মানুষ মূলত, তবু, আগের মতোই; অনিশ্চিত

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

সিদ্ধার্থ হক | 2023-08-31 19:45:31

বসন্ত

বসন্তে সমস্ত কিছু ডাকে—বাতাস স’ মিল—
দালানের বহু উঁচু কাচের দেয়াল—স্ট্রেঞ্জ, জটিল,
রাত—সব, কাকে যেন ডাকে। দেয়ালের ওই পাশে,
সারাদিন, স্বর্ণ-চিল, ডানা মেলা করাতের
মতো, দালানের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে, কাচ চূর্ণ
করা ডাক, থেকে থেকে দিতে থাকে।
এ শহর, চুপ করে বসে, তাকে শোনে।
কনসট্রাকশনের শব্দের ভিতর দিয়ে
ছাদের উপরে হাঁটে কয়েকটি সময়।
আমার মাথার মধ্যে অ-বিরাম ফ্যান।

হয়তো মানুষ ডাকে—দালানের অভ্যন্তর থেকে—
বের হতে পারছে না বলে।
তাদের ডাকের শব্দ অভিমতহীন, অভিযোগহীন,
কিন্তু স্থির, ক্রমাগত। বহুদিন দালানের অভ্যন্তরে
বন্দী হয়ে থেকে, গেট খুঁজে না পেয়ে, মানুষরা ডাকে।

দূরের দালান, লোহার অসীম গান,
দুপু্রের, বাতাসের ঢালু স্বর, গুম গুম, গলা।
বসন্তের মেলানকোলিক বিনির্মাণ—নির্মাণের
বহু বহু নিচ থেকে এসে, পুনশ্চ বিমর্ষ সেও—
অংশে অংশে ছড়ায় ইথারে।

উদ্ভিদের মধ্য থেকে, অমূলক, জিজ্ঞাসু পাখিরা,
সঙ্গীর সন্ধানে ডাকে। ডাক ব্যর্থ হলে,
চুপ করে বুক খোটে। সব শেষে উড়ে চলে যায়।
নগরের অদৃশ্য গোলত্বে, পাখিদের ডাক কিম্বা
অন্য শব্দ শুনে মনে হয়,
মানুষ ক্লান্ত খুব, তবু কথা বলছে বারবার।

সত্যিই কি বসন্ত এখন? ধূর্ত, ধ্বস্ত ধূলার নগরে—
এ বসন্ত তোমার নীরব মনে, চৈতন্যের ছাদে হাঁটা গান।

ঘুম

অল্প অল্প বৃষ্টি হয়। অল্প অল্প সাদা পিঁপড়া নামে।
পৃথিবীর সারি সারি ধবল মাইল পোস্ট, আমাদের ঘুম,
দিগন্তের একপ্রান্ত থেকে
অন্য প্রান্তে, টেনে টেনে নিয়ে চলে যায়।

বহু রাত; শরীর ঘুমের জন্য প্রস্তুত কি হলো?
কিন্তু বিছানায় গিয়ে দেখি, আসলে হয়নি।
জানলার ওই পাশে যোগসূত্র।
বাতাস প্রবাহিত থেমে থেমে। উদ্ভিদের
বেদনার মতো ছায়া ছুটে গেল এর ওর কাছে।

গাছগুলি এত স্থির, মনে হয় তাদের সমস্ত ইচ্ছা,
মিটে গেছে; আজ ওরা, গাছ নয়,
স্পৃহাহীন সারি সারি থাম।
চোখ বুজে দেখা যায়, চোখ বুজে আছি—
ধীরে ধীরে দেখি,
গাছের ভিতর দিয়ে নির্বাসিত গাছেরা হাঁটছে।

কে যেন প্রস্তুত হয় প্রথমত, কে যেন দ্বিতীয়তঃ
কেউ কেউ রাজি হলো। রাজি হওয়া মনের ভিতরে—
দ্বীমত পোষণ করে যে, সে, সেকি অন্য কেউ?
কিছুই ঘুমায়নি, আমি আর কিভাবে ঘুমাব।

শরীর লম্বা হয়ে স্পেসে শুয়ে আছে। কিম্বা স্পেস
শুয়ে লম্বা শরীরের মতো হয়ে গেছে।
ভেসে ওঠা লাটিমের প্রায়, এই মন, শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে,
কোথায় যে গেছে। নিবিড় জঙ্গলে হাঁটছে রাত্রির ছায়া।
উদ্ভিদের আড়ালে আড়ালে বহু অন্ধকার প্রেম—

অল্প অল্প বৃষ্টি হয়, অল্প অল্প পিপীলিকা নামে।
লাইট হাউজের আলোর মতো—বাধাপ্রাপ্ত
হতে হতে ঘোরে কিম্বা ভেবে চলে ঘুরবার কথা।

বৃষ্টি

কাল সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছিল। আজ, বাতাস, উদ্ভিদ, সব,
সবুজ প্রবাহ। ডাল, আমের মুকুল নিয়ে,
মাটির আরো কাছাকাছি নেমে গেছে।
বিরাম পেয়েছে খুঁজে অস্থির কোকিল—
ভোর থেকে, রাতের প্রশান্তি সব পাতার ভিতরে।

কাল সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছিল;
মানুষ মূলত, তবু, আগের মতোই;
অনিশ্চিত, ভীত, রূঢ়, উদ্ধত, সশব্দ।
যেন কাল বৃষ্টি হয় নাই, সাইরেন বেজেছিল।
ক্রমাগত ঝরতে থাকা বৃষ্টির অন্তর্নিহিত নীরবতা
মানুষের মনকে নীরব করে নাই।

আমি এক না মানুষ না গাছ ধরনের।
চেয়ারে গাছের মতো বসি, কিন্তু
শ্রম আর বিরামহীনতা বুকে নিয়ে,
মানুষের মতো হাঁটতে থাকি। ঘরে ফিরে
দেখি জানলার পাশে পথ বসে আছে।

ধীরে ধীরে কিছু কথা পাই এ হৃদয়ে।
বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু তার নীরবতা,
আমার ভিতরে খুঁজে পাই, পেয়ে যাই।

ভ্রমণ

মাইল মাইল সুপারি বাগানে, উদ্ভিদের স্থিরতা,
চোখে প্রশ্ন নিয়ে, দাঁড়িয়ে রয়েছে, প্রবাহিত হতে হতে
মানুষের দ্রুত বেগে চলে যাওয়া, পথ-পার্শ্বে
দাঁড়ানো বা না দাঁড়ানো দেখছে চুপ করে।
ঘন বাছুরের মুখ ঘাসে নিমজ্জিত, মাঠে মাঠে।
ঝাউ বন। বাতাস হাঁটছে। পিছনে পাহাড়,
অনেক সবুজ চাকা তার বুকে শব্দহীন।
সাইকেলে চালাতে চালাতে, সাদা সূচিপত্র
হাতে নিয়ে ছুটছে সমুদ্র—নীল মেরিন ড্রাইভ।
রোহিঙ্গাদের সন্ত্রস্ত, ঝাপড়া ঘর। তাদের অস্তিত্ব
ঘিরে, নতুন ও পুরান রাস্তা চলছে পাশাপাশি।

হঠাৎ, জমির মধ্যে, টলটলে, গাছহীন, একটি পুকুর।
চাষের জমির মধ্যে পুকুর কে কাটে, কেন কাটে?
সবিস্ময়ে দেখি, মানুষ ঘুমাচ্ছে খেতে, হেলে পড়া
ফসলের মতো; সঙ্গম করছে মাঠে, জন্ম দিচ্ছে ঘাসে
শুয়ে বসে। জমির পুকুরে নেমে, স্নান করছে
সংসার বেদনা কেঁচে, ধুয়ে ফেলবার চেষ্টা করছে।
টেকনাফের পথে পথে, সমস্ত সময়, ঝাপড়া ঘরে
শুয়ে আছে—মুখ ধুচ্ছে আলে বসে। দূরে ঝাউবন।
সেখানে সাম্পানগুলি বহু রঙা, শুধু কালো নয়।

সুপারি বাগানে টানা স্টিম ইঞ্জিন, পাতার রেললাইন।
কোথায় না কোথায় সে চলে যায় হুইসেল বাজিয়ে,
না বাজিয়ে, কালো বিড়ালের মতো। বহু পরে—
পৃথিবীর শেষ মফস্বল—গাছপালা ঘেরা টেকনাফ।

তখন দুপুর; অমোঘ বাজারগুলি তেরপলে ঢাকা।
তারপর নাফ নদী, নিখিলের অনিদ্রিত খাঁড়ি।
বাহু বিস্তৃত পিয়ার। ক্ষুদ্র রোহিঙ্গা শিশু
পিয়ারের অদূরে হাঁটছে। তাকে দেখে চমকে উঠি
তার মুখে, লক্ষ লক্ষ স্কেটিংয়ের দাগ—তার মুখের ওপর
দিয়ে কোটি কোটি পথ ক্রিসক্রস করে চলে গেছে।
এত বলিরেখা জাগা কোনো শিশুর মুখ,
আমি আগে কখনো দেখিনি।
খেলা শেষে সকলেই চলে গেছে ঘরে।
তথাপি অদৃশ্য কেউ, তার মুখে, ক্ষমাহীন স্কেটিং
করছে এখনো। বোঝা যায়,

সামান্য বয়স থেকেই মানুষ চিন্তিত হতে শেখে—
তার মুখে বয়স্কদের বিমর্ষতা, বলিরেখা জাগে।

টেকনাফ; রোহিঙ্গা শিশুর মুখের বয়স্ক বেদনা, বলি রেখা;
সুপারি বাগানের সন্ধ্যা; যে সন্ধ্যা, সন্ধ্যার অনেক আগে
নেমেছে, এখানে পৃথিবীতে, মানুষের ভুলে, ভুলে।

আরেক ইতিহাস

আরেক ইতিহাসের পথে আমি ক্রমশ হাঁটছি।
দেখছি সকল কিছু জাক্সটাপোজড্ হয়ে আছে।
ঘাস সাদা শূন্যে ভাসমান; এক শূন্য অন্য শূন্যে
ঢুকে গেছে। বড়, ক্ষুদ্র, মৃত্যু, ক্যাফে—সব—
পাশাপাশি নৌকা বেয়ে চলেছে পাথারে।

বাতাসে-পিয়ানো—বাঁশেঝাড়ে রাত্রির লম্বা গান।
যখন সে গান শুনি, মনে হয়, এ পৃথক পথেও,
তুমি কাছে থাকলে ভালো হতো।
যখন নিশ্চুপ সব গান, দূরের বাতাস কাছে
ঘোরে, টের পাই, আলাদা গল্পের পথে,
তোমাকে সরিয়ে দেয়া, সম্ভব হয়নি।
বারবার এই দেখি, এক গল্পে তুমি
কাছে আছো। অন্য গল্পে নাই।

বিনির্মিত হতে হতে অরণ্য নির্মূল হয়, তবু,
মাটির অতলে বসে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখে।
অনেক ক্ষুদ্রতা আর অনেক মহত্ব বুকে নিয়ে,
এখন ঈগল, নগরের দালানের ফাঁকে ফাঁকে উড়ে,
গভীর মনোবেদনার মতো কাচ চূর্ণ করা ডাক দেয়।

অনেক ক্ষুদ্রতা আছে, মহত্বও আছে।
তুমি তার কোনটা দেখো, কেন?
এ পথে সকল কিছু জাক্সটাপোজড্ হয়ে আছে।
ইতিহাস-হৃদয়ের মধ্য দিয়ে আমি
নির্জন লাইন হয়ে ঘুরছি, আগাচ্ছি, পিছিয়ে যাচ্ছি।
যে সকল অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে মনে
নিজেই বহন করছি তার সব ভার।

অভিযোগে পৃথিবীর আস্থা নেই—প্রশংসায়েও নেই—
শুধু বিনির্মাণে আছে—দেখেছি এ ইতিহাস
শরীরের ছিলকার মতো—দেখছি এ ইতিহাস
একা বসে থাকবার দাবি।
মহাশূন্যে ঘাস ওঠে, দালানে ঈগল ঘর খোলে।
ইতিহাস, ঘুমায় ও জেগে থাকে, লক্ষ্য করে যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর