত থেকেই এক ধরণের বিস্ফোরণের আভাস মিলছিল। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্রে রূপ নিলে অনুমান বাস্তব হয়ে উঠে। মঙ্গলবার হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়েই। সবশেষ খবর অনুযায়ী, দেশের সব স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা এসেছে। বেশ কিছু স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি।
সার্বিক পরিস্থিতি এবং হতাহতের ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃজনক। আমরা লক্ষ্য করেছি, গেল কয়েক সপ্তাহজুড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র এর ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। এতদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিলেও সোমবার আন্দোলনরতদের উপর হামলার পর থেকে এর সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি কলেজ শিক্ষার্থীরাও একাত্ম হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যে দিকটি উন্মোচিত হয়েছে তা হচ্ছে-সাধারণ মানুষের মাঝে এ নিয়ে এক ধরণের দ্বিধাবিভক্তি। এই দ্বিধাবিভক্তি মূখ্যত জোরাল হয় চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। সরকারের এমপি-মন্ত্রী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতারাই আন্দোলনকারীদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু বিবেচনার বিষয় যেটি তা হচ্ছে-ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠা এই কোটা আন্দোলনকে অনেক পূর্বেই মিমাংসার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও সংশ্লিষ্ট কেউই সমাধানে উদ্যোগী হননি। উল্টো অনেককেই বিষয়টিকে স্ব-স্ব অবস্থানে অনড় থাকতে দেখা গেছে। এতে মিমাংসাযোগ্য একটি বিষয় সকলের সামনে ক্রমান্নয়ে জটিল হয়ে উঠল।
লক্ষ্য করার মত বিষয়, সরকার বা ক্ষমতাসীনদের বাইরেও অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সংগঠন কিংবা নাগরিক সমাজ কেউই আন্দোলনের উত্তাপ প্রশমনে সেভাবে অগ্রণী হননি। বিশেষ করে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে গড়ে উঠা আন্দোলনটি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল একটি সময়ে কেন সমাধানে বা ঐক্যমতে পৌছানো গেল না- এই প্রশ্নটিই ঘুরে ফিরে বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে এখন।
স্যোশাল মিডিয়ার আধিপত্যের যুগে যেকোন ঘটনা সর্বসাধারণের কাছে পৌছাতে সময় নেয় না। কিন্তু স্যোশাল মিডিয়ায় প্রচারিত বা ছড়িয়ে দেওয়া তথ্য কতটা নির্ভরযোগ্য সত্য তা খতিয়ে দেখার মত সময় সাধারণের থাকে না। ফলে তথ্যের সঙ্গে বিভ্রান্তিও ছড়ায় প্রচুর পরিমাণে। এই জনবিভ্রান্তি বিষয়গুলোকে আরও টালমাটাল করে তুলে।
এধরণের সব বাস্তবতা ছাপিয়ে যে বিষয়টি বিবেচনায় আসছে তা হল সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেননি। এবং নেননি বলেই কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারা কোন কথা বলার প্রয়োজনই অনুভব করেননি। সরকার বা ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যেটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বিষয়টি আদালতের সিদ্ধান্তের এখতিয়ারে। সরকার সেখানে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে? কিন্তু আমরা যখন দেখলাম আদালত কোটা সংক্রান্ত বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে পর্যবেক্ষণ জানায়, তা সত্ত্বেও এ নিয়ে সরকারের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে।
যে আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের সম্পৃক্ততা রয়েছে, সেই আন্দোলন যে পর্যায়ক্রমে দানা বেঁধে উঠতে পারে-তা ক্ষমতাসীন দলের নেতা কিংবা মন্ত্রীদের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু কেন সেটি তাদের কাছে গুরুত্ব পেল না সেটাই বড় প্রশ্ন। এক্ষেত্রে এটি সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা বললেও ভুল বলা হবে না।
আরেকটি প্রবণতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সব বিষয়ে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু একটি সরকারে বা তার অধীনে বিভিন্ন দপ্তরে পদাসীন গুরুত্বপূর্ণ কর্তারা কেন আন্দোলন নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারলেন না? সব সিদ্ধান্ত দেশের প্রধান নির্বাহীর কাছে পুঞ্জীভূত থাকাও যেমন ভালো লক্ষণ নয়, তেমনি দায়িত্বশীলদের কর্তব্যহীনতাও কাম্য হতে পারে না। সেকারণে সংশ্লিষ্টদের নীরব দর্শক হয়ে থাকা এই গণবিস্ফোরণের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
আমরা জানি, বর্তমানে যুদ্ধাবস্থায় অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বের সব দেশই কমবেশি টালমাটাল সময় পার করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে সাম্প্রতিক বছর কিংবা মাসগুলোতে যে উদ্বেগ আমরা অর্থনীতি সংশ্লিষ্টদের মুখে শুনে আসছি, দেশের নতুন করে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা সেই অবস্থাকে আরও সঙ্গীন করে তুলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দেশে এ ধরণের অস্থিতিশীলতা বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেওয়ার যে লক্ষণ দেখা দিয়েছে তাতে সামনের দিনগুলিতে দেশের স্থিতিশীলতা আরও ব্যাহত হবে, এতে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথে বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশের নেতিবাচক ভূমিকা কারোর অজানা নয়। বাংলাদেশে ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা ঘটতে না ঘটতেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতি দেখলাম। নিকট অতীতেও দেশটির বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলানোর প্রবণতা দেখা গেছে।
২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ হিসাবে বিকশিত হচ্ছে, সেখানে উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন যেকোনো বিষয়ে আমাদের সতর্কতা জরুরি। যেখানে বেকারত্বের সংকটে আমাদের শিক্ষিত তরুণরা সবসময় উদ্বিগ্ন, সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদশীলতা কাম্য ছিল।
দেশের শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ও অধ্যয়নের পরিবেশকে বজায় রাখতে আন্দোলনরতদের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত হলে সংকট এতদূর নাও গড়াতে পারত বলেই মত বিশ্লেষকদের। সরকার সেই সুযোগটির সদ্ব্যবহার না করায় বিরোধী রাজনৈতিক দল বা সংগঠন তা ব্যবহারে উদ্যত হবে তা ধরেই নেওয়া যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে যারা পরিচিতি সেই জামায়াত বা স্বাধীনতাবিরোধীরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে অতিমাত্রায় সক্রিয়। কিন্তু সেই সুযোগটি তাদের অবলীলায় কেন দেওয়া হল, এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
বর্তমান অবস্থায় এসে সরকারের মন্ত্রী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিশ্চয়ই এ বাস্তবতা অনুধাবন করবেন। তবে আজ ১৪ দলের শরিক দলসমূহের অনেক শীর্ষ নেতা ও অনেক প্রগতিশীল শিক্ষাবিদই জোর দিয়ে যে কথাটি বলেছেন তা হচ্ছে-আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তরুণরাই আগামীর ভবিষ্যত নির্মাতা-এই বাস্তবতা অস্বীকার না করে তাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশ দায়িত্বশীলদেরই দিতে হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বজনীন ইতিহাস চর্চার যে অন্তরায় বিগত দশকগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তরুণ প্রজন্মের সঠিক ইতিহাস না জানার জন্য যদি দায় নিতে হয় তবে সেই দায় রাষ্ট্রেরও। কেননা প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস না জানানোর ব্যর্থতা রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। সর্বোপরি, কোটা সংস্কার নিয়ে চলমান আন্দোলনে উদ্ভূত এই নৈরাজ্যকর অবস্থার নিরসন সংশ্লিষ্ট সকলে মিলেই করতে হবে। এজন্য দায়িত্বশীল সবার কাছে সংবেদনশীলতা প্রত্যাশিত, উসকানি নয়।