ওদের দেশে সাপ্তাহিক ছুটি শনি ও রোববার। বাকি ছয়দিন ঘড়ি ধরে একটানা পরিশ্রম করার পর ছুটির দিনের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে সবাই। সাপ্তাহিক বেতনও পায় কেউ কেউ। তাই সপ্তাহান্তে সেটা উৎসবে রূপ নেয়। প্রবাসী হিসেবে শুরুতে এসব বিষয়ে হোঁচট খেলেও ক’মাসের মধ্যে নিজেকে অভিযোজন করে নিয়েছে বন্ধু তোজা। ওর পুরো নাম তোজাম্মেল হক। ওর বাবার এদেশে পুরনো গাড়ির ব্যবসার সুবাদে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি হয়ে যায় তোজার। ইয়োকোহামায় পড়াশোনা শেষ করে একসময় তোচিগি জেলায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়। সেখানে বিয়ে করে থেকে যাবার অনুমতি মেলে। দুই যুগ পার হয়ে গেলেও এখনও মাঝে মধ্যে ছুটি কাটাতে দেশে আসে পরিবারসহ। ওদের একটি সন্তান রয়েছে। সে এদেশের ঝাল খাবার খেতে না পারলেও মামে স্যুপ (পাতলা ডাল) তার খুব প্রিয়। কিন্তু গাড়িতে চড়লে বেশ ভয় পায়। কারণ হর্ণের বিশ্রি শব্দ তার অপছন্দ। তাই রাস্তায় নামলেই কানে আঙুল দিয়ে থাকে সে।
তবুও ওরা একটু সুযোগ পেলে প্রতিবছর এদেশে বেড়াতে আসে। তোজার সঙ্গে গল্প করতে বেশ ভাল লাগে। ওর স্ত্রীও আমাদের দেশ নিয়ে অনেক মজার কথা কথা বলে। সে ইসলাম ধর্মের কড়া নিয়ম সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে ফেলেছে। বিশেষ করে রমজানের রোজা শুরু হলে প্রবাসী মুসলমানদের জন্য সে খুশি হয়ে ইফতারির আয়োজন করে তাদের বাসায়। ওদের ধর্মীয় কৃষ্টিতে ‘দানজিকি’ যা আমাদের নিকট রোজা নামে অভিহিত সেটার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই।
একবার ঈদের সময় ওরা এসেছিল বেড়াতে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কেনাকাটার জন্য রাজধানীর একটি সুপার শপ থেকে বেরুনোর পর দেখে- ওর হাত ব্যাগটি কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে ‘সুমিমাছেন’ বা মাফ করবেন বলে চিৎকার করে মনোযোগ আকর্ষণ করলেও কেউ তাতে সায় দেয়নি। এরপর থেকে ঢাকার রাস্তার ভয়ংকর পরিবেশ নিয়ে তার ভয়। এমনকি মুসলমান সম্পর্কে তার ধারণা পাল্টে গেছে। সে এতদিন মনে করতো সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত প্রভৃতি মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশের রাস্তায় কোন চুরি, হাইজ্যাকিং হয় না। কারণ, ইসলাম ধর্মে চুরি করা পাপ। সৌদি আরবে চুরি করলে হাত কেটে দেয়ার নিয়ম। তাই হয়তো কেউ চুরি করে না। ওদের দেশে সাধারণত: মালিককে জিজ্ঞেস না করে কেউ কারো জিনিস স্পর্শ করে না। ব্যাগ খুঁজে না পেয়ে সে খুব মন খারাপ করেছিল। তোজা তাকে বুঝিয়ে শান্ত করেছে। সে বলেছে, মুসলিম জনগণ হলেও সেখানে নানা কারণে চুরি-হাইজ্যাকিং হতে পারে।
তবে জাপানের মতো উচ্চ আয়ের দেশে মানুষের মূল্যবোধের মধ্যে সামাজিক অপরাধ বা অন্যায় না করার শিক্ষা গেঁথে গেছে। তারা মুসলিম না হলেও পক্ষান্তরে ইসলামের নিয়মকেই অক্ষরে অক্ষরে অনুশীলন করে। সে ওকে বুঝালো, আমাদের দেশে মানুষগুলো মুসলিম, আর তোমাদের দেশের মানুষগুলো মুসলিম না হয়েও কার্যত: মেনে চলে ইসলামের নিয়ম-কানুন। আমরা ইসলামের অনুসারী আর তোমরা ইসলামের অনুশীলনকারী। কি চমৎকার ব্যাপার তাই না? একবার মনে হলো, ‘আমি কারে কি-বা বলি ওরে’ লালন ফকিরের গানটা ওকে শোনাই। পরক্ষণে মনে হলো- এত কঠিন আধ্যাত্মিক গান শুনে সে কিছুই বুঝবে না হয়তো।
তোমরা ওপেন প্লেসে মদ খাও, সেটা তোমাদের আইন মেনে। আমাদের দেশে সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষেধ। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু মানুষ চুরি করে মাদক ও মদের ব্যবসা করে আর কিছু মানুষ চুপিসারে কিনে খায়।
এটা তোমাদের সঙ্গে আমাদের একটা বড় পার্থক্য। আর চুরি, দুর্নীতি, মিথ্যা, গুম, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, বাটপারি, জালিয়াতি ইত্যাদির ব্যাপারে তোমাদের আইন কড়া হলেও দুর্নীতির কারণে আামাদের দেশের আইনের প্রয়োগ শিথিল। এদেশে আইনের গিরো ফস্কে বের হওয়া যায় এবং সেজন্য সামাজিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ খুব কম। অর্থাৎ, আমাদের আইন কাগুজে আর তোমাদের আইন বাস্তব দণ্ডে। একটা ঘটনা ঘটলে তোমরা তোলপাড় করো। আর আমাদের দেশে প্রতিদিন এসব ঘটনা ঘটে। সামান্য তোলপাড় হলেও আবার একই অপরাধ ঘটতে দেওয়া হয়।
পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন এত দু:সংবাদ দেখতে আর ভাল্লাগে না। এসব সংবাদের প্রধান কারণ খতিয়ে দেখেলে অপরাধ ধেয়ে আসে। এর বেশিরভাগ অপরাধ আমাদের ক্রমাগত জিইয়ে থাকা আর্থ-সামাজিক সমস্যা থেকে উদ্ভূত। দারিদ্র, বেকারত্ব ও দুর্নীতি সঞ্জাত আর্থিক বৈষম্য বহু অপরাধকে উস্কে দিয়ে সমাজকে করছে ভঙ্গুর। এই ভঙ্গুর সমাজ ও অর্থ-ব্যবস্থায় নিষ্পেষিত অবহেলিত মানুষের অনেকেই নিজ ক্ষমতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে অক্ষম। জীবন-জীবিকার তাগিদে তাদের অনেকেই প্রচলিত অপরাধীদের খপ্পরে পড়ে একসময় পেশাদারী ও ভয়ংকর হয়ে উঠে সমাজ, পরিবেশ, নৈতিকতা এমনকি ধর্মীয় শিল্ড ভেঙে চারদিক অশান্ত করতে দ্বিধা করছে না।
অথচ, আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯৩.৭ ভাগ মুসলমান। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে সকল শাসকগণ মুসলমান ছিলেন। এখনও তেমনি রয়েছেন। তারা মনে-প্রাণে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলেন। নামাজ আদায় করেন, রমজানে রোজা রাখেন, যাকাত, ফেৎরা নিয়মিত আদায় করে থাকেন। আমরা সাধারণ মানুষগুলো সেরূপ ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলে। এসব ইসলামী ব্যবস্থা মেনে চলা মানুষদের দেশে কোন স্বেচ্ছা-অপরাধী টিকে থাকতে পারাটা বিস্ময়কর।
কিন্তু প্রতিদিন অবাক বিস্ময়ে তার উল্টো চিত্র অবলোকন করতে হচ্ছে। সামাজিক অপরাধের ব্যাপ্তি ও ধরণ দিন দিন যেভাবে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে তাতে প্রচলিত নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনেকটা দুর্বল ও অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হতে চলেছে।
কারণ, প্রচলিত সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলে সেই দুর্বল অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে লোভী পেশীশক্তি। তাদের অপশক্তিকে খর্ব করে নতুন সেবাদান ব্যবস্থা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার মতো সাহস সেবাপ্রদানকারীদের হয়ে উঠে না। তারা পথেই অপশক্তির মায়জালে বন্দী হয়ে পিছুটান দিতে বাধ্য হন। ফলে গৃহীত নতুন নীতি, পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখতে পায় না। যাদের জন্য সেসব গৃহীত হয় তারা সেসবের খবর সঠিকভাবে জানতে পারে না।
এভাবে চিত্রটা হয়ে যায় বিপরীতধর্মী। তাহলে এই হিমবাহ ভাঙবে কে? এই সুকঠিন হিমবাহ ভাঙার মতো নৈতিক শক্তিধর মানষের বড় অভাব।
বছর ঘুরলেই প্রতিবার ঘুরে-ফিরে একই আলোচনা করি, একই মতামত ব্যক্ত করি। একই নীতি গ্রহণ করি। এজন্য নানা কর্মসূচিও নেওয়া হয়। কিন্তু ইতিবাচক পরিবর্তন বলতে যা বুঝায়-তা হয় না। অর্থের খরচ মেষে অপচয়ের সন্ধান খুঁজে পাওয়া গেলেও সেটাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। এজন্য অনেকে মুখ বুঁজে সহ্য করে, কেউ কেউ মোটেও গ্রাহ্য করে না।
তাইতো- জিরো টলারেন্সের কঠোর বার্তা আবারও চেনা ডিজিটে উঠে যায়। বড় বড় মহারথীরা উল্টো কথা, উল্টো কাজ করে পার পেয়ে যাবার উদাহরণ থাকায় সাধারণ মানুষ নৈতিকতার ধার ধারে না।
নৈতিকতা সাধারণত: দু’ভাগে বিভক্ত। একটি হলো সেক্যুলারিজমের নৈতিকতা অন্যটি ইসলামের বা ধর্মীয় নৈতিকতা। বিশ্বের যেসব রাষ্ট্র নিজেদেরকে কল্যাণরাষ্ট্রের মর্যাদায় নিয়ে মানুষের মৌলিক ও অন্যান্য অধিকারগুলো হাতে পৌঁছিয়ে দিয়ে পরিচিতি লাভ করেছে তাদের বেশিরভাগই সেক্যুলার নৈতিকতায় বিশ্বাসী। তবে তারা হঠাৎ করে সেই অবস্থানে উঠে যায়নি।
নিজেরা পড়াশোনা ও গবেষণা করে সেই পর্যায়ে যাবার পথ খুঁজে পেয়েছে। কারণ, আমরা জানি কল্যাণ রাষ্ট্র ধারণা একদিনে বিকশিত হয়নি। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ এবং উপকার করার দায়িত্ব নিয়ে কিছু উদার মনের মানুষের কল্যাণকামী ধারণা ও সেবা এ ব্যাপারে জ্ঞানের খোরাক যুগিয়েছে।
মানবতা ধারণার মধ্যে দায়িত্ববোধ জড়িত। সেক্যুলারিজমের নৈতিকতা দিয়ে এই ধরনের মানতাবোধে মানুষকে উজ্জীবিত করা গেলেও সেটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। কারণ এটা আইনের অনুশাসন ও বাস্তবায়নের তৎপরতার উপর নির্ভরশীল। পাহারাদার পাশে না থাকলে এবং বিদ্যুৎ চলে গেলে এটা ঠিকভাবে কাজ করে না।মানবতাবোধ থাকলে একজনের এত সম্পদ থাকতে পারে না। সেজন্য সম্পদের হিসাব ও অপরকে বা বঞ্চিতজনকে সেটার নির্দিষ্ট অংশ বন্টনের কথা বলা হয়েছে। এটা মানুষের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে বিধায় আইনের অনুশাসন ও বাস্তবায়নের তৎপরতার উপর নির্ভরশীল নয়। পাহারাদার পাশে না থাকলে এবং বিদ্যুৎ চলে গেলেও কেউ দোকানের মালামাল সটকায় না। তাই সবসময় এটা ঠিকভাবে কাজ করে।
যে অপরের কাছে ঠকে সে নিরুপায় হয়ে ঠকে। যে অপরকে ঠকায় সে প্রতারক। এগুলো ধর্মীয় নৈতিকতা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা যেতে পারে। এজন্য প্রতিটি শিক্ষার সাথে নৈতিকতা এবং প্রতিটি নৈতিকতাকে আরও বেশি বলিয়ান করার জন্য ধর্মীয় নৈতিকতাকে সংযুক্ত করে শাণিত করা দরকার। তাহলে অন্ধকার দেখেও কেউ অপরাধ করবে না। পাহারাদার না থাকলেও কেউ চুরি-দুর্নীতি করতে অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে না।
দুর্নীতি নির্মূলের আসল কৌশল কী? এটাই এই মুহূর্তের বড় প্রশ্ন। সব ওঝার কাছে সরিষার মধ্যে ভূত থাকায় এই প্রশ্ন দিন দিন জটিল আকার ধারণ করে চলেছে। সরিষার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ভূতের কারণে আমরা সবাই নাজেহাল হই। জনগণ কাজের ইতিবাচক ফলাফল থেকে বঞ্চিত হয়েই যাচ্ছে। এসব ভাবলে বার বার শুধু তোজাম্মেলের বিদেশিনী স্ত্রী নাওসানের ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনাটা মনে পড়ে। আর ‘আমি কারে কি-বা বলি ওরে.. লোকে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে’ গানটা শোনাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তা পারি না।
দেশের কল্যাণ কামনা ও দুর্নীতি এই দুটো বিষয় একইসঙ্গে থাকাটা সাংঘর্ষিক। কিন্তু এদেশে সেটাই যুগ যুগ ধরে একত্রে চলছে। আমাদের চারিত্রিক অধপতন ও নৈতিক বৈপরিত্যটা সেখানেই প্রোথিত। সেজন্য আমাদের দেশে নামধারী মুসলিম, আর ওদের দেশে মুসলমান না থেকেও ইসলামের নিয়ম কানুন মেনে গড়ে তোলা হয়েছে আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য ও মনো:-পারিবেশিক শান্তির আবহ।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।