কিছুদিন আগে একজন আইনজীবীর সহকারী জাল টাকা সরবরাহের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি জালটাকা তৈরির কাজেও নেমে পড়েছিলেন। জানা গেছে, তিনি একজন জাল টাকার আসামির জামিনের জন্য কাজ করছিলেন। পরে সেই আসামির নিকট থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেই জাল টাকা তৈরির কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
সম্প্রতি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও ব্যাংকার সমন্বয়ে একদল জাল টাকা তৈরিকারী চক্র গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন -তিনি প্রতিমাসে ৬০ লাখ জাল টাকা বিক্রি করার জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। তাদের জাল টাকা তৈরি ও সরবরাহ কাজে এক বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এ কাজে সমাজের হোমরা-চোমড়া, মাদক ব্যবসায়ী, দামি মানুষ হিসেবে পরিচিত অথচ ভয়ংকর অপরাধী জড়িত রয়েছেন। কিছু মহিলা খুব সন্তর্পণে তাদের সঙ্গে জাল টাকা ছড়িয়ে দেবার কাজ করে থাকে। এ কাজে পুলিশ সদস্য, ব্যাংক কর্মকর্তা (প্রথম আলো ২৮.০৭.২০২২) ও সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা জড়িত থাকায় সন্দেহ করার অবকাশ খুব কম থাকে। আর এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে জাল টাকা তৈরি সরবরাহের কাজগুলো খুব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
একসময় সাদা কাগজে জাল টাকা ছাপানো হতো। এখন ‘ওয়াশ নোট’ বেশি প্রচলিত। কারণ ওয়াশ নোটে সাইজ নিয়ে সমস্যা হয় না এবং সুতা, জলছাপ ইত্যাদি নতুন করে দিতে হয় না। এছাড়া ওয়াশ নোটের মূল কাগজ শুকানো হলে শক্তই থেকে যায়। সাধারণত: একশত টাকার নোটকে ঘষে ধুয়ে তার ওপর কালার প্রিন্টে পাঁচশত টাকার ছাপ দিয়ে এই নকল ওয়াস নোট তৈরি করা হয়।
কোন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবকে সামনে রেখে জাল টাকা তৈরি ও বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার মহোৎসব শুরু হয়। ঈদের মার্কেট, পশুর হাট, স্টেডিয়ামে খেলা, পাইকারি বাজার ইত্যাদিতে নকল টাকা ছড়িয়ে দেওয়া হয। ভীড়ের সময় তৎপরতা অবলম্বন করা এই চক্রের লক্ষ্য। এসময় তারা একজোট হয়ে ভীড় ঠেলে ব্যস্ত মানুষের মধ্যে আরও বেশি তাড়াহুড়ো করে সমস্যা তৈরি করে ফেলে। এভাবে সময়ের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে জাল টাকা প্রদান করে দ্রুত সটকে পড়ে। তারা একটি আসল টাকার বান্ডিলের মধ্যে অনেকগুলো নকল টাকা ঢুকিয়ে মক্কেলকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। কেউ প্রতিবাদ করলে চক্রের সদস্যরা উপযাচক হয়ে সেটা মিটমাট করার উদ্যোগ নেয় এবং অবস্থা বেগতিক হলে দ্রুত সটকে পড়ে।
টাকা ছাড়াও রুপি, ডলার ও নানা বিদেশি নোট জাল করা হয়ে থাকে। সীমান্ত জেলা ও সীমান্ত হাটে এগুলোর ডিলার থাকে। সেখানে জাল টাকার চলাচল বেশি। জাল টাকা তৈরির উপাদানগুলো খুবই সহজলভ্য। একটি ল্যপটপ বা সাধারণ কম্পিউটার, রঙিন প্রিন্টার, লেমিনেটেড মেশিন, টাকা তৈরির ডাইস, ফয়েল পেপার, কোটিং গাম, সিল্কি কাগজ, স্ক্যানার, সুতা ইত্যাদি জাল নোট তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
জাল টাকা যত অভিজ্ঞ কারিগর দ্বারা তৈরি করা হোন না কেন সেগুলোতে নানা ধরনের খুঁত থাকে। তাই একটু চেষ্টা করলেই আসল ও নকল টাকার মধ্যে পার্থক্য সূচিত করা যায়। জাল নোট চেনার বড় উপায় হলো- এগুলা অসমতল ও এর রং দ্রুত পরিবর্তন হয়। নিরাপত্তা সুতা মোটা। কয়েকবার হাত বদল করলে নিরাপত্তা সুতা বেশি স্পষ্ট দেখা যায়। ওয়াশ নোট ছাড়া অন্যান্য নকল টাকায় এর জলছাপ, অন্ধদের জন্য বিন্দু ও সুইপ ইত্যাদি থাকে না। বাজারের কেনা কাগজের তৈরি জাল টাকা নরম হয়। এসব টাকায় ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে ক্ষুদ্র লুকানো লেখা, নিরাপত্তা সুতা, ছাপানো সীমানায় হেরফের দেখা যায়। জাল টাকা কেন তৈরি হয়? এটা একটা জটিল প্রশ্ন। সমাজে নানা অবক্ষয়ের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তরুণদের বেকারত্ব, অভাব, হতাশা ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করিয়ে থাকে এক শ্রেণির অবৈধভাবে বিত্তশালী হওয়া মানুষ। যারা মাদক ব্যবসার পাশাপাশি সব ধরনের অনৈতিক কাজকে বিকশিত করে তোলে। আমাদের দেশে এই শ্রেণির মানুষের সংখ্য কম নয়।
তারা অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দিনরাত অপতৎপরতার মাধ্যমে নিত্যনতুন ঘৃণ্য মেকানিজম নিয়ে ওৎ পেতে থাকে। এরা পর্নোগ্রাফি, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, কৃত্রিম পণ্যসংকট তৈরি করে ও মাদক ব্যবসাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের অবৈধ মাদক ব্যবসায় আঘাত আসলেই সমাজে অন্যান্য অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে যায়। এগুলোর পাশাপাশি তাদের সীমাহীন লোভ-লালসার ব্যপ্তি সকল অপরাধকে নির্দিষ্ট চক্রের মাধ্যমে উসকে দেয়। এই উসকানির মধ্যে ধরা পড়ে যান বিভিন্ন পেশার সরকারি সেবাদানকারী কর্মচারী ও কর্মকর্তাবৃন্দ। যার কয়েকটি উদাহরণ এই প্রবন্ধের প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এর প্রধান কারণ হলো- আমাদের সমাজে একটি অবৈধ সুবিধাভোগী শ্রেণির দ্রুত বিকাশ ঘটানো। যাদের কাজ হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ব্যবহার করে আরও বেশি দুর্নীতি করা। তারা ব্যাপকহারে চুরি, ঘুষ, জালিয়াতি ইত্যাদিতে অভ্যস্ত। এদের ছদ্মাবরণে জাতি বিভ্রান্ত। তাদের নৈতিক বোধ ও পারস্পরিক সহানুভূতি নেই। এবং তাদের কোন ধর্মীয় শিল্ড নেই। সবকিছুকে নিয়ে মাখামাখি করে চলতে গিয়ে তারা সমাজের সাধারণ মানুষের নূন্যতম অধিকারগুলো হরণ করে নিজেরে উদর পূর্তি করতে সিদ্ধহস্ত।
তাই এদের প্রভাবে আমাদের সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক সমস্যাগুলোর ব্যপ্তি না কমে দিন দিন আরও বেড়ে যাচ্ছে। শুধু গুটিকয়েক পুলিশ দিয়ে সাধারণ মামলা ঠুকে যেগুলো ঠেকানো যায় না। কারণ, এসব জাল টাকার হোতারা জানে আসল টাকা দিয়ে জাল টাকার মামলা কিভাবে মিটমাট করা যায। সেসব মিটমাটকারী চক্র সম্পর্কে তারা বেশ জানে। এজন্যও তাদের নির্দিষ্ট বাজেট রয়েছে। এনিয়ে তারা চক্রের সদস্যদেরকে আগাম আশ্বস্ত করে থাকে। তাই পুলিশি তৎপরতায় তাদের হৃৎকম্প হয় না, ভয়ও পায় না।
জালটাকা আমাদের অর্থনীতির জন্য অভিশাপ। এটা দেশ ধ্বংসকারী তৎপরতা। এই ঘৃণ্য তৎপরতাকে দ্রুত বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষকে বেশি তৎপর হতে হবে। এর জন্য দরকার কঠিন কমিটমেন্ট বা আত্ম প্রতিশ্রুতি।
মাদকব্যবসা ও জালটাকা পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। যারা মাদকব্যবসা, মুদ্রাপাচার, চোরাচালান ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত তারা জাল টাকার চক্রের সাথেও জড়িত। জাল টাকার নির্মাতা ও মালিকদের ঠেকাতে হলে মাদকের আগমন ও বিপণন ঠেকাতে হবে কঠোরভাবে। কৌশলে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দিয়ে মাদকের ব্যবহার বিস্তৃতকারীদেরকে ঠেকাতে না পারলে জাল টাকা তৈরির মতো অপরাধ বাড়তেই থাকবে। জাল টাকার হোতারা বেশ ক্ষমতাধর হওয়ায় বহাল তবিয়তে সবার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। তারা দারিদ্রকে উপহাস করে, অট্টহাসি দেয় কারো কোন বড় সমস্যা দেখলে।
এই দুর্বৃত্তায়নের চক্র সাধু সেজে জাল টাকা তৈরি, সরবরাহ ও বাজারে ছড়িয়ে দেবার কাজ করে যাচ্ছে। চক্রকে উৎখাত করতে না পারলে উন্নয়নের গতিকে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে জাল টাকার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ খুবই দুর্বল। সরকারিভাবে জাল টাকা নির্ণয়ের জন্য গোয়েন্দা ব্যবস্থা ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি যথেষ্ট আধুনিক ও পর্যাপ্ত নয়।
আমাদের খাদ্যে ভেজাল, পণ্যে ভেজাল এবং টাকাও ভেজাল। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। টাকা জালকারীরা নতুন কোন অনুষঙ্গ নয। এরা অতি পুরাতন চক্র। এদের গডফাদাররা অতি শক্তিশালী। তাই একবার নয়- বার বার ধরা পড়েও বার বার বের হয়ে এসে এরা আবারও পুরাতন অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। সেটা শক্তিশালী চক্রের কারণে। তাই দেরি না করে দেশের সার্বিক কল্যাণে গতি ফেরাতে টাকা জালকারী চক্রকে জোর প্রচেষ্টায় ঠেকাতে হবে।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন