নসর পেয়াদা গল্পে ভুলে মাছ রান্নার তেল কেনা হয়েছিল মদের বোতলে। সেজন্য সেই রান্না করা লোভনীয় মাছ কোন মুসলিম সে রাতে খাননি। স্কুলে পড়েছিলাম সেই গল্প। কারণ, মাদকদ্রব্য সেবন করাই মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ বা হারাম। এ গল্পে ধর্মীয় নৈতিকতার একটা মহান শিক্ষা মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তখনকার দিনে মানুষ এতটা ধর্মপরায়ণতার চিন্তা করতো না-কিন্তু, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের তফাৎ করাকে কায়মনোবাক্যে পালন করতো। যে যার ধর্মের বিধি-নিষেধগুলোকে শ্রদ্ধাভরে পালন করতো। এখন দিন পাল্টে গেছে। মানুষ দিন দিন বড্ড বেশি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে।
আজকাল ব্যস্ত মানুষের সময় কেড়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন আর সংযুক্ত এন্তারজাল। যে মায়াজালে মানুষের চোখ-মন সব সময় আটকে থাকে। তাইতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অভিভাবক বা কারো সঙ্গে কোন কিছুর ভাল-মন্দ শেয়ার করার কোন সময় না পেয়ে ভুল করে বসে। এভাবে গায়ের চামড়ার রং আরও ফর্সা করার জন্য বিষাক্ত ক্রিমের ব্যবহার করতে গিয়ে দেহকে বিকৃত করেতে দ্বিধা করছে না!
এবারের জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা নিয়ে একটি বিতর্কের কলামে চোখ আটকিয়ে গেল। টিআইবি মন্তব্য করেছেন-কালো টাকা সাদা করা অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক, দুর্নীতিবান্ধব এবং প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরিপন্থি।
দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এদের প্ররোচণায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বরত নীতিবান মানুষগুলোর সৎ ও জনকল্যাণকর নীতিগুলো বার বার ভূলুন্ঠিত হয়ে পড়ে। বাধাগ্রস্থ হয় সততা। জিইয়ে থাকে মাদক ব্যবসা, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা- তাহলে কি তারা ভাঁওতাবজিতে পরিণত করতে চায়?
কালো টাকার জন্ম অন্ধকারের ঘুপচি গলিতে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি, মিথ্যা, প্রতারণা, কর ফাঁকি, চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা, চোরাচালানি, অবৈধ মাদক ব্যবসা, ব্যাংক লুন্ঠন, মানি লন্ডারিং, জমি জবরদখল, নদীদখল, ভেজালদ্রব্য তৈরি ও বিক্রি সর্বোপরি ধর্মীয় প্রতারণা, মাজার ব্যবসা, যাকাত ফাঁকি-ইত্যাকার নানা বাজে পন্থা হলো কালো টাকার আঁতুড় ঘর। এসব কালো টাকার মালিকরা সমাজের হোমড়-চোমড়া। নৈতিকার বালাই নেই এদের কাজে কর্মে ও নীতিতে। দেশের কর প্রদান করতে গেলে ধরা পড়তে পারে তাই এরা একদিকে সঠিক পরিমাণ কর দেয় না অন্যদিকে ধর্মীয় ও নৈতিকতাবোধ না থাকায় যাকাত প্রদানেও বিরত থাকে। তাই এদের দ্বারা রাষ্ট্রের আর্থিক কোন মর্যাদা বাড়ে না, দরিদ্র মানুষের কল্যাণও সাধিত হয় না।
রাসায়নিকভাবে কালো রংয়ের মধ্যে সাদা রং মেশালে তা সাদা থাকে না। ছাই বা এ ধরণের ভিন্ন রং ধারণ করে। যা অনেক সময় ছাই বা উৎকট পরিবেশ তৈরি করে বিশ্রি রূপ নেয়! কালো টাকা সাদা করতে গিয়ে যদি সমাজে কিছু ছাই জন্ম নেয় তাহলে মানুষের স্বাভাবিক মানসিক পরিস্থিতি খিঁচড়ে গিয়ে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। এদেশের কর্ণধারগণ মোটামুটি সবাই হজ করে থকেন। কেউ কেউ কিছুদিন পর পর পবিত্র ওমরাহ পালন করতে মক্কা-মদিনায় গমণ করে থাকেন। সেখানে গিয়ে তারা পবিত্র দেহ-মন নিয়ে ফিরে আসেন, দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তারা নিশ্চই চাইবেন না- দেশে এখনও কালো টাকা থাকুক অথবা কালো টাকা জন্ম নিক। আমাদের ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে সিংহভাগ মানুষই ন্যায়নীতির সাথে জীবন যাপন করতে ভালবাসে। তারা সেই পরিবেশ আরু ভালো হোক্ সেটাই কামনা করে। তবে কেন মাত্র ১০% কর দিয়ে মিথ্যার বেসাতী ? যারা কালো টাকা সাদা করার পক্ষে তার কি পর্যবেক্ষণ করেন না যে এর চেয়ে কত বেশি অর্থ প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারাতে হয়?
কালো টাকা সাদা করার সংবাদ দুর্নীতিকে বহু গুণে উস্কে দিবে। জাতি আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না। আমাদের লাখ-কোটি টাকার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার অবদান যতই থাকুক না কেন তা অবৈধ, নাপাক! একজন হাজি সৎ রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এই অবৈধ অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা না করে বরং ঘৃণা প্রদর্শন করা উচিত। তা না হলে আমাদের উন্নয়নের বরকত কেন উধাও হয়ে যায়? আমাদের সোনার দেশের সোনার ছেলেরা বর্তমানে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছেড়ে কোন অশান্তিতে পিষ্ট হয়ে ভূ-মধ্যসাগরে রিফিউজি হয়ে বার বার সাগরডুবিতে মারা যায়?
সেজন্য লাগামহীন দুর্নীতি কমানোর জন্য জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা নামক যে জোর প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে সেটাই থাক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পিছু না আসে সেজন্য সবাই নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করুন। আশা করা যায়, কালো টাকা সাদা করার প্রচেষ্টা থেকে সরে এলে শান্তি আসতে পারে। আমাদের হতাশা ও অস্থিরতা বেড়েছে, শান্তি কমে যাচ্ছে দিন দিন। এদিকে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইপির প্রতিবছরের মত এবারের রিপোর্টে প্রকাশ- ২০১৮ সালে বিশ্ব শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২ থাকলেও ২০১৯ সালের জুনে এসে তা ৯ ধাপ পিছিয়ে ১০১তম হয়েছে। বিশ্ব শান্তি সূচকে এক বছরে নয়ধাপ অবনমন আমাদের দেশের জন্য ভয়ংকর অশনিসংকেত।
কালো টাকা প্রতিবছর সাদা করার ঘোষণা দেওয়াটা আমাদের দেশের মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা দেশে হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদেরকে আরও বেশি উৎসাহ দিচ্ছে এবং দুর্বৃত্তপরায়ণাতাকে শক্তিশালী করে তুলছে। তার প্রমাণ ২০২৪ সালে শুরুতে কেতাদুরস্ত সরকারি -বেসরকারি কুম্ভীলকদের ভয়ংকর রকম চুরি-ডাকাতির ঘটনা ফাঁস হওয়া ও তাদেরকে ক্ষমতাধর মহারথীদের যাদুমন্ত্রের কারসাজিতে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেওয়া। এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে চপেটাঘাত করেছে, চরম আয়বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে এবং গণদারিদ্র্যকে আরও বেশি ঘনীভূত করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এটা কোন কোন ভণ্ড মুসলিম নামধারীদের নীতি হলেও দেশের আপামর প্রকৃত মুমিন-মুসলিমদের আর্থিক নীতি হতে পারে না।
এবারের বাজেটে ডিভিএস বা ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করে অপ্রদর্শিত আয় বা দুর্নীতির কালো টাকা দিয়ে ফ্লাট, অ্যাপার্টমেন্ট, জমি কেনা ইত্যাদি বৈধ করার ঢালাও সুযোগ সত্যিই হতাশাজনক। এটা সুনাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের সরকারি নির্দেশনা যা সংবিধানের (২০) অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে। তাই এ বাজেট জনবান্ধবব না হয়ে দুর্বৃত্তবান্ধব বটে। এটা সুশিক্ষা, নৈতিকতা ও মানব উন্নয়নেরও পরিপন্থি। তাই আমাদের আগামীর চরিত্রবান প্রজন্মের তাগিদে এই ভিনদেশী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ধারক অশুদ্ধ-পাপী নীতি এখনই পরিহার করা প্রয়োজন।
কালো টাকা মানুষ ও রাষ্ট্রের অশান্তির মূল কারণ-সেটা ঘরে হোক বা বাইরে হোক। অর্থনীতির ভাষায় যিনি যতই জোর গলায় কালো টাকা সাদা করার সাফাই গেয়ে যুক্তি দিন না কেন- গোয়ালা গাভির দুধ দোহনের সময় এক বালতি দুধে এক ফোঁটা প্রস্রাব যদি অসাবধানতাবশত: ছিটকে পড়ে তাহলে একজন পবিত্র মানুষ কি জেনেশুনে সেটা পান করতে চাইবেন?
এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দেশের বৈধ করদাতাকে আরও বেশি নিরুৎসাহিত করবে, সৎ মানুষের সাদা মনকে ভেঙে চুরমার করে দেবে ও সামাজিক ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করে তুলবে। তাই অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে দেশের সব মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য আত্মিক ও নৈতিকতা জোরদার করণ কর্মসূচি নিয়ে আজকেই নতুন সৎ ভাবনা শুরু করা দরকার। সভ্যতার ডিজিটাল ও গতিশীল জাগরণের যুগে মানুষ আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না।
দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে কর্মকানণ্ডের জোয়ারে জিইয়ে আছে ভয়ংকর মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। তারা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স কি তারা নিছক ভাঁওতাবজিতে পরিণত করে আরও বেশি পাপ করতে চায়? নাকি তারা বরেরও মাসি কনেরও পিসি? এসবের উত্তর দেবার সময় এখনই ।
ইসলাম ধর্মে কালো টাকা পাপের সঙ্গে তুলনীয় কারণ, এটা ইসলামের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে যায়। ইসলামে নৈতিকতা ও সততার গুরুত্ব অপরিসীম। কালো টাকার ব্যবহার ও উপার্জন অসততা ও নৈতিকতার অভাবের পরিচায়ক। কালো টাকার ব্যবহারে কোন জীবনেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত কর বৈধ উপায় নেই। এ টাকা দিয়ে দান ও যাকাত কার্যকর হয় না। ইহকাল বা পরকালে কালো টাকা ব্যবহারকারীদের জন্য তা শুধু ঘৃণা ও পাপ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
যেমনটি আজকাল আমরা বিভিন্ন মেগা দুর্নীতিবাজদের কথা পত্রিকার শিরোনামে লক্ষ্য করে যাচ্ছি ও ঘৃণা করছি। কারণ, কালো টাকা হলো সেই অর্থ যা অবৈধভাবে উপার্জিত বা কর ফাঁকি দিয়ে জমা করা হয়েছে এবং সরকারি আর্থিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম, যেমন দুর্নীতি, কর ফাঁকি, অবৈধ ব্যবসা, মাদক পাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অন্যান্য অনৈতিক কাজের মাধ্যমে কালো টাকা অর্জিত হয়। কালো টাকা সব সমাজেই দুর্নীতির আঁতুড় ঘর।
কালো টাকা সাদা টাকা-তা বললেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। আমরা সবাই পাপীকে ঘৃণা করছি, পাপকে ঘৃণা করছি না কেন? তাই একটি ন্যায়ানুগ সরকার ও দেশের সাদা মনের নিষ্পাপ মানুষদের উচিত কালো টাকা থেকে দূরে থাকা এবং এই টাকার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd