যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শুনলে বাংলাদেশকে কি ধরণের সমস্যায় পড়তে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন, ‘এমন প্রশ্নে সুবীর ভৌমিক বলেন, ‘মার্কিনিদের তৎপরতা-অপতৎপরতায় পরিণত হয় আর অপতৎপরতার পরবর্তী যে স্টেজটা সেটা সার্বিক গোলোযোগ। এই জিনিসটা ভারত মেনে নেবে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। প্যালেস্টাইনে কি হয়েছে ভারতের কাছে সেটা অনেক দূরের ব্যাপার। বাংলাদেশ তো ভারতের পেটের মধ্যে। এখানে একটা ক্যাওয়াটিক সিচুয়েশন তৈরি হবে একটা মারামারি দাঙ্গা হাঙ্গামা, জামায়াত-বিএনপি রাস্তাঘাটে মারকাট…ভারত এটা চায় না।
ভারত কি চায়? ভারত আমেরিকাকে বলেছে, গণতন্ত্রের নামে অগতান্ত্রিকভাবে রাস্তায় নেমে হিংসাত্মক আন্দোলন করে একটা সরকার ফেলা-এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত সেটা গেল জি২০ সামিটে যখন শেখ হাসিনা এসেছিলেন আলোচনায় সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনাকে ভারত যা বলেছে তা হচ্ছে-নির্বাচনটা সঠিকভাবে করা, তারপর আমেরিকাকে ভারত বুঝে নেবে। প্রশ্ন হচ্ছে-আমেরিকাকে ইন্ডিয়া কি করে বুঝে নেবে? চীনের এগেইনস্টে যদি এশিয়াতে আমেরিকাকে পাঞ্জা কষতে হয় আমেরিকাকে কাকে সঙ্গে নিতে হবে? ইন্ডিয়াকে। আমাদের যেমন আমেরিকার সাপোর্ট দরকার চীনের সঙ্গে বুঝতে গেলে, আমেরিকাকেও দরকার ইন্ডিয়াকে চীনের সঙ্গে বুঝতে গেলে। ইটস এ্য মিউচ্যুয়াল থিংক। উই নিড দেম দে নিড আস…ইন্ডিয়া ইজ নট এক্সাক্টলি মালদ্বীপ অর শ্রীলঙ্কা। আমেরিকা ক্যান নট ডিক্টেট আস..রিসেন্টলি একাধিক ক্ষেত্রে আপনি দেখেছেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুখের ওপরে যেভাবে কথা বলেছেন, এভাবে পৃথিবীতে কেউ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলে না। তার দুশমনরা ছাড়া।’
যেভাবে দেখছেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা
ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান এই তৎপরতা নিয়ে সরব বাংলাদেশের কুটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও। সামরিক বিশ্লেষক ও ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইসিএলডিএস) এর নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ (অব.) এবিষয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে চীনের স্ট্রাটেজিক ইনিশিয়েটিভস যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক তৎপরতা দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে সেরকম পরিস্থিতি-পরিবেশ তৈরি হয়নি। চীনের আধিপত্য বিস্তার রোধ করার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি এখনো উঠে আসেনি…সে রকম অবস্থার অবতারণা হয়নি। এখানে নিঃসন্দেহে যেটা হচ্ছে সেটি হলো-চীনকে মোকাবিলা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বা এই অঞ্চলে তেমন কোন বন্ধুরাষ্ট্র এই মুহুর্তে নেই। তাদের সবশেষ ফুটপ্রিন্ট ছিল আফগানিস্তানে, সেখান থেকে তাদের চলে যেতে হলো। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ গড়ে উঠার চেষ্টা দেখেছি আমরা। সেখানে বিভিন্ন রকম চুক্তির মাধ্যমে ভারতের নৌবন্দর ব্যবহার, ভারতের সামরিক ঘাটি ব্যবহার করার এবং তথ্য আদানপ্রদানের চুক্তি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি, ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার যে অতীতের সম্পর্ক আছে সেখানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার কখনোই যাবে না। সেখানে তাদের একটি বিকল্প লাগবে।’
জেনারেল রশীদ বলেন, ‘সেখানে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে বাংলাদেশ হচ্ছে চীনের খুব কাছের দেশ এবং এটি হচ্ছে ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গপোসাগর হয়ে এখানে একটি বড় ধরণের সমুদ্রের একসেস আছে। সেই জন্য বাংলাদেশের প্রতি তাদের চোখ রয়েছে। এখন বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতির বিষয়টি বা চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যববহার করার বিষয়টি করতে হলে তাদের কতগুলো চুক্তি লাগবে। সেই চুক্তির ব্যাপারে সর্বশেষ ভারতের একজন সাংবাদিক উল্লেখ করেছেন। এ চুক্তি করার জন্য ভারতের ওপর চাপ রয়েছে। এবং অতীতেও আমরা দেখেছি সোফা, সাফটা এরকম নামে বাংলাদেশের তাদের যে প্রবেশ বা উপস্থিতির নিশ্চয়তা বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, চীনকে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে এরকম প্রস্তুতির পর্ব হিসেবে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে সেই চুক্তিগুলি সাক্ষর করার জন্য। এই অঞ্চলে মূল বিষয়টি হলো…চীনের ভৌগলিক কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেটি হচ্ছে, সমুদ্রের সঙ্গে তার যে উপকূল খুব ছোট। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে তাদের যখন ভারত মহাসাগরের দিকে আসতে হয় তখন মালাঙ্কা প্রণালী দিয়ে চলতে হয়। চীন স্বভাবতোই যদি মালাঙ্কা প্রণালী কোন কারণে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে চীনের ভারত মহাসাগরে ঢোকার আর কোন দ্বিতীয় বিকল্প নেই। তার সবেচেয়ে বেশি হলো আমদানিকৃত কাঁচামাল বৃহৎ অংশ আসে আফ্রিকা থেকে। এবং উৎপাদিত ফিনিস প্রোডাক্ট আফ্রিকায় রফতানি রয়েছে। এই জায়গাতে খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা চীনের রয়েছে। চীন এই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য তারা সামুদ্রিক একসেসের জন্য চীনের যে প্রজেক্ট আছে..পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে আরব সাগর হয়ে গোয়াদার পোর্ট ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় তারা এবং সেখানে তাদের তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পাকিস্তান করিডোরের মাধ্যমে তারা পরিকল্পনা যেমন নিয়েছে আবার এদিকে চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর নিয়েও কাজ করছে। তাতে তারা মিয়ানমারের আরাকান বন্দর ব্যবহার করে আরেকটি একসেস করতে চায়।‘
‘স্বভাবতোই নিশ্চিত বিকল্পটা ..এই বিকল্প তৈরি করার যে ব্যয় সেখানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তারা বলছে যা দেখাতে চাইছে, এতে স্থানীয় মানুষের দেশের উন্নয়নের জন্য শুধু রাস্তাই বানাচ্ছে না ইকোনমিক করিডোর নাম দিয়েছে বাণিজ্য, উৎপাদন শিল্পায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। যার ফলে সবাই মনে করছে এই কথা বলে সে দেশের ওপরে একটি ঋণের ভাড় চাপিয়ে দিচ্ছে এবং পরে এই ঋণের পরিশোধের অযুহাতে এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তারটা নিশ্চিত করবে। সেই সম্ভাবনাকে রোধ করতে হলে স্বভাবতোই চীনের আধিপত্য রোধ করতে হবে, খর্ব করতে হবে। সেই খর্ব করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ..মিয়ানমার সরকার বিরোধী একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি গড়ে উঠেছে তাদের ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে চীনের আধিপত্য খর্ব করার। সেই লড়াইয়ে বাংলাদেশের সোনাদিয়া বন্দর তারা বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলাদেশ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি’ উল্লেখ করেন জেনারেল আবদুর রশীদ।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রস্তাবের বিকল্প হিসেবে জাপান এগিয়ে এসেছিল এবং জাপান মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র তা না পাওয়ায় বেশি মিয়ানমার নির্ভর হতে হয়েছে। মিয়ানমার একক নির্ভরতায়, বাংলাদেশে সোনাদিয়া বন্দর না দেওয়া-এই সমীকরণে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানে মোটামুটি বলা যায়, ত্রিমুখী কর্তৃত্বের লড়াই চলছে। যেমন মিয়ানমার সরকার আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে, চীন একদিকে তার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর এমন চাপ বজায় রাখতে চাচ্ছে যাতে চীনের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে। ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এখানে কাজ করছে। এই সমীকরণের মধ্যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা তৈরি হয়েছে। এবং রোহিঙ্গা সমস্যাকে জিইয়ে রাখার প্রবণতা গোপনে কাজ করছে। যার ফলে এতদিনেও রোহিঙ্গা সমস্যার কার্যত কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। কারণ এই সমস্যা সমাধান করলে এই সমীকরণের সঙ্গে এটি যুক্ত। এই যুক্ত থাকার কারণে রোহিঙ্গা সমস্যাকে জিইয়ে রেখে দেশের ওপর একটি চাপ বজায় রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখানে রাশিয়ার উপস্থিতি দেখছি, সামরিক সরবরাহ রয়েছে। তারা মিয়ানমার সরকারকে অনেক আধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে, যা তারা বাংলাদেশে সরবরাহ করেনি।
‘এসইউ৩৫ বাংলাদেশে বিক্রি করা হয়নি, মিয়ানমারকে দেওয়া হয়েছে। তাতে বোঝা যায় বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর সক্ষমতাকে বৃদ্ধির জন্য ওইসব বিমানগুলি ভূমিকা রাখবে। সেই ভূমিকা রাখার কারণে রাশিয়ারও যথেষ্ট স্বার্থের জায়গা দেখছি। আপনি যেটি বলছেন, কনফ্লিক্ট বাড়লে নো ফ্লাই জোনের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। প্রশ্ন হলো আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা এই টানাপোড়েনে অনেক পক্ষই জড়িত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মার্কিন উপস্থিতি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্য। সেই স্বার্থ রক্ষার জন্যই তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশে এই অঞ্চলটাকে চীনের আধিপত্য মুক্ত করার একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। সেই প্রক্রিয়ার সাথে…বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক বহুপাক্ষিক। সেখানে সম্পর্ক থেকে বাংলাদেশ অতি সহজে বেরিয়ে আসবে সেটিও মনে করা যায় না। সেজন্য দেখতে পাচ্ছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্র মানবাধিকার’ নিয়ে যে চাপ প্রয়োগ করছে তা আঞ্চলিক সমীকরণের অংশ।’ (চলবে)
আরও পড়ুন- যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি চায়? বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য