ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।
আফগানিস্তান নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলছে পর্যালোচনা, সমীক্ষা ও মূল্যায়ন। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, আমেরিকান সৈন্য ফিরে আসায় লাভ-ক্ষতির ময়নাতদন্ত। বলা বাহুল্য, এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষ নিজস্ব অবস্থান ও স্বার্থের আলোকেই বক্তব্য উপস্থাপন করছে। ফলে আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের রূপ-চরিত্র ও শিক্ষা নানা দেশের কাছে নানা রকম চেহারা পাচ্ছে।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার মতোই ২০০১ সালে আমেরিকা এসেছিল ‘নতুন আফগানিস্তান’ গড়ার কথা বলে। বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। আফগানরা রুশদের কাছ থেকে যেমন সমাজতন্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করেনি, তেমনিভাবে আমেরিকানদের কাছ থেকে গণতন্ত্রের দীক্ষাও নেয়নি। আফগানরা আছে আফগানদের মতোই। নগরগুলোতে সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে, পার্বত্য-জঙ্গলের গোত্রবাদী স্বাধীন ও বেপরোয়া জীবনের আবর্তেই চলছে তাদের জীবন।
ফলে রুশদের মতো আমেরিকানদের মিশনও ব্যর্থ হয়েছে। ২০ বছরের ২ ট্রিলিয়ন ডলারের হিমালয়-সদৃশ্য বিনিয়োগ ফেলে কার্যত ময়দান ছেড়ে পালিয়েছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসনের মত হলো, যত তাড়াতাড়ি প্রত্যাহার করা যায়, ততই আমেরিকার মঙ্গল হবে এবং লোকসান কমবে। কারণ, এতো আয়োজনের পরেও যখন তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা তো দূর, সামান্য লড়াইয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করল না আমেরিকার মদদপুষ্ট আফগান সেনারা, তখন অপাত্রে খরচ অর্থহীন অপচয় বৈকি।
বরং অনায়াসে তালেবানরা কব্জা করে নিল পলায়ন পর আফগান সেনাদেরকে প্রদত্ত আমেরিকান অস্ত্রশস্ত্র। এতে রাজনৈতিক দিকের পাশাপাশি সামরিক দিক থেকেও শক্তি বৃদ্ধি করেছে তালেবান গোষ্ঠী। বিশ্লেষকগণ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তালেবানদের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রমাণও হাজির করেছেন। কারণ, আমেরিকা আফগান সরকারকে যা দিয়েছিল, তার মূল্য প্রায় ২৮০ কোটি ডলার। ২০০২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অস্ত্রভান্ডারের জন্য দেওয়া এই অর্থের পাশাপাশি সেনার প্রশিক্ষণ ও উন্নতির কাজে প্রায় ৮৩০ কোটি ডলার খরচ করেছিল আমেরিকা।
ক্ষমতা দখলের পর এই বিপুল যুদ্ধ-সরঞ্জাম দখল করেছে তালেবান বাহিনী। দু’হাজার অস্ত্রবাহী গাড়ি, হামভি, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার (যেমন, ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার), স্ক্যান ইগল ড্রোন ও বিমান, এ সবই এখন তালেবানের দখলে। তালেবানদের কব্জায় আরও অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে অ্যাসল্ট রাইফেল এম ১৬, মর্টার, হাউৎজার, বডি আর্মার, নাইট গগল্স, আইইডি বিস্ফোরক, গ্রাউন্ড রকেট। এছাড়াও বিপুল অস্ত্র ভান্ডার, আমেরিকার তৈরি করা ‘বায়োমেট্রিক ডেটাবেস’, আমেরিকার সেনার ছেড়ে যাওয়া ঘাঁটি এসেছে তালেবান নিয়ন্ত্রণে।
তাহলে আমেরিকা ঘোষিত ‘নতুন আফগানিস্তান’ গড়ার উচ্ছ্বাসা বিপুল পরাজয়ে শুধু ভেস্তে যায়নি, বরং প্রতিপক্ষকে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছে। ‘নতুন আফগানিস্তান’ দূরস্থিত, 'আরও সংঘাত ও যুদ্ধের ঘনঘটা' বিদ্যমান বাস্তবতা। আফগানিস্তানের ক্রম-পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি এমনই বহু আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে।
ফলে আফগানিস্তানে আমেরিকার বিরাট পরাজয়কে বড় করে দেখার পাশাপাশি তালেবান বাহিনীর নানামুখী ফায়দার বিষয়টি মোটেও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে, কেন বিপুল বিনিয়োগের মায়া কাটিয়ে আফগানিস্তান ছাড়ল আমেরিকা, এই প্রশ্নের উত্তর। কারণ, আমেরিকা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, যাবতীয় আয়োজন শুধু ফতুর, অপচয় ও দুর্নীতি হচ্ছে না, ঘুরেফিরে তালেবানদের লাভের খাতায় যোগ হচ্ছে। বাইডেন যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখনই সেটা বুঝেছিলেন। আফগান নীতির বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হয়েই কালবিলম্ব না করেই তিনি সমাপ্তিহীন বিশাল খরচের আফগান প্রজেক্ট থেকে সরে এসে হাফ ছেড়েছেন।
আফগানিস্তানে ১০ বছর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সোভিয়েত রাশিয়া পরাজয়ের কালিমার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল খরচের বোঝা, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনকে তরান্বিত করেছিল। আমেরিকা আরও বেশি দিন থাকলে তাদের বিপদের ব্যাপ্তিও বাড়তো। বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কারখানা, যেখানে তাবড় তাবড় বিশ্লেষক, রণনৈতিক, সরকারি উপদেষ্টারা বসে আছেন, তাঁরা গোপনে সত্যিই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আফগানিস্তানে পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। আত্মমর্যাদার কারণে প্রকাশ্যে কবুল না করলেও প্রকারান্তরে এই কঠিন সত্যটিকে মেনে নিয়ে আগেভাগেই সরে এসেছে আমেরিকা। তাতে আরও বড় বিপর্যয় ও কলঙ্কের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বিশ্বের শীর্ষ দেশটি।
আসলে আমেরিকা শত্রুকে হারাতে চেয়েছিল, পাশাপাশি চেয়েছিল নিজের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করে নয়া আফগানিস্তান গড়তে। জার্মানি বা জাপানের ক্ষেত্রে এই কাঠামো কাজ করে গিয়েছিল, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা করেনি। তা দেখিয়েছে ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান। আমেরিকার নিজস্ব কায়দায় দেশ গঠনের প্রক্রিয়া দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
আফগানিস্তান এমন এক দেশ, যে দেশে ‘ওয়ার লর্ড’-দের প্রভুত্ব চলে। যে দেশে রয়েছে বিপুল জাতিবৈচিত্র্যের দ্বন্দ্বময় ইতিহাস। ১৯৭৯ সাল থেকে ৪২ বছর যুদ্ধ করে যে দেশ মোটেও ক্লান্ত হয়নি, সেদেশে বাইরে থেকে গিয়ে যুদ্ধ করা সত্যিই দুরূহ। নিজেদের গোত্রীয়, বেপরোয়া, স্বাধীনচেতা মনোভাব যারা অবলীলায় লালন করে, তারা আমেরিকার কায়দায় চলবে কেন? এটাই সম্ভবত আফগানিস্তানের শিক্ষা।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।