তাবুগুলি উড়ে যাচ্ছে অয়নান্তের ওই পাড়ে

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

সিদ্ধার্থ হক | 2023-08-28 09:14:31

মৃত্যু
[উৎসর্গঃ আনিসুজ্জামান]

চারদিকে বাতাস ও মৃত্যুর মিশ্রণ প্রবাহিত। এই গ্রহে,
মৃত্যু বাতাসের চেয়ে বড়, বিস্তৃত বেশি; টের পাই।

জন্ম একবার হয়, কিন্তু মৃত্যু বারবার ঘটে।
মানুষ চিন্তা করে, তাই মৃত্যু বারবার ঘটে, চারদিক
পার হয়ে, ভেসে ভেসে, তাবুর ভিতরে ঢুকে যায়।

মৃত্যু হয় বারবার ঘুম থেকে উঠবার মতো।
বেঁচে থাকা ফেটে গেলে বেলুনের প্রায় মৃত্যু হয়।
বাতাস বেরিয়ে যায়, অন্তস্থল শূন্য হয়ে পড়ে।
বাতাসই ওজন জীবনের;
বাতাস বেরিয়ে গেলে জীবনের সবকিছু হালকা হয়ে যায়।
সার্বভৌম নলগুলো খুলে ফেলে দিয়ে,
বাইরে বেরিয়ে যায় মানুষের রুহু।
পিছনের দিকে ঘুরে দেখে,
জীবন স্বপ্নের মতো, আর স্বপ্ন এক মোমবাতি;
বেঁচে থাকতে হলে যাকে গলতে হয়, ক্রমে। রুহু ভাবে
তার ছেড়ে আসা জীবনেরও
ছিল তবে একই নিয়তি।
বাতাসের বাঁধাগ্রস্ত হাত, ক্রমবিকাশের পথে,
একটু একটু গলে—একটু একটু সামনে যায়।

বারবার স্বপ্ন থেকে উঠে আমি, আবার ঘুমাতে চেষ্টা করি।
অনেক আগের অবাস্তব ছবি ভাসে, আসে যায়।
ঘুমিয়ে পড়ার মতো মৃত্যু হয়। মৃত্যু হয়
ঘুম থেকে উঠবার মতো।

যে কল্পনা, এইখানে গতকাল ছিল—কিন্তু আজ আর নাই
সে হয়তো অলীক, কিন্তু বড় জেদী; চারপাশে ঘোরে, আমি দেখি;
উবে যাওয়া মানুষের মুখ, স্বপ্নের চেয়েও মিহি, আমি দেখি।

বস্তুদের মতো

গুহার ভিতর থেকে এসেছে সে উঠে।
আমার মুখের দিকে বস্তুদের মতো চেয়ে আছে।
সে থাকতে চায় কাছে—নীরব, একাগ্র, ধর্মঘট।
আমাকে গুহার মতো, হাতহীন হাতে, স্পর্শ করে।
গভির নিঃশ্বাস ফেলে মুখের উপরে, মুখহীন মুখ দিয়ে।

সে কি তবে আমার ডাবল? ছায়া, অন্য এক আমি?
আমার যুগলবন্দী দেখতে আমার মতো নয়।
সে দেখতে কারো মতো নয়।
গর্তের মতন তার মুখ;
অস্ফুট গানের প্রায় চোখ দিয়ে কিছু কথা বলে।
হাঁটে সে আমার সাথে, যদিও সে নয় কোনো ছায়া।

তাকে দেখে টের পাই, দুঃখের ভিতরে
পুজ জমে, স্থগিত হয়। আনন্দের মধ্যে জমে
তিক্ত বিষ; হস্ত-পদ-মুখ-হীন হাসি।
নিস্তব্ধ সে, না ডাকে পিছনে, না সামনে।
বস্তুদের গভীরতা সত্য হয়ে আছে তার চোখে।

