আষাঢ়ের শুরুতে আকাশটা ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। মাসের দু’দিন না পেরুতেই সারা দেশে অবিরাম বজ্রবৃষ্টি নিয়ে হাজির যেন বর্ষা রাণী। অবশ্য গত সপ্তাহে দর্জিলিং, মেঘালয়, আসাম প্রভৃতি অঞ্চলে প্রবল বর্ষণ হয়েছে। একটানা অতিবর্ষণ পাহাড়ি ঢল সাজিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের সবুজ-শ্যমলিমাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। থৈ থৈ বন্যার পানিতে সয়লাব বৃহত্তর সিলেট। তার সাথে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, এবং বাদ যায়নি গাইবান্ধা, শেরপুর, নেত্রকোরা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলাও। এবছর দ্বিতীয়বার বন্যা ধেয়ে এসেছে ঢলের পানির তোড়ের সাথে। নিয়ে এসেছে ভয়ংকর এক আগ্রাসী মাতম। জুন মাসের ১৭ তারিখে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি শুরু হয়েছে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায়।
এবছর একমাসের ব্যবধানে আবারও সিলেটে বন্যা দেখা দিয়েছে। এবারের বন্যা শুধু হাওড়ে নয়- শহর গ্রাম সব জায়গায়। হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে হু হু শব্দ করে উজান থেকে ধেয়ে এসে বাড়িতে ঢুকছে পানি, থৈ থৈ করছে চারদিক। বাদ যায়নি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা ক্যাম্পাস। সাস্ট ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হলেও পানি উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে বহুবার বন্যা হয়েছে। কিন্তু এবারের মত এত দ্রুত এত বিপুল জলরাশি ধেয়ে আসেনি কখনও। এই এলাকায় এত ভয়াবহ অবস্থা কোনদিন কেউ ঘটতে দেখেনি। সাস্টের শিক্ষকরা নিজেদের বাসায় পানিবন্দী হয়ে ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে আছেন। রাস্তা, টিনশেড ও একতলা বাড়ির ঘরে পানি, গ্যারেজে পানি, প্রায় সকল বহুতল বাড়ির নিচতলার মধ্যে পানি ঢুকে পড়েছে। জুন ১৬ তারিখ থেকে একটু একটু করে পানি বেড়ে ১৭ তারিখের বিকেল চারটার মধ্যে গোটা সাস্ট ক্যাম্পাস পানিতে ডুবে গেছে।
এবারের সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে এর প্রভাবে গোটা দেশের আসন্ন এসএসসি ও সমমানের সকল পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। এজন্য প্রস্তুতি নিয়েও ৩০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ জন পরীক্ষার্থী বিপাকে পড়েছে।
এছাড়া ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে পানি ঢোকায় বিমান ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। ঢাকাগামী রাস্তাসহ ছোট-বড় সকল রাস্তা উপচে পানির স্রোত বইতে থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি ঢুকে পড়ায় গোটা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জের সাব-স্টেশনগুলোতে পানি ঢুকে পড়ায় গোটা সুনামগঞ্জ জেলায় অন্ধকারে ডুবে আছে।
সুনামগঞ্জের শহর-গ্রাম সব এলাকায় ভয়ংকর অবস্থা বিরাজমান। একতলা বাড়িঘরের নিশানা নেই। কোথাও কোথাও ঘরের চালের উপর দিয়ে বইছে বন্যার পানির স্রোত। অল্পসংখ্যক দোতলা তিনতলা বাড়িতে বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তারা মানবিকভাবে উঠে গিজ গিজ করে আছেন। সবাই বড়ির মালামাল, আসবাব, টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বাঁচানোর আশা ছেড়ে দিয়ে জীবন বাাঁচানোর তাগিদে আশ্রয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে পড়েছেন। দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোনের ব্যাটারি চার্জের অভাবে জরুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন অনেক রিমোট এলাকার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন শিক্ষার্থী সেখানে সফরে গিয়ে পানিতে আটকা পড়ে আছেন বলে সংবাদ হয়েছে।
সিলেট রেল স্টেশনে পানি উঠে ১, ২নং প্লাটফর্মের লাইন ডুবে যাওয়ায় ছাতক, সুনামগঞ্জের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে ঢাকার সাথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হতে পারে।
সুনামগঞ্জে বন্যার পানির এত ভয়াবহ অবস্থা যে স্থানীয় মানুষ নিজেরা উদ্ধারকাজ করতে অপারগ। তাই সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলকে নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে জলবন্দী মানুষ ও গবাদিপশু উদ্ধারের জন্য ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। তারা হেলিকপ্টারে করে পানির বোতল, স্যালাইন ও শুকনো খাবার সরবরাহের আবেদন জানিয়েছেন।
অনেকে অভিযোগ করেছেন যে তারা এত কষ্টের মধ্যে জীবন বাজি রেখে পানির সাথে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তাদের এই আঁকুতি টিভি বা গণমাধ্যমে তেমন করে প্রচারিত হচ্ছে না। এমনকি কেউ তাদেরকে উদ্ধার বা সাহায্য করতে এখনও এগিয়ে আসছে না। দেশের এত টিভি চ্যানেল ও মিডিয়ার লোকজন কোথায়? তারা এখনও নীরব কেন, ইত্যাদি।
টানা বর্ষণে শুধু সিলেট নয়- দেশের ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা, সোমেশ^রী নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী দু-তিন দিন পর দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার প্রকোপ শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
দ্বিতীয় ধাপের এই বন্যায় এত ভয়ংকর চেহারা আগে কেউ কখনও দেখেননি। বন্যার পানির স্রোতের এত বেগ হবে তা কেউ কখনও কল্পনা ও করেননি। এত পানি উজানের কোথা থেকে ধেয়ে আসছে তা নিয়ে অনেকের বিস্ময়। সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে অনেক আগেই। এসব নদী উজানের এত বিপুল জলরাশির চাপ সহ্য করতে অপারগ। অনেকে বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজের জন্য নদীগুলোতে পানি প্রবেশের দ্বারগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাই পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে রাস্তা উপচিয়ে শহর ও গ্রামের জনবসতি ভাসিয়ে দিচ্ছে। কেউ আবার করুণ স্বরে বলছেন, এটা আমাদের শুধু নিয়তি বললে ভুল হবে। এটা যতটা না নিয়তি ততটা আমাদের প্রতিবেশীদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত তথ্য প্রদানে অসহযোগিতার নমুনা। বার বার হঠাৎ হু হু করে ধেয়ে আসা বন্যার লক্ষণ খুই অশুভ। এটা আমাদের সার্বিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
তবে ক্রমাগত বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যে যাই বলুন না কেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- নদীভাঙন, অকাল বন্যা, ফ্লাশ ফ্লাড, বার বার বন্যা, ভূমিধ্বস ইত্যাদি যেহেতু আমাদের পাহাড়ি ও সমতল সব এলাকার মানুষের চরম নিয়তি সেহেতু এসব বিপর্যয় ঠেকাতে হলে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সকল নদীর সব মৌসুমের পানিপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং কার্যকর চুক্তি করতে হবে। খরা মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সব নদীতে ড্রেজিং করে পানি প্রবেশের সংকুচিত দ্বারগুলো প্রশস্ত ও সাগরে যাবার পথকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। প্রতিবছর বন্যা শুরু হবার পর বালির বস্তা নিযে দৌড়াদৌড়ি করে তটস্থ হলে বন্যার করাল গ্রাস থেকে আমরা কখনও মুক্তি পাব না।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।