পেনশন একটি নির্দিষ্ট কর্ম বা পেশাজীবীদের জন্য প্রচলিত একটি ধারাবাহিক বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলবৎ করার একটি অন্যতম বড় উপায় হলো বয়স্কদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা। সাধারণতঃ সমাজ স্বীকৃত উপায়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে বৃদ্ধকালীন নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সকল মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গত বছরের ১৭ আগস্ট এর উদ্বোধন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বলতে গেলে এখনও কিছুই জানেন না বা বোঝেন না। যারা এই সর্বজনীন পেনশন সম্পর্কে কিছুটা জেনেছেন, তাদের নিকট এটা এখনও কৌতূহলের বিষয় এবং সমাজের বিজ্ঞজনদের নিকট এটা এখনও একটি বড় পর্যবেক্ষণের বিষয়।
কিন্তু তাড়াহুড়ো করে দায়সারা গোছের কোনো কিছু করতে গিয়ে আমাদের দেশে যেটা ইতোমধ্যে জটিলতা তৈরি করে ফেলেছে। উদ্বোধনের একবছর না পেরুতেই এটা নিয়ে মহা জটিলতা শুরু হয়েছে। তার প্রমাণ দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদেরকে অনির্দিষ্ট ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন স্কীমের চারটি বড় শাখা রয়েছে। এই স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন, তাকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন তাহলে ৬৫ বয়স বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সরকার মোট ৬টি স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে। তবে আপাতত চালু হয়েছে চারটি স্কিম। এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। আমাদের দেশের বাস্তবতায় এখনও সমতা ও সুরক্ষা স্কীমে তেমন আবেদনকারী নেই। অথচ বিশাল আয়বৈষম্য প্রপীড়িত জনসংখ্যার নিরীখে শুধু ‘সমতা’ বা ‘সুরক্ষা’ স্কীম দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে আগামী ক’বছর পর্যবেক্ষণ করার
প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটার জন্য অপেক্ষা না করেই- সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা
হয়েছে।
‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। দেশের চার শতাধিক স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ তবে শুরু থেকে নানা বৈষম্যমূলক বিষয় আঁচ করে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এ কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছেন।
বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখে, যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন সিপিএফে। পেনশনে যাওয়ার পর তারা এই টাকা পেয়ে থাকেন। কিন্তু নতুন ঘোষণায় এখানে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে এটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, ‘প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হবে। যেটা আগে কাটা হতো না। এ স্কিমে আনুতোষিক শূন্য। বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন; কিন্তু নতুন এ স্কিমে পেনশনাররা ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থায় ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায়, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সেটা সুস্পষ্ট করা হয়নি। সব থেকে বড় বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, বৈশাখী ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না।’
বিভিন্ন প্রতিবাদ সভায় তারা আরও বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। ..তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।’
এর পেছনে যুক্তি অনেক। যেগুলো প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিবাদী সভায় আরও বেশি করে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে বেগবান করে চলেছে। সেখানে বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যয় স্কিম এর পার্থক্য খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথমত: বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মরত থাকেন, প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যেতে হবে। তাদের চাকরিকালই ৫ বছর কমে যাবে। এই চাতুরী খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেখিয়েছেন, কীভাবে নতুন পেনশনব্যবস্থা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং শিক্ষকদের সুবিধা কমিয়ে দেবে। বলা হয়েছে- ‘এটি শুধু আর্থিক দিক থেকে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য নয়, এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও বৈষম্যমূলক। কারণ, একই স্কেলে একই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন তুলে একেকজন একেক রকম পেনশন পেতে পারেন না। বরং শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিত অন্যদের চেয়ে বেশি এবং আলাদা। যোগ্যতা চাইবেন বিশ্বমানের আর সুযোগ-সুবিধা দেবেন বিশ্বের সবচেয়ে কম, এটি তো অন্যায্য চাওয়া।’
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন নতুন পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে? ..ঘোষণা অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা তাঁদের জন্য প্রযোজ্য, যাঁরা বর্তমানে কোনো পেনশন পলিসিতে নেই।’ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের তো পেনশন স্কীম বিদ্যমান রয়েছে। তবে কেন তারা আবার নতুন পলিসিতে আসবেন? অথচ আমাদের নীতি নির্ধারকদের সেদিকে খেয়াল নেই। যাদের চাকুরী নেই, বেতন নেই, সামাজিক অবস্থান খুবই নড়বড়ে তাদের কল্যাণের জন্য না ভেবে পেনশনধারী চাকুরীজীবিদের বিদ্যমান চাকুরীর বয়সসীমা, আর্থিক সুবিধা কমিয়ে নিয়েকেন অযথা টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে তা মোটেই বোধগম্য নয়।
একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘এটা খুব বড় উদ্যোগ তবে এখনও এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো চোখে পড়েনি।’
আরেকজন বলেছেন, ‘এজন্য কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি, জনগণ অবগত নয় জনআস্থাও সৃষ্টি হয়নি। এতবড় প্রকল্পের আইডিয়াটাই দু:সাহসের ব্যাপার।’ আঠারো বছরের বেশি সবাই এর আওতাভূক্ত হবে। দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ ভাগের বেশি। যাদের স্থায়ী আয় নেই তারা সদস্য হতে চাইবে না। আর বেকার কেউ সদস্য হলেও সে কিস্তি বা মাসিক চাঁদা পরিশোধ করবে কীভাবে? কিন্তু তবুও খুঁড়িয়ে চালানো হচ্ছে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
উন্নত দেশে প্রায় সকল কর্মক্ষম মানুষ পেশাদারী কাজ করে বেতনভূক্ত হয়ে থাকেন এবং নির্দিষ্ট নিয়মে সময়মতো পেনশন পান। তবুত হঠাৎ কেউ বেকার হয়ে পড়লে অথবা প্রাকৃতিক বা দৈবদুর্ঘটনা ঘটলে সেসব মোকাবেলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে সববয়সী মানুষ সরকারী সহায়তা লাভ করেন। সেজন্য সেসব দেশে সর্বজনীন পেনশনের প্রয়োজন হয় না।
যে সকল সমাজে নানাবিধ বৈষম্যের কারণে অধিকাংশ মানুষ সরকারি-বেসরকারি চাকুরী লাভ করতে না পেরে বেকারত্ব, অসুস্থতা ইত্যাদিতে উপার্জনহারা হয়ে বৃদ্ধকালীণ পর্যায়ে অতি মানবতের জীবন যাপন করেন অথবা কোনো সময় নিজ পরিবার ও সমাজের নিকট বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হন, তখন সেটা চরম অমানবিক। তাদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
এদিকে শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে জুলাই ০১ থেকে প্রত্যয় স্কিম চালু করা হয়েছে। প্রতিবাদে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সেদিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও দাফতরিক কাজ, সভা, লাইব্রেরি সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
সার্বিক অচলাবস্থায় চরম ভোগান্তির শিক্ষার শিক্ষার্থীরা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন। তবে কোনো কোনো শিক্ষক নেতা বলেছেন, করোনাকালের মতো তারা পরবর্তীতে বিশেষ ব্যবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সেশনজট পুষিয়ে দেবেন। এদিকে আন্দোলনের তিনদিনেও সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউই এই চলমান ধর্মঘট নিরসনে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি ।
আমাদের নীতি নির্ধারকদের বিশেষ করে জানা থাকা দরকার- বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গা যেগুলো সব সময় আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে থাকে। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প নিয়ে শিক্ষকদেরকে খোঁচা দেয়ার দরকার কি? বেশ কবছর ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো শান্ত থাকায় কোনো সেশনজট চোখে পড়েনি। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প চাপিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাস অশান্ত করার কথা কার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল?
কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কাজ ফেলে রেখে অনির্দিষ্টকালে ধর্মঘটে যেতে শিক্ষকদেরকে বাধ্য করা হলো? এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে আরও সময়ক্ষেপণ বা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলে কে তার দায়ভার বহন করতে আসবে?
তাই সরকার আর দেরি না করে এই বৈষম্যমূলক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা উচিত। ভবিষ্যতের মেধাবীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা অক্ষুন্ন রাখা এবং পেনশন সংক্রান্ত যাবতীয় বৈষম্য নিরসণকল্পে ‘প্রত্যয় প্রকল্প’ প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ সবাইকে এককটি সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাসের শান্ত পরিবেশে অচিরেই ফিরে আসার সুযোগ দান করুক- এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।