ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।
ব্যাপক হারে এবং সীমাহীন মাত্রায় লুটপাটের ঘটনা বিবৃত করতে বাংলায় ‘হরিলুট’ বাগধারা প্রচলিত। ‘হরিলুট’ শব্দটির ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক অর্থ লুটপাটের মহোৎসব। তবে, আক্ষরিক বা উৎপত্তিগত অর্থে শব্দটি হিন্দু ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
হরির নাম কীর্তন করার সময়, হরির সামনে নৈবেদ্য হিসেবে বাতাসা, নকুল দানা, নানা রকম ফল ইত্যাদি দেওয়া হয়। কীর্তন অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর, হরির আসনের সামনে রাখা বাতাসা, নকুল দানা, ফল এসব প্রসাদ স্বরূপ, উপস্থিত ভক্ত বৃন্দের মাঝে ছুঁড়ে, ছুঁড়ে দেওয়া হয়। একেই ‘হরিলুট’ বলা হয়, যা থেকে ‘হরিলুট’ বাগধারার উৎপত্তি।
বাংলাদেশে ‘হরিলুট’ একটি ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং বহুলভাবে ব্যবহৃত শব্দ। সরকারি প্রজেক্ট, প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় বা আত্মসাৎ যেমন হয়, তেমনি পুরোটাই অনেক সময় লোপাট করা হয় হরিলুটের মাধ্যমে।
পাহাড়-খাদক, ভূমিদস্যু, নদী দখলকারী, বন-জঙ্গল উজারকারী, রিলিফ-ত্রাণের টিন, গম, চাল, কম্বল হজমকারীর মতো বহু দৃশ্যমান ও অদৃশ্য চক্র হরিলুটে পারঙ্গম। যে তালিকায় যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল বা অনলাইনে হরিলুটকারী দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী।
কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে, যারা এক-দুই টাকা নয়, হাজার কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। তেমনই একটিকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে ধরা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে ইভ্যালির মোহাম্মদ রাসেল ও শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে র্যাব। বহুল আলোচিত ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযােগিতা কমিশন। একই সঙ্গে ইভ্যালির 'ধামাকা ঈদ অফার'টি বাতিল করা হয়েছে।
তাছাড়া, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি ও ভোগান্তির অভিযোগ উঠেছে। নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য সরবরাহ না করা, একাধিকবার সময় নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা, সরবরাহের তারিখ বার বার চেঞ্জ করা, অফিস নম্বরে একাধিকবার ফোন করেও উত্তর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগ করেছে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকরা। এমনকি রিফান্ডের টাকা নিয়েও চলছে নানা টালবাহানা। একজন তথাকথিত হুজুরের এহসান গ্রুপে ৩২২ কোটি টাকা আমানত রেখে নিঃস্ব হয়েছে আমজনতা।
পরিস্থিতি কত ভয়াবহ তার একটি প্রমাণ এই যে, ই-কমার্সে বা অনলাইনে গরু অর্ডার দিয়ে নিজেই প্রতারিত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, দুই বছর আগের কুরবানি ঈদে একটি ই কমার্স প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনকালে অনলাইনে এক লাখ টাকা দিয়ে কোরবানির জন্য গরু অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু আমাকে যে গরুটি দেখিয়েছিল, আমি সেটি পাইনি। আমি প্রতারিত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে অবশ্য অন্য গরু পেয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
এদিকে, প্রতারণার দায়ে বিতর্কিত হয়ে পড়া ইভ্যালি, ধামাকা শপিংসহ চার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত করেছে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব)। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে সংগঠনটি। সদস্যপদ স্থগিত হওয়া অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান হলো- সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম ও গ্লিটার্সআরএসটি ওয়ার্ল্ড।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৮ জুলাই ভোক্তা ও বিক্রেতাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল ইক্যাব। ওই নোটিশের পর অভিযোগের বিষয়ে জবাব না দেওয়ায় বা সন্তোষজনক জবাব না দেওয়ায়, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১ পরিচালনা না করায় এবং ক্রেতা-ভোক্তাদের পাওনা সময়মতো পরিশোধ না করায় এই ৪টি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৬ আগস্ট ইক্যাব একই কারণে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ ডটকম, টোয়েন্টিফোর টিকেটি ডটকম, গ্রিন বাংলা ই-কমার্স লিমিটেড, এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাগ্রো ফুড অ্যান্ড কনজ্যুমার লিমিটেডের সদস্যপদ স্থগিত করে।
তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কারণে এবং মানুষের ব্যস্ততা বৃদ্ধি ও করোনার জন্য চলাচল সীমিত হলে ই-কমার্স বা অনলাইনে কেনাবেচার একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ইতিবাচক মনোভাবে কাজ করলে সম্ভাবনাময় এই সেক্টর প্রচুর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের একটি বড় বাজার বা মার্কেট প্লেসে পরিণত হতে পারতো। কিন্তু অসাধুচক্র একদিকে এই পদ্ধতিকে বিতর্কিত ও সন্দেহজনক যেমন করেছে, তেমনিভাবে গ্রাহকদের আস্থা ও অর্থ লোপাট করে দিয়েছে।
এইক্ষেত্রে সাধারণ মানুষও সচেতনতার পরিচয় দিতে পারেনি। বিভিন্ন ধরনের লোভ ও লাভজনক প্রলোভনের ফাঁদে আটকে গেছে অনেকেই। যার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা হরিলুটের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতে পেরেছে অসাধু ও ফন্দিবাজ গোষ্ঠী।
ই-কমার্স সংক্রান্ত পরিস্থিতি সত্যিই বেদনাদায়ক আকার ধারণ করেছে। এই সেক্টরে কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা তাই অপরিহার্য। যাতে চটকদার অফার দিয়ে কোনও কোম্পানিই হরিলুট করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর কোনও কোনও কোম্পানিকে ধরা হলেও টাকা আদায় দীর্ঘমেয়াদি ও প্রায়-অসম্ভব বিষয়।
ফলে এইসব হরিলুটকারী কোম্পানিগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এমন পরিবেশ ও আইনগত ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে প্রকৃত ই-ব্যবসায়ীরা সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতিতে কাজ করতে পারে এবং অসৎ কোম্পানি গোড়াতেই ধরা পড়ে। জনগণের টাকা কোনও অবস্থাতেই যেন হরিলুটের মাধ্যমে লোপাট করা না যায়, সেই বিধিব্যবস্থাই সকলের জন্য কাম্য।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।