দেশে অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। পেশাভিত্তিক সুরক্ষা ও যথাযথ সচেতনতার অভাবে মৃত্যুর এই মিছিল থামছেই না। ইংরেজি বছরের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে পুরাতন বছরের গ্লানি কাটিয়ে নতুন বছরে নতুন আশায় যখন মানুষ বুক বাধছিল সেই রকম একটি সময়ে প্রত্যন্ত গ্রামে এক মর্মান্তিক ঘটনার খবর বিষাদে আচ্ছন্ন করলো।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চার্জ দিতে গিয়ে শনিবার (৩০ ডিসেম্বর ২০২৩) ময়মনসিংহের নান্দাইলের চন্ডিপাশা ইউনিয়নের ঘোষপালা গ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যুর খবর জানতে পারলাম আমরা। বার্তা২৪.কমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মর্মান্তিক এই ঘটনায় অটোরিকশাচালক জামাল উদ্দিন, তার বৃদ্ধা মা আনোয়ারা বেগম, জামালের দুই শিশু কন্যা আনিকা ও ফাইজার মৃত্যু (৬) ঘটে।
এই দুর্ঘটনায় একদিকে যেমন পুরো একটি পরিবার স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে গেল, তেমনি এ ঘটনা আরও বহু দুর্ঘটনার শঙ্কাকেও প্রবল করে তুললো। খবরে প্রকাশ, অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে অসাবধানতায় বিদ্যুতায়িত হন জামাল উদ্দিন। তার আর্তচিৎকার বৃদ্ধা মা ও ২ মেয়ে এগিয়ে এসে রক্ষা করতে গেলে তারাও বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। পরিণাম-সকলের মৃত্যু।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রয়েছে, যেগুলোকে কোনো আইনি বৈধতা দিতে না পারায় সরকারি ভাষ্যে অবৈধ যান হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় ও প্রত্যক্ষ শ্রম এড়িয়ে যাত্রী পরিবহনের সুবিধা থাকায় এই বাহনটির জনপ্রিয়তা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে খোদ রাজধানীতেও রয়েছে। আমরা যদি ধরে নিই, প্রতিটি অটোরিকশার জন্য একজন চালক আছেন, সেই হিসাবে জামাল উদ্দিনের মতো ৬০ লক্ষাধিক অটোচালক রয়েছেন। এই সংখ্যক অটোচালক থাকলে তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্য ও অটোরিকশার মালিক, উৎপাদকসহ সংশ্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা কোটির ওপরে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুল সংখ্যক অটোরিকশার জন্য দিনে ৫শ’ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রতিটি অটোরিকশায় দিনে অন্তত ৫ ইউনিট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। একদিকে যেমন অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে অটোরিকশা চার্জ দেওয়ার খবর আসছে গণমাধ্যমে, তেমনি এই বিপুল পরিমাণ অটোরিকশা থেকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটও অনেক বিস্তৃত। সরকার এই সংক্রান্ত ব্যাটারি আমদানি, বিক্রয়ের অনুমতি দিলেও সার্বিকভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকাকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
অবৈধ ব্যবহারের বিদ্যুৎ বাবদ এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারী নিয়মিত মাসোহারা আদায় করলেও সরকারি খাতায় সিস্টেম লস হিসেবে দেখানোর প্রামাণ্য তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে। বিদ্যুৎনির্ভর এই যানটি চার্জ দেওয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক নিরাপদ সিস্টেম প্রচলনের কোন প্রচেষ্টাও আমরা দেখছি না। কিছু সংখ্যক মানুষ নতুন উদ্ভাবিত এই ধরণের যান পরিচালনা ও বাজারজাত করে বিপুল বৈভবের মালিক বনে গেলেও চালক হিসেবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে কয়েক ধাপে অনিরাপদে রাখা হয়েছে। চাঁদাবাজির টুলস হিসেবে ব্যবহার করলেও একে একটি স্বীকৃত-নিরাপদ কাঠামোর মধ্যে কেন এই দীর্ঘ সময়েও আনা গেল না, সেটি বড় প্রশ্ন।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চার্জ দেওয়া ও পরিচালনার জন্য যদি একটি বিজ্ঞানসম্মত নিরাপদ ব্যবস্থাপনা আমরা গড়ে তুলতে পারতাম এবং এই বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব হতো তাহলে ঘোষপালায় সংঘটিত বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একটি দরিদ্র পরিবারের ৪ সদস্যের এই অপমৃত্যুর ঘটনা হয়তো দেখতে হতো না।
রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও ব্যর্থতায় একটি পরিবারের এভাবে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার এই দায় কিছুতেই তারা এড়াতে পারেন না। সেই সঙ্গে এক কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই খাতটি এভাবে আর কতদিন অনিরাপদ ও অপরিকল্পনায় ফেলে রাখা হবে-সেই জিজ্ঞাসা আমাদের। বছর শেষে নতুন প্রত্যাশায় যে ইংরেজি নববর্ষকে আমরা বরণ করতে চলেছি সেই বছরে আমরা এমন অপঘাতে মৃত্যু আর দেখতে চাই না। রাষ্ট্র এবিষয়ে সচেষ্ট হোক।