পাতায় পাতায় আজ অনেক দেয়াল—
দেয়ালের পিঠে বহু কাঁটাতার, লোহার গোলাপ—
মানুষের ঐ পাশে চলে যাই আমি—
গুহার ভিতর থেকে উঠে,
নিজের মুখের দিকে, নীরব, একাগ্র, চেয়ে দেখি,
কোন ফাঁকে যেন,
আমার এ মুখ,
বস্তুর মুখ হয়ে গেছে—আর বস্তুদের মুখে,
জেগে উঠছে, আমার মুখের
এবড়ো-থেবড়ো, কোঁচকানো, বলি-রেখা।

অভিজ্ঞতা

অনেক হয়েছে নেয়া স্বাদ জীবনের—মিটে গেছে
চেতনার নোলা। অথবা পেয়েছো স্বাদ
শুধু কিছু অথবার মতো। আস্বাদন করা,
প্রতিবারই, শেষ হয়ে গেছে, শেষ হয়ে
যাওয়ার আগে। সালুনের নুন দেখে
সরে গেছো, সালুনের কাছ থেকে দূরে,
বহু দূরে, আস্বাদন করোনি সালুন।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত,
জিহবা দিয়ে চেটে গেছো—গ্রহের প্রতিটি মলিকুলে
তোমার জিহবার স্পর্শ, লালা। বহু উঁচু টুলে বসে,
নেমে গিয়ে, অন্য টুলে উঠে বসা হয়েছে অনেক।
একই টুলে বসেছো হাজারবার তুমি।
বহুবার শুয়েছো, জেগেছো, ঘুমিয়েছো,
তবু কোনো কিছু, কোনো স্বাদ নেয়া, সম্পূর্ণ হয়নি।
গলার কাঁটার মতো স্বাদ-বধিরতা—বিঁধে আছে মনে।

অভিজ্ঞতার অর্থহীনতা তাই টের পাওয়া যায়।
সবকিছু বারবার হয়। কেননা এ-তুমি চাও
সব কিছু বারবার হোক। একই গাছে একই ফল
বারবার জন্ম নেয়, বোঁটা থেকে ঝরে। বহু ফল
মিষ্টতা হারায়, ভোতা, তিক্ত, নুনহীন হয়ে যায়।
অর্থাৎ তুমিই ভাবো পুরাতন ফলে কোনো মিষ্টতা নাই।

অতৃপ্ত গ্রহের হাতে, অতৃপ্ত জীবন, ঘুরতে থাকে—
নতুন ফলের খোঁজে, পৃথিবীর পৃষ্টা চেটে চেটে,
হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে, চলে যায় দিন।

এখানে থাকতে হলে

বহু মৃত্যু ভুলে যেতে হয়। ছিঁড়ে ফেলা হাত, মুখ,
অনেক বিচ্ছেদ, হায়, সুদূরে সরিয়ে দিতে হয়।

এখানে থাকতে হবে। বহু মৃত্যু যেতে হবে ভুলে।
সমস্ত অস্বাভাবিক মৃত্যু ভুলতে হবে
একে একে একে। হায় আমি, তবু কেন,
কিছুই ভুলি না, কিন্তু বলি ভুলে গেছি।

মৃত্যু ভুলে গেলে জীবন যে খণ্ডিত হয়ে পড়ে,
তুমি কি তা টের পাও? হয়তো বা পাও।
পিতার, মাতার মৃত্যু, হস্ত-পদ-মাথা সহ
যে সকল মৃত্যু ঘটে গেছে,
হয়তোবা সেসব তোমারও মনে আছে।

কিন্তু যেসব মৃত্যু হস্ত পদ মাথা হীন, আত্মাহীন—
মানুষের যে সকল মৃত্যু ঘটে আচমকা অন্য
এক কিম্বা একাধিক মানুষের হাতে—
কোপে কোপে, হস্ত-পদ-কুড়ালের আঘাতে আঘাতে;
বাঁচাবার কেউ নাই, এই সত্য টের পেতে পেতে—
ক্ষমাহীন অপঘাতে যে সব মৃত্যু ঘটে,
সেসব কি মনে রাখো তুমি?

