জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' বইগুলোর পাঠকমাত্রই জানে তার জবানিতে জীবনের কিয়দংশ। বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন বলে কিছুটা গ্রন্থিত, যেখানে ছিল এক সৎ লেখকের প্রকাশ। বাকিদের যারা লিখেছেন তাদের কেউ কেউ সত্য বয়ানের চেষ্টা করেছেন, অনেকেই অন্য কিছু। এই অন্যকিছুর চেষ্টা অথবা অপচেষ্টায় ছিলেন তারা নিজেদের সৎ ইতিহাসকথক অথবা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, অন্তত এই ক্ষেত্রে। সততাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াদের যথারীতি আক্রোশ বিদ্যমান, যা মূলত 'পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ কেন' শীর্ষক প্রশ্ন থেকেই উদ্ভূত।
১৯২০ থেকে ১৯৭৫; বঙ্গবন্ধু বেঁচেছিলেন ৫৪ বছর ৫ মাস। মাত্র সাড়ে ৫৪ বছরের জীবনে কেবল জেলখানাতেই কেটেছে তার ৪ হাজার ৬৮২ দিন। ৫৪ বছর দীর্ঘজীবন নয়, কিন্তু এরমধ্যে পৌনে তেরো বছরের বেশি সময় কারাগারে কাটিয়ে দেওয়া ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ শাসনে সাত দিন, বাকিটা পাকিস্তানের শোষণের সময়। কারাগারে যাওয়ার কারণ বাঙালির স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর মুক্তি। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করে দেওয়ার অদম্য বাসনা ছিল তার, তাই জীবনের সোনালী সময়ের সবটুকুই বিসর্জন দিয়েছিলেন তিনি দেশের জন্যে।
শেখ মুজিব জন্মেছিলেন ব্রিটিশ শোষণের কালে। তার কারাজীবনের প্রথম বছরটা ছিল ১৯৩৮, যখন তিনি স্কুলছাত্র। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থে উল্লিখিত আছে কারাগমনের সে ইতিহাস। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সে ঘটনার বয়ান আছে সে বইয়ে। কারাগমনের আগ মুহূর্তে যখন তার বাড়িতে পুলিশ যায় তখন পুলিশের উপস্থিতি তথ্য জেনেও পালিয়ে যাননি। গ্রেফতারি পরোয়ানা নিজে দেখে পুলিশের সঙ্গে গিয়েছিলেন তিনি। গ্রেফতার মুজিব পুলিশ কর্মকর্তার ধমকানো সত্ত্বেও ভড়কে না গিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।
'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থে বিষয়টি এসেছে এভাবে--"...কোর্ট দারোগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। আমাকে দেখে বলেন, 'মজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না'। আমি বললাম, 'বাজে কথা বলবেন না, ভালো হবে না'। যারা দারোগা সাহেবের সামনে বসেছিলেন, তাদের বললেন, 'দেখ ছেলের সাহস'। আমাকে অন্য সকলে কথা বলতে নিষেধ করল। পরে শুনলাম, আমার নামে এজাহার দিয়েছে এই কথা বলে যে, আমি ছোরা দিয়ে হত্যা করার জন্য আঘাত করেছি। তার অবস্থা ভয়ানক খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে রমাপদের সাথে আমার মারামারি হয় একটা লাঠি দিয়ে, ও আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করলে আমিও লাঠি দিয়ে প্রত্যাঘাত করি। যার জন্য ওর মাথা ফেটে যায়। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী] এই ঘটনা বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফরকে কেন্দ্র করে যেখানে কংগ্রেস লোকজন বাধা দেওয়ার চেষ্টায় ছিল, এবং শেখ মুজিব ছিলেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠক। মুজিবের নেতৃত্বগুণের প্রকাশ সেই স্কুলজীবন থেকেই, এবং সে নেতৃত্বগুণের কারণে অন্যায় না করা স্বত্ত্বেও তাকে জেলেও যেতে হয়েছিল। গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে সরাসরি 'না' করেছেন ব্রিটিশদের পোশাকি বাহিনীকে ভয় না করেই।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়ায় তিনি জেলে গেছেন ১৮ বার। তার মধ্যে দুই-দুইবার হাজারের বেশি দিন টানা জেলখানায় কাটিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারির পর বঙ্গবন্ধুকে একটানা ১১৫৩ দিন কারাগারে আটকে রাখা হয়, বছরের হিসাবে যা তিন বছরেরও বেশি। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টানা ১০২১ দিন কারাগারে কাটান তিনি। এছাড়াও আছে টানা একবছর, দুইবছরসহ নানা মেয়াদের কারাবাস।
মাত্র ৫৪ বছরের জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় যদি কারো কারাগারে কাটে তবে বাকি থাকে কী? এই প্রায় সংক্ষিপ্ত জীবনের মাঝেও আছে আবার শৈশব-কৈশোরকাল; পরিণত বয়সের যেটুকু বাকি থাকে সেখানে কি স্মরণীয়-বরণীয় হওয়ার সুযোগ থাকে? স্বাভাবিক কিছু হলে উত্তর হয়তো কঠিন, কিন্তু শেখ মুজিব বলেই সম্ভব হয়েছে তা! হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব, অদম্য নেতৃত্বগুণে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটা জাতিরাষ্ট্র। পেয়েছেন অমরত্ব।
মানুষের জন্যে জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে দিয়ে আত্মদানের অমর ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। বারবার কারাগারে গেছেন, নির্যাতন সয়েছেন, পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকিতে রেখে দেশের মানুষের স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর মুক্তির কথা বলে গেছেন। মৃত্যুর মুখে পড়েছেন দুইবার, তবু লক্ষ্যচ্যুত হননি। 'দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ' ছিল তার আজন্ম পণ, আর সেই পণ পূরণ করতে পেরেছিলেন তিনি।
আত্মোৎসর্গের ইতিহাস রচনা করলেও তিনি বিশ্বাসঘাতকেরা গুলি চালিয়েছে তার বুকে। মুজিবের ত্যাগে-ঘামে জন্ম দেওয়া বাংলাদেশ থেকে তাকে ও তার পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে তারা। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট কিছু বিপথগামী সেনা অফিসার শেখ মুজিব নামের বাঙালির মহানায়ককে গুলিতে হত্যা করে। হত্যা করে ঢাকায় থাকা তার পরিবারের সকল সদস্যকে।
সাড়ে চার হাজারেরও বেশিদিন কারাগারে রেখে, দুই-দুইবার হত্যার প্রস্তুতি নিয়েও যাকে হত্যা করতে পারেনি পাকিস্তানিরা সেই মুজিবকে, সেই বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালি জাতির পিতাকে তারই গড়া বাংলাদেশে হত্যা করেছে বাংলাদেশবিরোধী শ্বাপদেরা; এরচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা, এরচেয়ে বড় কলঙ্ক আর কী হতে পারে! বাঙালির জীবনে পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট কলঙ্কের দিন, শোকের দিন, লজ্জায় অবনত-মস্তকের দিন।
বঙ্গবন্ধুর শারীরিক প্রস্থানের সাতচল্লিশ পেরিয়েছে। তবে তিনি আছেন এখনও বাঙালির হৃদয়ে, বাংলাদেশের মানচিত্রে। তার দৈহিক মৃত্যুতে আদর্শের মৃত্যু হয়নি। পনেরো আগস্ট দিনটি কেবল স্মরণের নয়, দিনটি মুজিব-চর্চার শপথের দিনও।
সাংবাদিক, কলাম লেখক