“দুই নাম্বারি মুক্তিযোদ্ধা সচিবরা আমারই বন্ধু”

সাক্ষাৎকার, শিল্প-সাহিত্য

রোজেন হাসান, অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিচার এডিটর | 2024-01-02 19:59:56

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ উপলক্ষে বার্তা২৪-এর বিশেষ আয়োজন বইপ্রহরে কথাসাহিত্যিক আন্দালিব রাশদীর সঙ্গে কথা বলেছেন কবি ও সাংবাদিক শিমুল সালাহ্উদ্দিন। কথা হয়েছে মূলত এবারের বইমেলায় আসা তাঁর নতুন বইগুলো নিয়ে।

আলাপকালে আন্দালিব রাশদী জানিয়েছেন বইমেলা নিয়ে তাঁর সারাবছরের প্রস্তুতি এবং আগ্রহের কথা। উপন্যাস, অনুবাদগ্রন্থ এবং চিত্রকলা বিষয়ক বইসহ এবার মোট ৭টি বই প্রকাশিত হচ্ছে। এরমধ্যে উপন্যাস ৪টি, অনুবাদ গ্রন্থ ২টি এবং চিত্রকলার ওপর ১টি।

লেখালেখির শুরু থেকেই আন্দালিব রাশদী একাগ্র নিষ্ঠায় মননশীল এবং সৃজনশীল দুই ঘরানাতেই সমান উত্কর্ষের পরিচয় দিয়ে এসেছেন। তিনি উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং গল্প লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বই।

আন্দালিব রাশদী তাঁর উপন্যাসে বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপন যেমন করেন তেমনি সেই বাস্তবের সাথে মেশান কল্পনার অবিরল ফল্গুধারা। বইপ্রহরে শিমুল সালাহ্উদ্দিনের সাথে নিজের নতুন উপন্যাস ‘সচিব সাহেব’ নিয়ে এ বিষয়গুলোই প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠে, তিনি বললেন, “দুই নাম্বারি মুক্তিযোদ্ধা সেজে একজন কিভাবে সচিব হয়, সচিব হয়ে তারপর কিভাবে তার পদ-পদবি ব্যবহার করে দেশকে এক্সপ্লয়েড করে এইসবই আমার বর্ণনায় উঠে এসেছে।”

এসব আমাদের জাতীয় বাস্তবতারই অংশ দাবি করে তিনি বলেছেন, “এরা আমার বন্ধুরাই, বাইরের কেউ না। চরিত্রগুলি আমার পরিচিত, পড়ে আপনাদেরও মনে হবে আরে! আমিও তো উনাকে চিনি। সেই সচিব, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আবার তাদের সন্তানরাও সেই বেনিফিট নিয়ে বিভিন্ন পদ-পদবী, সম্পত্তি ইত্যাদি কিভাবে অর্জন করে, গ্রহণ করে—সেসব কাহিনী নিয়ে এই ‘সচিব সাহেব’ উপন্যাসটা।”

নিজে দীর্ঘদিন সচিব পদে দায়িত্বপালনের কারণে আমলাতন্ত্রের নাড়ি-ন্ক্ষত্র জানেন খুব ভালোভাবে। কিন্তু এই জানার অভিজ্ঞতাকে তিনি এইবার শিল্পের চৌহদ্দীতে নিয়ে এসেছেন। আন্দালিব রাশদীর সচিব সাহেব উপন্যাসটি প্রকাশ করছে কথাপ্রকাশ।

সিরিয়াস পাঠক হিসেবে আন্দালিব রাশদীর খ্যাতি আছে। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে আছে অগাধ জানাশোনা ও বোঝাপড়া। তার পঠনতালিকায় ইতিহাস, কবিতা, কথাসাহিত্য যেমন আছে, তেমনি আছে সাম্প্রতিক সাহিত্যের বিভিন্ন প্রবণতা এবং সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে মৌলিক অনুসন্ধান—যেখানে তিনি আবার শিল্পিত চৌর্যবৃত্তিকে প্রাধান্য দেন। এর সমর্থনে বইপ্রহরে তিনি বললেন, “আমি পড়ি মূলত শিল্পিত চৌর্যবৃত্তির প্রবণতা নিয়ে। আমি মনে করি এটা থাকতে হবে, এটা হচ্ছে আমি কত শিল্পিত উপায়ে তা ধারণ করতে পারি এবং আমার করে প্রকাশ করতে পারি সেটা। আমার মনে হয় এইধরনের শিল্পিত চৌর্যবৃত্তি, এটা বোধহয় খুব খারাপ কিছু না।”

কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক আন্দালিব রাশদী এদেশের সেইসব বিরলপ্রজ লেখকদের একজন যাঁরা লিখে উপার্জিত টাকায় সংসার চালান। সারা বছরই লেখেন দুহাত ভরে। সেসব লেখা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজপোর্টালে প্রকাশিত হয়। আন্দালিব রাশদীর পঠন-পাঠন ও জানাশোনা এতই সর্বব্যাপ্ত যে তাঁর হাতে যে কোনো ফরমায়েসী লেখাও হয়ে ওঠে একেকটি যথার্থ মননশীল রচনা। তাঁর সৃজনশীল লেখালেখির বিচরণক্ষেত্র মূলত উপন্যাস ও গল্প। অনুবাদে সিদ্ধহস্ত আন্দালিব রাশদীর বিষয়-নির্বাচন বরাবরই চমকপ্রদ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এবারের বইমেলায়ও একাধিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অনুবাদ মিলিয়ে আন্দালিব রাশদীর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে ও হতে যাচ্ছে। আজকের ‘বইপ্রহর’-এ থাকছে সেইসব বইয়ের খবর। 

জানান, এ বিষয়ে বহু বছর আগে লেখা নিজের একটি ছড়ার কথা। যেখানে এক বালক রবীন্দ্রনাথকে বলে, তুমি কোত্থেকে চুরি করেছো সব আমি জানি। রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে? তখন বাচ্চাটা দেখিয়ে দিল, এই যে অভিধান থেকে। বলল, তোমার প্রত্যেকটা শব্দ এই অভিধান থেকে নেওয়া।

পাবলো নেরুদার স্ত্রী মাতিলদা উরুটিয়া নেরুদাকে নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন—‘মাই লাইফ উইথ নেরুদা’। আন্দালিব রাশদীর অনুবাদে বইটি বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত। নেরুদার সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রতিতুলনায় তিনি বললেন, “পাবলো নেরুদার মতো বহুল পঠিত কবি পৃথিবীতে আর একজনও নেই। আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যত গর্বই করি না কেন—রবীন্দ্রনাথ আমাদের খুব প্রিয় কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রিয় না।” আন্দালিব রাশদী মনে করেন, এ বইটি নেরুদা আর মাতিলদার প্রেমের উতুঙ্গ সময়কে ধরে আছে, সে হিসেবে বইটি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বইটি অনুবাদ করে তিনি তৃপ্তি পেয়েছেন বলেও জানান সাক্ষাৎকারে।

মূলত লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকে তুলে ধরতে দুই বন্ধু-শত্রু মার্কেজ এবং ইয়োসাকে নিয়ে তাঁর আরেকটি বই—‘গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও মারিয়ো ভার্গাস ইউসা’ মেলায় এনেছে কথাপ্রকাশ।

‘এসএসমএস যুগের আগে’ নাম নিয়ে তার আরেকটি উপন্যাস আসছে এই বইমেলায়। প্রযুক্তির কল্যাণে বিদ্যুৎ-গতিতে পরিবর্তিত সমাজ এবং সভ্যতার ছায়াহীনতায় মানুষেরা তাদের পূর্বেকার যে সহজ-স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে বসেছে, সেই যুগকে নিয়েই এই উপন্যাস।

বিশ্বসাহিত্যের কয়েকজন লেখকের গল্পের অনুবাদ নিয়ে তাঁর আরেকটি বই—‘আমরা অমৃতসর পৌঁছে গেছি’। এখানে বিশ্ব সাহানির লেখা নামগল্পটি দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে সাদত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দরের গল্পের সাথে পরিচিত বাংলাদেশের পাঠকদের মনে দাগ কাটবে।

চিত্রকলার ওপর আলোঘর থেকে প্রকাশিত ‘বিশ্বসেরা ৫১ চিত্রশিল্পী’ বইটি নিয়ে তিনি বলেন, “পেইন্টিংয়ের ওপরে এ ধরনের কালারফুল বই এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। এটা মূলত যারা পেইন্টার এবং পেইন্টিং নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য লেখা, বইটা পড়ে আগ্রহ আরো উসকে যাবে তাদের।”

আন্দালিব রাশদীর আগ্রহের পরিধির বিচিত্রতাও বিস্ময় জাগানোর মতো। তাঁর অতলগামী অভিজ্ঞতার একটু পরিচয় পাওয়া যায়, যখন তিনি বইপ্রহরে ‘সচিব সাহেব’ উপন্যাসের ব্যাপারে জানাতে গিয়ে বর্ণনা করেন—“আমরা যখন সচিবালয়ের করিডোর দিয়ে হাঁটি, আমার শরীর যত চিকনই হোক কিন্তু মনে হয় এই করিডোরটা খুব অপ্রশস্থ। আমাকে ধারণ করতে পারে না। তখন আমাদের হাত প্রসারিত হয়ে যায়, আমাদের অজান্তে আমাদের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়, আমাদের প্রস্থ বেড়ে যায়। আমরা এর মধ্যে চলতে থাকি।”

নিজের অভিজ্ঞতার বরাতসহ আমলাতন্ত্রকে তিনি বর্ণনা করেন এভাবে—“আমলাদের একটি বিশেষ প্রবণতা—এটাকে বলা হয় ম্যাগালোম্যানিয়া—আমরা কী হয়ে গেছি আমরা কত বড়!”

এ সম্পর্কিত আরও খবর