হয়তো তোমার স্মৃতি অনুগ্রহহীন, উপলব্ধিহীন—
ড্রেনে ফেলে দেয়া কালো সংবাদপত্র;
কাগজের আধুনিক অন্যমনস্কতা। হয়তোবা
গভীর বেদনা আর নেই কোনো মনে।
এখন বাঁচার শর্ত এক ও অদ্বিতীয়
সুবিধাজনকভাবে বাঁচা।

মৃত্যুকে ভুলি না আমি, ভুলতে পারি না।
অস্বাভাবিক মৃত্যুর জ্বলজ্বলে স্মৃতি—দীর্ঘ, তীক্ষ্ণ টর্চ,
অতিন্দ্রীয় ফ্ল্যাশ-লাইটের শত শত চোখ, বুকে নিয়ে,
অস্বাভাবিক মৃত্যুর ভার,
প্রতি পদক্ষেপে
বহন করতে করতে
এ জীবন কাটে।

কোনো কোনো রাতে বৃষ্টি হয়। ঘুম হয়।
বাতাস উচ্ছল থাকে; উদ্ভিদ কথা বলে দাঁড়িয়ে বা বসে।
কোনো কোনো রাত এক সুগভীর খরা, শব্দহীন;
পৃথিবীর নিঃশ্বাস যেন এ অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছে।

তবু, শোনো, যে কোনো রাতেই আমি দেখি,
অপঘাতে মরে যাওয়া মানুষের পরিপূর্ণ মৃত্যু হয়নি।

কারো উপড়ানো চোখ, কারো ছিঁড়ে ফেলা হাত,
কারো ছিদ্র-যুক্ত লাল বুক,
কারো থ্যাতলানো মাথা, চ্যাপ্টা ক্লান্ত মুখ,
রয়ে গেছে গ্রহে।

আমাকে দেখতে ওরা, আসে, প্রতিরাতে।
কথা বলে, আড্ডা দেয়—মৃত, কিন্তু মৃত নয়
এ-রকম ছায়া ছায়া মানুষের মতো।

রেস্টলেসনেস

কাল যা ভেবেছি, বলেছি, আজ তা—ভালো লাগছে না।
আজ আমি অস্থির, চৌকোনা পিরামিড, ভেসে যাই।
কে যে বলে মানুষের ডানা নাই, শুধু
পাখিদের আছে...

রাত্রিভর দীর্ঘ দেহে বৃষ্টি হয়েছিল। মহাকাশ
থেকে বহ অন্তর্ভেদী আবহাওয়া এসেছিল নেমে
খুব কাছে। এখন সকাল বেলা মেঘ—
জমে আছে—মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত।

গাছগুলি প্রস্থে বেড়ে গেছে—গাছগুলি নগ্ন বুকে
চুপ করে আছে—গাছগুলি ভেজা কাকের মতন
শীর্ণকায়—গাছগুলি ছটফট করছে বাতাসে।

পৃথিবীর হাতে তৈরি তাবুগুলি উড়ে যাচ্ছে
অয়নান্তের ওই পাড়ে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে
বসে আছে, উড়ে যাচ্ছে, এ গ্রহের হাত।

কাল যা ভেবেছি—তা এখন আর—ভালো লাগছে না।
কে যে বলে মানুষের ডানা নাই, শুধু,
পাখিদের আছে; অহমিকা, রাজনীতি,
চিন্তা বা কৌশল পার হলে, মানুষের
অতল পাখিত্বগুলি টের পাওয়া যায়।

মানুষের মেঘ আছে, বৃষ্টি, ডানা আছে—
আছে দূরে উড়ে যাওয়া। মানুষের মন
এ গ্রহের দ্রুততম পাখি, গাঢ় মেঘ।
হয়তো মানুষ—এ গ্রহের ডানাহীন ডানা—

কালরাতে অবিরাম ডানা ঝাপ্টানোর মতো বৃষ্টি
হয়েছিল। আজ ভোরে ডানাগুলি
প্রলম্বিত ঘোলা জল হয়ে ভেসে যায়।

মানুষ ডানাবিহীনতার ব্যথাগুলি
দুই লুলা হাত তুলে ধরে—
কথা দিয়ে বর্ণনা করে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর