সর্বক্ষেত্রে ‘যে পালায় সে বাঁচে’ কথাটি সত্য নয়। বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে ছিলেন লক্ষ্মণ সেন। আপাতত প্রাণে বাঁচলেও রাজ্য রক্ষা করতে পারেননি তিনি। অতিসম্প্রতি তালেবান বাহিনীর ধাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় বড় কথা বলে চুপিসারে পালিয়ে যান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। চলতি সপ্তাহেই তুমুল গণবিক্ষোভের সামনে টিকতে না পেরে প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপে পালিয়ে গেছেন ৭৩ বছর বয়সী শ্রীলঙ্কার স্বৈরতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে, যিনি ও তার পরিবার পুরো দেশকে লুটে ছারখার করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দেশটির শাসন ব্যবস্থার চরম ক্ষতি করে দিয়েছেন তিনি। অস্থিতিশীল শ্রীলঙ্কা এখন শাসনের লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন।
ফলে সংস্কৃতের প্রবাদ ‘য: পলায়তি, স: জীবতি’ অর্থাৎ, যে পালায় সেই বাঁচে, তা চিরসত্য নয়। বরং যে পালায় সে বিপদের আগুন জ্বালিয়েই পালায়। নিজের মতো পুরো দেশ ও জাতিকেও ফেলে দিয়ে যায় সঙ্কটের অগ্নিকুণ্ডে। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কার পলাতক শাসকরা এমনই নির্মম শিক্ষা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
যতই ক্ষমতাধর হোক শাসক, যদি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে ও স্বৈরাচারী হয়, তাহলে তার নিপাত অবশ্যম্ভাবী। আশরাফ গনির পেছনে ছিল আমেরিকাসহ পুরো পশ্চিমী দুনিয়া। কিন্তু আফগান জনসাধারণের সঙ্গে আস্থা, বিশ্বাস ও সুশাসনের কোনো সম্পর্ক ছিল না তার। ফলে যখন কাবুল দখল করে নেয় তালেবানরা, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পালালেন।
অথচ এই আশরাফ গনিই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়বেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন জানান, আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বলেছিলেন, তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়ে যাবেন। কিন্তু তালেবান কাবুলে আসার পর তিনি ঠিকই পালিয়ে গেছেন কাউকে কিছু না জানিয়ে।
শ্রীলঙ্কায় তেমনি পলায়ন-পর্ব সম্পন্ন হয়েছে ব্যাপকতর পাবলিক ক্যু'র পটভূমিতে। সামরিক বাহিনীর গোপন পরিকল্পনাও সেখানে জনবিক্ষোভে নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। পরিণামে অনিশ্চিত গন্তব্যের চলছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। শাসন কাঠামো ভেঙে গেছে পুরো দেশের। ক্ষিপ্ত ও ক্ষুব্ধ জনতাকে থামানোই যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, সরকারি স্থাপনায় উদ্বাহু নৃত্য করছে মানুষ। সরকার ও প্রশাসনকে পায়ের নিচে রেখে জনতা কুশাসনের প্রতি জানাচ্ছে ঘৃণা ও প্রতিবাদ।
প্রেসিডেন্ট পালানোর পর কী হবে দেশটিতে কেউ বলতে পারছেন না। স্বৈরশাসকরা নিজের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশ ও সুশাসনের কত বড় সর্বনাশ করে যায়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ শ্রীলঙ্কা। ব্যক্তি ও পরিবারের কর্তৃত্ব দেশের শাসন কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে এতো ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে যে, সেটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। শ্রীলঙ্কায় তেমনই হয়েছে। প্রতিটি স্বৈর ও একনায়ক শাসিত দেশে এমনই ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তখন শাসক পালালেই সমস্যার সমাধান হয়না। পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই নড়বড় করতে থাকে।
গণবিক্ষোভের মুখে টিকতে না পেরে প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপে পালিয়ে গেলেও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ও জাতিকে রেখে গেছেন চরম বিপদের মধ্যে। কয়েকদিন আগেই উত্তেজিত জনতা তার বাসভবনে প্রবেশ করার পর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ ছিলেন এবং পালানোর চেষ্টা করছিলেন। সোমবার কলম্বোর বিমানবন্দরে তিনি ও তার পরিবারের ১৫ জন সদস্য দুবাইগামী শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আরোহণের চেষ্টা করলে ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা তাদের বাধা দেন। ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে তারা সামরিক ঘাঁটিতে ফিরে যান। শেষ পর্যন্ত বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে মঙ্গলবার রাতে গোতাবায়া ও তার স্ত্রী দু’জন নিরাপত্তাকর্মীসহ মালদ্বীপে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের সাহায্য। ভারত তাকে সাহায্য করেনি। চরম মুসলিম বিদ্বেষী শাসক শেষ পর্যন্ত আশ্রয় পান মুসলিম দেশ মালদ্বীপে, যদিও সেখানে তার বিরুদ্ধে চলছে বিক্ষোভ।
গোতাবায়া রাজাপক্ষে মালদ্বীপে আশ্রয় নিয়েছেন- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানেও তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। মালদ্বীপ থেকে তিনি তাই সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যেতে পারেন বলে অনেকের ধারণা। অবশ্য, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের প্রথম পছন্দ যে মালদ্বীপ ছিল না, তা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকেই স্পষ্ট। জান বাঁচাতেই তিনি এখানে এসেছেন। তবে এখানেও শেষ পর্যন্ত তিনি থাকতে পারেন কিনা, সন্দেহ।
হয়ত তাকে আরও নিরাপদ কোনো দেশে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে যেতে হবে। ‘যে পালায় সে বাঁচে’, এই মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে যতই পালিয়ে যান তিনি দেশ থেকে দেশে, শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারবেন বলে মনে হয় না। স্বৈরশাসকরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাপের পঙ্কে হারিয়েই যান। কুকর্মের কঠোর প্রায়শ্চিত্ত তাদের নিয়তি থেকে কখনোই মুছে ফেলা যায় না। এই ঐতিহাসিক শিক্ষাই তাদের চূড়ান্ত ভাগ্যলিপি।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।