আদি শ্রীহট্ট জেলা বা বর্তমানের বৃহত্তর জেলা সিলেটে এত বড় বন্যার পানির তোড় গত ১২২ বছরেও হয়নি বলে সংবাদ হয়েছে। এত বেশি প্রলয়ঙ্করী পাহাড়ি ঢলের মাতম এ প্রজন্মের জীবিতরা কেউ আগে কখনও দেখেননি। ডুবে যাওয়া বাড়ি ঘর, সহায় সম্পদ ফেলে মানুষ বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দূরের উঁচু কোন জায়গায়। বানের জলে ঈদুল আযহার পরিকল্পনা তছনছ হয়ে গেছে ওদের।
গত প্রায় একমাস ধরে অসহায় মানুষ রাস্তার পাশে, বাঁধের ধারে, নৌকা, ভেলা, হাঁড়ি, ট্রলারে করে ভেসে ভেসে জীবন যাপন করেছেন। সামান্য উঁচু জায়গায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বন্যাক্রান্ত নারী-পুরুষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি যা সঙ্গে নিতে পেরেছেন তাই নিয়ে একসঙ্গে বাস করেছেন। গৃহস্থের পোষা হাঁসগুলো নিরুদ্দেশে ভেসে চলে গেছে। হাজার হাজার পুকুরের মাছ বিপুল পানি পেয়ে সাঁতার কেটে বেড়িয়ে গেছে। রাস্তার ধারে ঠাঁই নেওয়া বন্যার্তদের মধ্যে ধনী-গরিব বলে কিছু নেই। বানের পানি সরলেও অনেকে বাড়ি ফেরার সাহস করেননি। আশ্রয় শিবিরে অমানবিক পরিবেশে ঈদ উদযাপন করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের লন্ডন বলে খ্যাত সিলেটের বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। আকাশে হেলিকপ্টার দেখলেই ছাদের উপরে উঠে একসঙ্গে বহু হাত পেতেছেন। কেউ কেউ আশ্রয় শিবিরে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। ত্রাণ সামগ্রী কুড়াতে গিয়ে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে আহত হয়েছেন অনেকে। দুঃখজনকভাবে ত্রাণ পেতে মরিয়া একজনের প্রাণবায়ু উড়ে গেছে।
ইতিহাসের ভয়াল বন্যার এত তীব্র স্রোত, এত পানির উচ্চতা, কোন শুকনো মাটি বাকি রাখেনি সুনামগঞ্জের কোন কবরস্থানে। মৃত মানুষের লাশ দাফনের শুকনো জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক অসহায় সন্তান তার মৃত বাবার লাশ দাফনের জন্য উঁচু মাটি খুঁজে না পেয়ে মাঁচা বানিয়ে কফিনকে পাহারা দিচ্ছিলেন বন্যার পানি দ্রুত কখন সরে যাবে তার আশায়। তিনি অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও তার প্রিয় বাবার লাশকে বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দিতে চাননি। তার চোখে বন্যার মতো গরম নোনা জল ও আহাজারি পৃথিবীর বিভিন্ন কর্ণারে বসে টিভির পর্দায় দেখে অনেকে নিজের অশ্রু চেপে রাখতে পারেননি। বাবার জন্য সেই সন্তানের করুণ আহাজারি নতুন করে সে এক করুণ ইতিহাসের পাতা তৈরি করেছে।
এবছর হাওড়ে ঢলের পর দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার পাহাড়ি ঢল উজান থেকে ধেয়ে এসেছে। সাত দিন পরেও বিপুল জলরাশি সরছে না। যে দ্রুতবেগে ঢল এসেছিল সেই বেগ থেমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে নিম্নাঞ্চলে। সরকারি নির্দেশে রাস্তা কেটে বানের পানি দ্রুত নেমে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যেসব জায়গায় রাস্তা কাটা হয়েছে সেসব জায়গায় রাস্তা কাটার প্রয়োজন ছিল না বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এছাড়া কিছু দূর পর পর রাস্তা ধ্বসে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে।
আগেকার বন্যাগুলো হবার দু’তিন দিন পরই পানি নেমে যেত। এবার পানি দ্রুত নামছে না। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে যেতে পারছে না। সেই সুযোগে জলচোর, জলদস্যুদের উৎপাত বেড়ে গেছে। তারা দূরের অঞ্চল থেকে দল বেঁধে এসে সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
জলচোরেরা ট্রলার নিয়ে রাতের বেলা ঘরের আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রিজ এমনকি ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাচ্ছে বলে সংবাদ হয়েছে। সামনে কোরবানির ঈদ হওয়ায় এসব চোরেরা গবাদি পশু চুরির দিকে বেশি টার্গেট করছে। রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া অসহায় মানুষেরা গরু ছাগলের রশি পায়ের মধ্যে বেঁধে রেখে রাতে ঘুমাচ্ছেন। সে আরেক নতুন কাহিনী সৃষ্টি করছে সেখানে।
শহরের মানুষ বাড়িতে ফিরতে শুরু করলেও এবারের সিলেটের রিমোট এলাকায় বানের পানিতে নিঃস্ব পরিবারগুলো সহসাই বসতভিটায় ফিরতে পারবে না। কারণ অনেকের বসতঘর বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। স্রোতের প্রচন্ড বেগ ভাসিয়ে নিয়েছে সবকিছু। যাদের কিছু অবশিষ্ট আছে সেটা শুধু ধ্বংসযজ্ঞ। অনেকে নৌকায় চড়ে ভিটায় গিয়ে ক্ষতচিহ্নের ভয়াবহ নমুনা দেখে ডুঁকরে কেঁদে উঠছেন। কারণ, সন্তানদের প্রতিপালন নিয়ে তারা সামনে আরও ভয়াবহ অন্ধকার অনুভব করছেন।
