জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উলরিখ বেকের “ঝুঁকির সমাজ” বা “রিস্ক সোসাইটি” তত্ত্ব আধুনিক সমাজের ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তার ধারণা নিয়ে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করে। উলরিখ বেক ১৯৮৬ সালে তার বই “রিস্ক সোসাইটি: টুওয়ার্ডস আ নিউ মডার্নিটি” প্রকাশের মাধ্যমে এই ধারণাটি জনপ্রিয় করেন।
তার মতে, ঝুঁকির সমাজ একটি নতুন ধরনের সমাজ যেখানে ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা আধুনিক জীবনের মূল উপাদান হয়ে ওঠে এবং এই ঝুঁকিগুলি প্রায়শই মানুষের কর্ম ও সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়।
বেকের মতে, প্রথাগত সমাজগুলি মূলত সম্পদ ও সুযোগের বণ্টনের ওপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল। কিন্তু আধুনিক সমাজগুলি ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার বণ্টনের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। এই ঝুঁকিগুলি মানুষের ক্রিয়া ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় এবং এদের পরিণতি প্রায়শই বৈশ্বিক ও আন্তঃপ্রজন্মীয় হয়। আধুনিক সমাজের ঝুঁকিগুলি প্রায়শই অদৃশ্য এবং প্রায় অজ্ঞেয়, যা তাদের সনাক্ত এবং পরিচালনা করা কঠিন করে তোলে।
বেকের তত্ত্ব অনুযায়ী, আধুনিকায়ন, শিল্পায়ন এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে ঝুঁকির বৃদ্ধি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশ দূষণ, পারমাণবিক বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঝুঁকিগুলি আধুনিক প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। বেক যুক্তি দেন যে এই ঝুঁকিগুলি শুধুমাত্র একটি দেশের বা একটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং বৈশ্বিক প্রসার লাভ করে, এবং এর ফলে সারা পৃথিবী একসাথে এই ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
বেকের ঝুঁকির সমাজ তত্ত্বে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিরীক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে ঝুঁকির সমাজে, সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ ঝুঁকি সনাক্ত, মূল্যায়ন এবং পরিচালনার জন্য বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞ এবং প্রযুক্তিগত সমাধানের উপর নির্ভর করে। তবে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও বিশেষজ্ঞদের উপর এই নির্ভরতাটি প্রায়শই বিতর্কিত হয়, কারণ নতুন ঝুঁকিগুলি বিদ্যমান জ্ঞান ও নীতিমালাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
ঝুঁকির সমাজে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়াগুলি প্রায়শই সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। ঝুঁকি নির্ধারণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও স্বার্থের সংঘাত প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, শিল্প দূষণ বা পারমাণবিক শক্তির ঝুঁকি নিয়ে বিতর্ক প্রায়শই বৈজ্ঞানিক মতভেদ এবং নীতিগত পার্থক্যের দিকে নিয়ে যায়। এই দ্বন্দ্বগুলি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও শাসনের প্রক্রিয়াগুলিকে আরও জটিল করে তোলে।
উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজ তত্ত্ব আধুনিক সমাজের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার প্রশ্নে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এটি প্রস্তাব করে যে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং তাদের মোকাবিলা করতে হলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক অংশগ্রহণের সমন্বিত প্রয়োজন। ঝুঁকির সমাজে, ঝুঁকিগুলির জটিলতা ও আন্তঃসংযোগ বুঝতে এবং তাদের কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজ তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং শিল্প দূষণের মতো ঝুঁকিগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। উলরিখ বেকের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ঝুঁকিগুলি মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কার্যকর নীতি এবং সামাজিক অংশগ্রহণের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ঝুঁকির সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশকে তার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কৌশলগুলি উন্নত করতে এবং একটি আরও স্থিতিশীল ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীল। বঙ্গোপসাগরের পাশে অবস্থিত, দেশটি নিয়মিতভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং উপকূলীয় ক্ষয়ের শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, এই ঘটনাগুলি আরও ঘন ঘন এবং তীব্র হচ্ছে, যা জনসংখ্যা এবং অবকাঠামোর জন্য উল্লেখযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করে। ঝুঁকির সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশলগুলি বিকাশ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কৃষি খাতও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। আবহাওয়ার ধরণে পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং লবণাক্ততার বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দেশের একটি বড় অংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল হওয়ায়, এই ঝুঁকিগুলি খাদ্য নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ জীবিকার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ঝুঁকির সমাজের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের কৃষি খাতে উদ্ভাবনী কৌশল, যেমন জলবায়ু-সহিষ্ণু ফসল এবং টেকসই কৃষি অনুশীলনগুলির প্রবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য খাতও বাংলাদেশের ঝুঁকির সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবনতির কারণে দেশটি বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। জলবাহিত রোগ, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার কারণে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ঝুঁকির সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলিকে উন্নত করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে শিল্পায়ন এবং নগরায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা প্রযুক্তিগত ঝুঁকির একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অপ্রতুল পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্বল পরিকাঠামোর কারণে শিল্প দূষণ এবং বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। নগরায়নের ফলে সৃষ্ট ঘন জনসংখ্যা এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে পরিবেশগত ক্ষতি এবং জনস্বাস্থ্য সমস্যা আরও বেড়েছে। ঝুঁকির সমাজের প্রেক্ষাপটে, পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন অনুশীলনগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের ঝুঁকির সমাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দারিদ্র্য এবং সামাজিক বৈষম্য। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে এবং তারা প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত ঝুঁকির প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, স্বাস্থ্য সংকট বা অর্থনৈতিক মন্দার মতো ঝুঁকির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য তাদের কম সম্পদ এবং কুশলতা রয়েছে। ঝুঁকির সমাজের প্রেক্ষাপটে, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশের ঝুঁকির সমাজে নারী এবং শিশুদের ঝুঁকি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহিলারা প্রায়ই পরিবারের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক এবং খাদ্য ও পানি সংগ্রহের জন্য দায়ী, যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় তাদের আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। তদ্ব্যতীত, শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ঝুঁকির শিকার হয় যখন পরিবারগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়। ঝুঁকির সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে, মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নীতি এবং কর্মসূচির উন্নয়ন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের ঝুঁকির সমাজে শাসন এবং নীতিগত প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝুঁকি পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী শাসন কাঠামো থাকা অপরিহার্য, যা প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়া, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষার পদক্ষেপগুলি অন্তর্ভুক্ত করে। সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ ঝুঁকির বিরুদ্ধে টেকসই প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমাজে ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সচেতনতা এবং শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মধ্যে ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ঝুঁকি মোকাবিলার দক্ষতা শেখানো দেশের সামগ্রিক ঝুঁকি সহনশীলতা বাড়াতে পারে। স্কুল, কমিউনিটি প্রোগ্রাম এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে ঝুঁকি শিক্ষার উদ্যোগগুলি জনগণের ক্ষমতায়নে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কৌশলগুলি উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
ঝুঁকির সমাজের ধারণা বাংলাদেশে একটি জটিল এবং বহুস্তরীয় বাস্তবতা প্রকাশ করে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত বিপদ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং সামাজিক বৈষম্য মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জগুলি দেশের উন্নয়ন, শাসন এবং সামাজিক কাঠামোর জন্য গভীর প্রভাব ফেলে। ঝুঁকির সমাজের প্রেক্ষাপটে, টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জনগণের ক্ষমতায়নের দিকে মনোনিবেশ করে একটি সামগ্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জনগণের জন্য একটি আরও নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং স্থিতিস্থাপক ভবিষ্যত গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
মো: বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।