জোনাকি নাকি জুনিপোকা

, শিল্প-সাহিত্য

তানিয়া চক্রবর্তী | 2023-08-31 17:36:44

আসলে এই দুইনামের অধিকারী একইজন। হ্যাঁ পোকা তো বটেই, কিন্তু এত সুন্দর পোকা যে অন্ধকারের মাঝে বিন্দু বিন্দু আলোর চমক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যেন একটি ডিজাইন করা চাদর সারা পৃথিবী রাতের বেলা গায়ে দিয়ে আছে। রূপকথার গল্পে দেখা যায় সুন্দরী রানি কিম্বা পরি তার ইয়া বড় খোঁপাতে জোনাকিদের বসিয়ে অভিসারে যাচ্ছেন। বিজ্ঞান, রাসায়নিক যুক্তি এসব তো আছেই কিন্তু আমরা তো রোবট নই, আমরা রোবটের আবিষ্কর্তা জাতি যাদের মধ্যে ভরপুর রসবোধ আছে। আর যার জোরে এখনো “মানবিকতা” শব্দটি আমাদের মধ্যে ব্যবহৃত, যার জন্য এখনো জীবনের কথা লাইনের পর লাইনে সংকেতে, ঈশারায় বলার খেলা চলে। যেখানে সূর্যের আলো চলে যাওয়ার পরও আমরা আক্ষরিক একা হই না। আলোকবর্ষ দূরে সেই তারাদের কথা বইতে পড়া, কল্পনায় টমটিম করে জাগিয়ে রাখা সে তো দূরের কল্পনার খেলা। কিন্তু সেই খেলার সমসাময়িক এক জোনাকির আলো আমাদের অস্বচ্ছ মুহূর্তকে একরকম প্রহেলিকা বানিয়ে রাখে।

বাংলাদেশের এক বন্ধুর কাছে শুনছিলাম সিলেটে নাকি এখনো জোনাকিকে “জিনিপুক” বলে আদরের নামে ডাকা হয়। ২০ হাজারের বেশি ভিন্ন প্রজাতির জোনাকি বর্তমান। তাদের আলোর রঙের বৈচিত্র্যময় পার্থক্য আছে লাল, কমলা, সবুজ। জোনাকির এই আলোর ঘটনা নেহাত একটি রাসায়নিক ঘটনা যার নাম বায়োলুমিনেন্স, সেই বিষয়ের গভীরে যাচ্ছি না তবু একটা কথা বলা উচিত দেহের প্রায় অর্ধেক ওজন জুড়ে এই আলোর অবস্থান প্রতিপত্তি। আলোর পুরোটাই নিছক আলো, তাপের কোনো বিষয় নেই। ফায়ারফ্লাই, মিন্না মিন্না, গ্লো ফ্লাই, কুনাং কুনাং, গোল্ডেন স্পার্কলার নামের ইয়ত্তা নেই মহাশয়ের। একবারে সব আলো দেখানও না, ছন্দবদ্ধ খেলার মতো জ্বলা-নেভা এই তার কাজ।

ছোটবেলায় ভাবতাম আমাদের ছোটদের অন্ধকারে ভরসা দিতেই ওরা আসে। তারপর গল্প শুনতাম আমাদের ঘরে লাইটের মতো পাখিদের ঘরেও তো লাইট চাই তাই পাখিরা ওদের ঘরে নিয়ে গিয়ে লাইট জ্বালায় এমন কত আহ্লাদিত ভাবনা জুড়ে জোনাকিরাজ্য। আসলে তারা তো মিলনের জন্য আলো জ্বালায় তা ছাই বুঝতাম। তবে এক অদ্ভুত কথা শুনেছিলাম নিজস্ব প্রজাতির বাইরে ওরা মিলন করে না, ভুলবশত এমন ঘটনা ঘটলে মেয়ে জোনাকি পুরুষ জোনাকিকে মেরে ফেলে। বড় মেয়ে জোনাকিরা ডিম পেড়ে অনেকসময় মরে যায়। সাধাসিধে এই নরম পোকাদের মধ্যে দুষ্টুমি নিছক মজার নয়, শোনা যায় মেয়ে জোনাকি বিব্রত হলে আলোর খেলায় পুরুষ জোনাকিকে আকৃষ্ট করে তারপর খেয়ে নেয় আবার এমন জোনাকি আছে যারা আলো জ্বালায় না শিকারের প্রয়োজন না হলে। জোনাকি নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর দারুণ এক কবিতা আছে সেখানে কবি জোনাকিকে শহুরে কলকাতার আলোতে এসে থাকতে দেখে অবাক হয়েছেন, তার তো গ্রামের আঁধারে, বাদল রাতে ঘুরে বেড়ানোর কথা “এ কী জোনাকি/ তুই কখন এলি বল তো/ একলা এই বাদলায়”

আসলে আমাদের জীবনও তো একরৈখিক নয়, সেখানে বার্তা নিয়ত বদলায় আর এই গোটা পৃথিবী একটা গোটা সৌরজীবনের সংকেত সেখানে এই পোকামাকড়, গাছপালা, পাখি, ফুল, ফল সব এক একটি রক্ষণাবেক্ষণের উপাদান। আর আমাদের গোটা একপ্রবণতাপূর্ণ জীবনে এইসব চমক হলো নশ্বর বেঁচে থাকার আনন্দ।

জোনাকি সেই আলোর আবেদন যা মিশমিশে দুর্বোধ্য অন্ধকারকে রহস্যের রং দিয়ে রাঙিয়ে দেয়—যেন প্রাণ—যেন এক মুক্তির ছোট ঈশারা।

রবার্ট ফ্রস্ট এর ফায়ারফ্লাইজ ইন গার্ডেন কবিতার কিছু লাইন

“HERE COME REAL STARS TO FILL THE UPPER SKIES,/AND HERE ON EARTH COME/EMULATING FLIES,/THAT THOUGH THEY NEVER EQUAL / STARS IN SIZE/ACHIVE AT TIMES A VERY STAR-LIKE START./ONLY,OF COURSE, THEY CAN’T SUSTAIN THE PART.”

এ সম্পর্কিত আরও খবর