সেখানে বন্যায় সহায়-সম্বলহীনরা ঘরে ফিরে যাবে কীভাবে? কোথায় থাকবে, কি খাবে, কিভাবে পোষ্যদের নিয়ে বেঁচে থাকবে সে চিন্তায় দিশেহারা তারা। একমুঠো খাবারের জন্য তাদের হাহাকার নেমে এসেছে। ত্রাণের গাড়ি বা নৌকা তাদের দুর্গম এলাকায় পৌঁছুতে পারছে না। তাদের এলাকায় যাবার আগেই ত্রাণকর্মীরা পথে পথে ত্রাণ বিতরণ শেষ করে ফিরে চলে যাচ্ছেন।
বিশেষ করে কিছু মানুষ বাড়ির অবশিষ্ট সম্পদ ও গবাদিপশু পাহারা দেবার জন্য ভিটেমাটি থেকে সরতে চাচ্ছেন না। তাদের খাদ্য, পানীয় কিছুই নেই। পরিবারকেও তারা আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে ফেরত আনতে পারছেন না। এমন মানবেতর জীবনের কথা শোনা যাচ্ছে সেখানের বন্যাপীড়িত দুর্গম এলাকাগুলোতে। বন্যার পর ডায়রিয়া, কলেরা, জ্বরসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ এবং বর্তমানে পুনরায় ফিরে আসা করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৃহত্তর সিলেট এলাকায় সম্পদের মেরুকরণ অনেক বেশি। প্রবাসী আয়ের প্রভাবে শহরাঞ্চলে স্থায়ী নাগরিকদের অবস্থা কিছুটা ভাল হলেও সেখানে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আগত ভাসমান কর্মজীবী মানুষের সংখ্যাও অগণিত। তারা দিনে আনে দিনে খায়। এছাড়া দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে প্রান্তিক চাষি ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক।
তাই বানভাসিরা আবেদন করেছেন তারা যেন সরকারিভাবে আগামী ছয়মাস পর্যন্ত বিনামূল্যে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সহায়তা পান। সিলেট ছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নিলফামারী, গাইবান্ধা, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলাতেও একই অবস্থা বিরাজমান। সকল বন্যাদুর্গত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণের পাশাপাশি টিসিবি-র জরুরি পণ্য বিক্রি বাড়াতে হবে। ত্রাণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ঠেকাতে বন্যাদুর্গত সকল এলাকায় ত্রাণ কাজের সহায়তায় সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর কোন বিকল্প নেই। তা-না হলে গত বছরের চাল চুরির ঘটনার মতো অবস্থায় পড়ে শুধু লজ্জা ও অপমান সইতে হতে পারে।
আশ্রয় শিবিরে কিছু ব্যক্তি কোরবানির মাংস বিলি করতে এসেছেন। নিজের দুটো বড় গরু ছিল। একটি বকনা বাছুরসহ গাভীও ছিল। বানের পানির প্রচন্ড তোড়ে কোথায় যে ভেসে গেছে অথবা ডাকাতের দল নিয়ে গেছে তা ভাবতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছেন গোয়াইনঘাটের একজন দরিদ্র চাষি। কোরবানির মাংস গ্রহণ না করে তিনি বিলাপ করতে লাগলেন। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, পুকুরের মাছসহ কতজনের যে কতকিছু হারিয়ে গেছে তা ঈদের দিন স্মরণ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন অনেকে।
যারা কোরবানি দিতে পেরেছেন তারা চামড়ার মূল্য পাননি। খাসির চামড়া নদীতে ফেলে দিতে হয়েছে। লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তি সুনামগঞ্জে নয়টি গরু কোরবানি দিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে মাংস বন্টন করতে বলেছিলেন। কিন্তু গরুর মাথা ও পা বন্টন করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হওয়ায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে মারামারিতে একজন নিহত হবার মতো করুণ ঘটনা ঘটেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বন্যার্তদেরকে নিজ ভিটেতে দ্রুত থিতু হতে সহায়তা দেওয়া। তারা সবাই নিজ বাড়িতে ফিরতে চান। বাড়ি নেই, চাল-চুলো কিছুই নেই অনেকের। কৃষিনির্ভর অসংখ্য প্রান্তিক পরিবারের আশা-ভরসা বানের পানির তোড়ে ভেসে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। বানের পানিতে ভেসে আসা বালুতে কৃষিজমি ভরাট হয়ে নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। আগামী দু’এক বছর পরেও তাদের সামান্য কৃষি জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হবে কি-না তা বলাই বাহুল্য। তাদের জীবন নিয়ে টিকে থাকার জন্য জরুরি আর্থিক সহায়তা, বিনাশর্তে ঋণ প্রদান, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নেওয়া বেশি জরুরি। সিলেটসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকার বানের তোড়ে তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনগুলো যেন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য জরুরি ভাবনা থেমে গেলে চলবে কি করে?
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।