ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে দেশের বেশকিছু জেলা বন্যা কবলিত । শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বন্যায় আক্রান্ত ১৫টি জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ। কবলিত মানুষেরা নিদারুণ এক অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছেন। প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকটে রয়েছেন তারা।
সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে নগদ অর্থ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রের স্বীয় কর্তব্যের অংশ হিসেবেই এ সহায়তা প্রদান হয়ত সামনের দিনগুলিতেও করে যেতে হবে সরকারকে।
কিন্তু দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগের সঙ্গে নিত্যদিন লড়াই করলেও রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনসমূহের এ নিয়ে কোন কর্মসূচি বা হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে না। জনগণের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানোই রাজনৈতিক দলগুলির ঘোষিত প্রধান কর্তব্য হলেও এ দূর্যোগে তারা দিব্যি সুখনিদ্রায় আছেন বলেই মনে হচ্ছে।
সরকারি কি বিরোধী, ডান কিংবা বাম-কাউকেই এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সহায়তামূলক কর্মসূচি গ্রহণের খবর আমরা দেখিনি। আমরা লক্ষ্য করে আসছি, নির্বাচনকে সামনে রেখে অসংখ্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। এই তো সেদিনের ঘটনা! স্মরণ করতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়, গেল বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে মনোনয়ন ফরম কেনা-বেচায় দলের অফিসের বাইরে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল। মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্ধে কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল বড়-ছোট রাজনৈতিক দলগুলির অফিস প্রাঙ্গন।
এসব হঠাৎ রাজনীতিক বনে যাওয়া ব্যক্তিরা নিজেদেরকে জনসেবক, জননেতা ইত্যাদি বহু বিশেষণে মাঠ-ঘাট কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। যদিও নির্বাচন পেরিয়ে যেতে না যেতেই তারা এক রকম হাওয়া হয়ে গেছেন। শুধু যে অচেনাদেরই এই দলে দেখা যায়-তাও নয়। বরং বহু তথাকথিত ব্যক্তিসর্বস্ব দলের ‘জাতীয়’ নেতাদেরও দেখা যাবে এই হাওয়া হয়ে যাওয়াদের মিছিলে।
আসা যাক, বড় রাজনৈতিক দল বা সহযোগী অঙ্গ বা সংগঠনের বিষয়ে। আমরা যদি সমসাময়িক কালের ঘটনা মূল্যায়ন করি তবে এটি স্পষ্ট যে, দূর্যোগকবলিত মানুষদের পাশে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তার হাত প্রশস্ত করার প্রবণতা খুবই সামান্য। তথাকথিত ত্রাণ বিতরণের যে যৎকিঞ্চিৎ প্রবণতা দেখা যায় তাকে সহায়তার চেয়ে ফটোসেশন বলাই শ্রেয়!
স্যোশাল মিডিয়ার পর্দায় ঘুরতে থাকা করোনাকালে এক বৃদ্ধাকে মাস্ক দেওয়ার সেই ছবির কথা কারোর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ২০-২৫ জন রাজনৈতিক কর্মী এক অশীতিপর মলিন বস্ত্রের বৃদ্ধাকে সামান্য ২ টাকার মাস্ক তুলে দিতে ফটোসেশন করে তা ফেসবুকে ছেড়েছিলেন! এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করা হলেও বাস্তবে দূর্গত মানুষদের সহায়তায় তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মসূচি যে এর চেয়ে শ্রেয়তর কিছু নয়, তা বলাই বাহুল্য।
চলমান বন্যার মাঝেই আরও দুঃসংবাদ এসেছে। গণমাধ্যমের খবরে যা জানা যাচ্ছে, এবছরের আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আরেকটি বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। খবরে যা জানা যাচ্ছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর, জামালপুর, ফেনী, রাঙামাটি, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ ও কক্সবাজার জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, এ বন্যায় এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ২০ লাখ মানুষ।
প্রতিদিনই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে নতুন বন্যার্তদের নাম। এই যখন পরিস্থিতি, তখন জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ মানুষগুলোর থাকার কথা দূর্গতদের সবচেয়ে কাছে। কিছু দিতে না পারলেও অন্তত ভরসা দিয়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টাও দূর্গতদের সাহস যুগাতো।
প্রকৃতঅর্থে দূর্যোগের এই সময়গুলো হওয়া উচিত ছিল-রাজনীতির মানুষদের নিজেদেরকে সত্যিকারের জনসেবক হিসেবে প্রমাণ দেওয়ার। কিন্তু ক্ষমতার চেয়ার দখল বা অধিকার করার দৌঁড়ে তারা যতটা মরিয়া, তার সিকি শতাংশও যদি দূর্গত বা পীড়িত মানুষের সেবায় দেখা যেত তবে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীদের মানুষ দেবতা জ্ঞান করত হয়ত!
অন্যদিকে, দেশের বিপুল সংখ্যক বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডের দিকে যদি নজর দিই হবে দেখব-দূর্গত মানুষদের জন্য তাদের গৃহীত কর্মসূচি বলতে যা আছে তা ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই’ দৃষ্টান্তের মতোই। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ক্লাব-সমিতি পূর্বে যেমন অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, বর্তমানে সেই প্রবণতাও কেন যেন হারাতে বসেছে।
ঔপনিবেশিক যুগে বাংলায় যুবজাগরণের মহান উদগাতা স্বামী বিবেকানন্দ যুবকদের আপন কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নেতা হতে যেও না, সেবা করে যাও।’ আমরা মনীষীদের বাণীর প্রভাব সেই যুগের বা পরবর্তী যুগের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে প্রবলভাবে দেখেছি। মহামারী কিংবা দূর্যোগে পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোই হয়ে উঠেছিল তাদের রাজনীতি বা ধর্মচর্চার অনুষঙ্গ।
কোটাবিরোধী আন্দোলন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দেশজুড়ে নতুন প্রবর্তিত পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে রাজধানী ঢাকা উত্তাল। এমপি আনার হত্যা, প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান গুটিকয়েক কর্তাব্যক্তির দুর্নীতির খবর নিয়ে চলছে হইচই, মুখরোচক আলোচনা-সবার দৃষ্টি এখন সেদিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত জনপদে বন্যাকবলিত ২০ লাখ মানুষের নিত্যদিনের মরণপণ সংগ্রামের কতটাই বা আমরা ধারণ করছি? সরকার বা সংস্থাসমূহ যে প্রচেষ্টা জারি রেখেছিল, অন্য সবার হাত যদি তাতে পড়ত; তবে দূর্গতদের এই দুর্দশা আর থাকতো না। তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। তাই শিল্পী হায়দার হোসেনের গানের কথায় আমাদেরও প্রশ্ন, ‘কি দেখার কথা কি দেখছি?/কি শোনার কথা কি শুনছি?/কি ভাবার কথা কি ভাবছি? কি বলার কথা কি বলছি?’