বিশ্বে করোনার দ্বিতীয় ঢেউের ভয়াবহতা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। যদিও করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের মত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হাতে পেয়েও করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে আটকানো কার্যকরভাবে সম্ভব হয়নি। অন্য দিকে উন্নত দেশসমূহ সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বাংলাদেশের পরিকল্পনা কেমন যেন অপরিপক্ক। এমনিতেই আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে নূন্যতম স্বাস্থ্য সচেতনতার বালাই নেই বলেই চলে। আমাদের মত জনবহুল দেশে নিদিষ্ট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন হলেও মাস্ক পরিধান কঠিন ছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও মানুষের মাস্ক ব্যবহারের উদাসীনতা আমাদের সংক্রমণ বৃদ্ধি অন্যতম কারণ। আবার করোনা টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করা পর অধিক আত্মবিশ্বাস ও অসচেতনতা আমাদের সংক্রমণ বৃদ্ধিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আরও বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। যা হতে পারে প্রথম ঢেউ থেকে আরও ভয়ংকর। কেড়ে নিতে পারে আরও মানুষের জীবন। কারণ করোনার নতুন প্রজাতির গুলোতে আগের চেয়ে বেশি ভয়ংকর উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় ঢেউ শিশু থেকে শুরু করে যুবকরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে অক্সিজেন ও আইসিইউ এর প্রয়োজন আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। প্রতিদিন যেভাবে সংক্রমণের নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে তা, আগামী দিনের ভয়াবহতার ইঙ্গিত বহন করছে।
দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় আরও আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে আমরা যেভাবে বিনোদনের জন্য বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র গুলোতে ভিড় করেছি। নূন্যতম স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি লঙ্ঘন করছি। তা দেখে মনে হয়নি, যে বিশ্বব্যাপী অতিমারি চলছে। উপরন্তু গত কয়েকদিনের কিছু সিদ্ধান্ত অপরিকল্পিত মনে হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায়সহ বিভিন্ন ধরনের গণজমায়েতে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে তা আরও সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় লকডাউন একটি অন্যতম কার্যকর ব্যবস্থা হলেও তার ফলাফল পেতে সমন্নিত পরিকল্পনার প্রয়োজন। আমাদের মত দরিদ্র দেশের বাস্তবতায় লকডাউন কিভাবে কার্যকর করা যাবে তার জন্য পূর্বেই সময়োপযোগী কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল। কারণ সময়োপযোগী সঠিক কৌশলগত পরিকল্পনা করে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলক সহজ। আমরা দেখছি ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড ও অষ্ট্রেলিয়ার মত দেশ সঠিকভাবে পরিকল্পনার করে করোনা মোকাবিলায় সফলতা পেয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজন ছিল আরও বেশি বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া। দেশে যেভাবে পরিকল্পনাহীনভাবে হঠাৎ লকডাউন শুরু হয়েছে তার কার্যকারিতা নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কমবেশি সবাই সন্দিহান। দেশব্যাপী এই ধরনের ঢিলেঢালা লকডাউন করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় খুব বেশি কার্যকর নয়। কারণ বইমেলা, কলকারখানা খোলা রেখে লকডাউনের পরিকল্পনা এর কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। করোনা মোকাবিলায় সরকারি যেকোন সিদ্ধান্তকে সঠিকভাবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা জন্য সবার আগে প্রয়োজন জনগণের সম্পৃক্ততা। কারণ জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া এই ঢিলেঢালা লকডাউন খুববেশি কার্যকর হবে না। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় কঠিন পদক্ষেপ না নিয়ে ছোট ছোট বিষয় সমূহ যেমন মাস্ক পরিধান, যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সমন্বিত স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি অনুসরণে আরও বেশি জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কার্যকরভাবে মোকাবিলায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজনঃ
১) করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় সুপরিকল্পিত, সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ।
২) সরকারি সিদ্ধান্তসমূহ কার্যকরভাবে ফলপ্রসূ করার জন্য আরও বেশি জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।
৩) দরিদ্র ও অসচেতন জনগোষ্ঠীকে সংক্রমণের হাত থেকে রুখতে কার্যকর পদক্ষেপ শতভাগ নিশ্চিত করা।
৪) করোনার টিকাদানের মাধ্যমে দ্রুত হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা।
লেখক: নিতীশ কুমার কুন্ডু, সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়