মানুষ হিসাবে তিনি যত লোকের পছন্দের ছিলেন, তত লোকেরই ছিলেন অপছন্দের। কিন্তু পছন্দের-অপছন্দের সকল লোকই মিলিতভাবে একটি ব্যাপারে একমত ছিলেন যে, তিনি হলেন তাঁর প্রজন্মের অন্যতম মেধাবী এবং প্রথাবিরুদ্ধ মানুষ।
কবি, লেখক, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ সেই মানুষ, যিনি প্রথা, প্রতিষ্ঠান, চিন্তাকে সচেতনভাবে ভাঙতে চেয়েছিলেন। এজন্য চরম মূল্যও দিতে হয়েছে তাঁকে। মুক্তচিন্তার সবুজ অঙ্গন রাজধানী ঢাকার রমনায় চলমান বইমেলার পাশেই তাঁকে নির্মমভাবে আঘাত করা হয়েছিল ২০০৪ সালে। সে বছরই ১১ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুদূর জার্মানির মিউনিখ শহরে মারা যান তিনি।
মৃত্যুকালে তিনি রেখে গিয়েছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী, তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর, তাঁর দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদকে। এবং রেখে গিয়েছেন নিজের আলাদা পরিচিতি ও নিজস্বতা, যাতে তিনি গতানুগতিক চিন্তাধারাকে সচেতনভাবে অস্বীকার করেছেন। লেখায়, ভাবনায়, বলায় সেটা সরাসরি প্রকাশও করেছেন। নিজেকে প্রমাণ করেছেন বহুমাত্রিক সৃজনের মাধ্যমে, বিতর্ক ও প্রতিবাদের ভাষায়।
নারীবাদ নিয়ে বাংলাদেশে যারা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক চিন্তার সূচনা করেন, তিনি তাঁদের অগ্রণী। ‘নারী’, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ ইত্যাদি গ্রন্থ তাঁর কাজের প্রমাণ হয়ে এখনো পাঠকের হাতে হাতে ঘুরছে।
মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিপদ নিয়েও তিনি কথা বলেছিলেন সশব্দে। ‘পাক সার জামিন সাদ বাদ’ নামের উপন্যাসের মাধ্যমে বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যেও তিনি সাহসের সঙ্গে লিখেছিলেন প্রগতি, মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা। সে পরিস্থিতিতে তাঁর মতো সাহস করে এসব কথা খুব কম মানুষই বলতে বা লিখতে পেরেছেন।
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে যখন মৌলবাদ বিস্তারলাভ করতে থাকে, বিশেষ করে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত, তখন ২০০৪ এ প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' বইটি। বইটি প্রকাশিত হলে মৌলবাদীরা ক্ষেপে ওঠে, তারা হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। বইটিতে উঁনি মৌলবাদীদের, ফ্যাসিবাদীদের কপট চরিত্রের শৈল্পিক রূপ দেন, মুখোশ খুলে ফেলেন সাম্প্রদায়িকতার । আর তারই জের ধরে ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা হয়।
তাঁর মত ও বক্তব্যের সঙ্গে যারা একমত হতে পারেন নি, তাদের সংখ্যাটি কম ছিল না। আঘাত করবার শক্তিও ছিল তাদের। তিনি আক্রান্ত হলেন নারীর অধিকার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার জন্য। নিজের চিন্তা ও বক্তব্যের জন্য জীবন হারাতে হয় তাঁকে।
১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল ঐতিহ্যবাহী জনপদ বিক্রমপুরের (মুন্সিগঞ্জ জেলা) রাঢ়িখাল নামের গ্রামে জন্মে ছিলেন হুমায়ুন আজাদ।
তিনি একজন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং কলাম প্রাবন্ধিক। ৭০ টি'র উপর তার রচনা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী লেখক।
হুমায়ুন আজাদ রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। মেধাবী ছাত্র আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন; উভয় ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ। অধ্যাপনা করেছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শিক্ষা ও পেশা জীবনে সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনার জগতে তাঁর মতো ঔজ্জ্বল্য নিয়ে বিরাজ করেছেন খুব কমজনই। মননশীল গবেষণা আর সৃজনশীল রচনায় তিনি এনেছিলেন স্বাতন্ত্র্য।
তাঁর ভাষা, প্রয়োগ, উপমার ব্যবহার একেবারেই আলাদা, মনস্বিতার দ্যুতিতে প্রোজ্জ্বল। তাঁর রচিত ‘লাল নীল দীপাবলী’ নামের বাংলা ভাষার ইতিহাসভিত্তিক কিশোর গ্রন্থটি লাভ করেছে ধ্রুপদীর মযাদা। তাঁর নিজের মেধা ও পাণ্ডিত্যের উপর এমনই আস্থাশীল ছিলেন তিনি যে, ‘রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত কবিতা’ প্রকাশের মতো সাহস দেখাতেও পিছ পা হন নি।
মেধা, সৃজন ও মননের প্রতি ছিল তাঁর অকুণ্ঠ পক্ষপাত। নিজের বিশ্বাসের প্রতি ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। আর ছিল নিজস্ব বিশ্বাস ও যুক্তিকে তুলে ধরার অপরিসীম সাহস। সমালোচনা করবার ঈর্ষণীয় প্রতিভার জন্য ভালোকে ভালো বলে শনাক্ত করতে এবং খারাপকে খারাপ বলে বর্জন করতে মোটেও কার্পণ্য করেন নি তিনি।
মিনমিনে স্বভাব, চিন্তাহীন আস্ফালন, মূর্খ স্তাবকতা, জ্ঞানহীন বাগাড়ম্বর ছিল তাঁর দু’চোখের বিষ। একটানে এইসব কূপমণ্ডুক ও অসারদের উলঙ্গ করে স্বরূপে দেখিয়ে দিতে তিনি বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করতেন না। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন তাঁর সমকালের মেধাবী, প্রথাবিরোধী, বিশিষ্ট ও অগ্রসর একজন শাণিত মানুষ। নিজের স্বতন্ত্র চিন্তা নিয়ে অগ্রসরমান একজন পদাতিক। শত্রু ও প্রতিপক্ষের ভয়কে অবজ্ঞা করা একজন সাহসী ব্যক্তিত্ব। জীবন বিলিয়ে দিয়েও স্বমতে স্থির থাকা এক প্রস্তরীভূত মানবসত্ত্বা ছিলেন তিনি।
আমার নিজের দিক থেকে বলতে পারি, জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে তাঁর সান্নিধ্যে। বছরের পর বছর বিকাল আর সন্ধ্যাগুলো তাঁকে নিয়ে হেঁটেছি রমনায়, শাহবাগে, আজিজে, ফুলার রোডে। বসেছি সিলভানায়, মৌলীতে, সাকুরায়। তাঁর বহু কথা ও মতের সঙ্গে একমত না হয়েও স্বীকার করতে হয়েছে তাঁর যুক্তির তীব্রতাকে, ব্যাখার গভীরতাকে, মেধার প্রখরতাকে। তিনি জানি না কি কারণে তাঁর বই আমাকে কিনতে বারণ করেছিলেন। নিজের হাতে অটোগ্রাফ দিয়ে অনন্যা থেকে প্রকাশিত প্রতিটি বই তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।
আমি তখন বিংশ শতাব্দীর শেষ আর একবিংশের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অবস্থান করছিলাম এবং যুক্ত ছিলাম তখনকার জনপ্রিয় ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকায়। তাঁর বই এবং তাঁকে নিয়ে আমার কমপক্ষে দশটি বড় মাপের লেখা সে সময় প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু দিব্যি বলতে পারি, তাঁর সম্পর্কে কিছুই যেন লেখা হয় নি আমার। আরও কত কথা অলেখাই রয়ে গেছে। বাকী রয়ে গেছে একজন বহুমাত্রিক হুমায়ুন আজাদের অনেক কথা।
বাংলা ভাষায় স্বর ও ব্যাঞ্জণ বর্ণগুলো যতদিন জীবন্ত ও সচল থাকতে, ততদিন কাউকে না কাউকে তারঁ কথা কোনও না কোনও কারণে লিখতেই হবে। মৃত্যুর পরেও জীবন্ত থাকার বিশ্বাস তিনি করতেন। ইতিহাসের অংশ হওয়ার প্রত্যয় পোষণ করতেন তিনি। মোটেও ভুল বা অহংকার সর্বস্ব ছিল না তাঁর প্রতীতি। স্বকালে ঘাতকের হাতে মৃত্যুবরণ করলেও হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকবেন অনাগত কালে; কাল-কালান্তরে।
কবিতায় নিজের কথা যেভাবে বলে গিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ, সেভাবেই তাঁকে স্মরণ করি:
"মহাজাগতিক সমস্ত ভাঙ্গন চুরমার ধ’রে আছি আমি
রক্তে মাংসকোষে, আমি আজ জানি কীভাবে বিলুপ্ত হয়
নক্ষত্র মণ্ডল, কিভাবে তলিয়ে যায় মহাদেশ
অতল জলের তলে । রক্তে আমি দেখেছি প্রলয়, চূড়ান্ত ভাঙ্গন,
ধ্বসে পড়েছে অজেয় পর্বত, সূর্য ছুটে এসে ভেঙ্গে পড়েছে
আমার তরল মাংসে আগুন জ্বলছে, অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে,
যেখানে পাখির ডাক নেই, নেই এক ফোঁটা তুচ্ছ শিশির।
অনেক অভিজ্ঞ আমি আজ, মৃতদের সমান অভিজ্ঞ ।"