তিন বিশ্বকাপের গল্প

, শিল্প-সাহিত্য

শাকুর মজিদ | 2023-08-27 16:24:28

ঘটনা এক
৮ জুলাই, ১৯৯০ । ম্যারাডোনা , ম্যারাডোনা
বিকেল থেকেই প্রতীক্ষা কখন রাত বারোটা বাজবে। বিকেল বেলা রাসেল আমার সাথে বাজি ধরল। আমি বলি জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হবে, রাসেল আর্জেন্টিনা। সে আমার সাথে বাজি ধরতে চায়। বাজির শর্তটাও ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। শর্ত ছিল জার্মান যদি জেতে সে আমাকে পাঁচ টাকা দেবে আর আর্জেন্টিনা জিতলে আমি তাকে দশ টাকা দেবো। আমরা দু’জন মা’র কাছে পনের টাকা জমা দিলাম।

সন্ধ্যাবেলা আমি বললাম, দ্যাখ, তোদের গোল দেবার যে এক ক্যানিজিয়া  ছিল, সে আজ খেলতে পারবে না, শুধু শুধু পাঁচটা টাকা নষ্ট করিস না, বাজি তুলে নে।’
রাসেল ক্ষেপে গিয়ে বলে ‘ক্যানিজিয়া নাই তো কী হয়েছে, বুরুচাগা আছে। ম্যারাডোনা বল বানাবে, বরুচাগা গোল দেবে।’

রাসেল আমার পনেরো বছরের ছোট। তার বয়স তখন দশ, আমাদের গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি তখন বুয়েট, তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। বুয়েটে থাকার সময় হলের টিভি রুমে ছেলেদের কাছ থেকে নানা খেলোয়াড় সম্পর্কে নানা রকমের পরিসংখ্যান শুনতাম। কিন্তু এসবের খবর সিলেটের একটা প্রত্যন্ত গ্রামেও যে চলে গিয়েছিল, টের পাইনি। মনে মনে বললাম, এই একটুখানি ছেলে আবার ক্যানিজিয়া-বুরুচাগাও চিনে ফেলেছে!
রাসেল খানিক থেমে বলল, ‘ক্যানিজিয়া মাঠে নামলে আমি বরং তোমার সাথে একশো টাকার বাজি ধরতাম।’
সে তার বাজি ফিরিয়ে নিলো না, বরং আমাকে টিপ্পনি কাটতে লাগল যে পাঁচ টাকা দিয়ে সে আজ দশ টাকা লাভ করবে।

রাত তখন নয়টা। রাসেল যে কামরায় পড়াশোনা করে সেখানে টেবিলের ওপর ম্যারাডোনার একটি পোস্টার, ১৯৮৬ সালের একটা গ্রুপ ছবি। দেখি রাসেল ছবিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, পাশে মা। আমি ঢুকতেই মা বললেন, রাসেল ম্যারাডোনার পা ছুঁয়ে বলছে ‘ও ম্যারাডোনা তোর পায়ে ধরি ভাই, আজ ভালো খেলিস।’

আমাদের বাড়িতে তখন বিদ্যুতের সংযোগ এসেছে, কিন্তু দু’তিনদিন আগে ঝড়ের কবলে পড়ে কোথাও একটা খুঁটি উল্টে যাবার কারণে ক’দিন ধরে বাড়িতে বিদ্যুৎ নাই। আমাদের টেলিভিশন ব্যাটারিতে চলে। সেই  ব্যাটারি চার্জ দিয়ে আনতে হয় বিয়ানীবাজার থেকে। আজ সকালেই রাসেল তার লোকজন নিয়ে বিয়ানীবাজার গিয়েছে। সারাদিন বসে থেকে সন্ধ্যায় ফিরেছে ফুল চার্জ দেওয়া ব্যাটারি নিয়ে। তার দলবল নিয়ে রাতে খেলা শেষে মিছিল দেবে—উঠানে এমন ব্যবস্থাও রেখেছে। ভাঙা কুলার ওপর আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে ম্যারাডোনার কয়েকটি ছবি। মিছিলের সময় এগুলো কাজে লাগবে—এই তাদের পরিকল্পনা।

রাত বারোটা বাজে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের বাড়িটা বর্ষাকালে অনেকটা দ্বীপের মতো হয়ে যায়। বিদ্যুৎ নেই। ব্যাটারিতে একটা সাদাকালো ১৪ ইঞ্চি টেলিভিশন চলে। অন্ধকার রাত। এর মধ্যেই কাদামাখা পিচ্ছিল পথ, হারিকেন-টর্চলাইট হাতে ছাতা মাথায় প্রবেশ করতে থাকে গ্রামের ছেলেরা। তাদের সবার প্রত্যাশা আজ ম্যারাডোনার খেলা দেখবে। তারা জানে ম্যারাডোনা একজন খেলোয়ার যে খেলার মাঠে জাদু দেখিয়ে থাকে।

আগত একজনের ভূগোল জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্য বললম, ‘আচ্ছা বলো তো ঢাকা দূরে না আর্জেন্টিনা দূরে?’  ছেলেটি বলল, ‘ঢাকা দূরে।’
রাসেল পাশে ছিল। সে বলল, ‘দূর বোকা আর্জেন্টিনা অনেক দূরে।’
আমি রাসেলকে বললাম, ‘বল তো আর্জেন্টিনা কত দূরে।’
সে বলল ‘অনেক দূরে লঞ্চের থেকে দূরে।’
আমি আরেক জনকে বলি, ‘তোমাদের আর্জেন্টিনা তো জিতবে না, কারণ ৪ জন বাঘা বাঘা খেলোয়াড় আজ খেলতে পারবে না। অবজ্ঞার সুরে সে আমাকে বোঝাল, ‘চারজন খেলবে না  তো কী হবে, আর্জেন্টিনা ইন্ডিয়া থেকে প্লেয়ার আনবে।’

অবশেষে খেলা শুরু হলো। জার্মানির পায়ে বল। ছোট্ট এই টেলিভিশনের পর্দায় কোথাও ম্যারাডোনাকে না দেখে চোখ মুখ শুকিয়ে ফেলেছে ওরা। ষোল মিনিটের মাথায় থ্রো করতে ম্যারাডোনার দেখা। একসাথে সবাই ম্যারাডোনা-ম্যারাডোনা বলে চেঁচিয়ে উঠল। কিন্তু ম্যারাডোনার পায়ে ছিয়াশির মতো বল পড়ে না, আর্জেন্টিনা গোলও দিতে পারে না। খেলা শেষ হবার ছ’ মিনিট আগে জার্মানি প্যানাল্টি পেল। যে মুহূর্তে গোল হলো, রাসেল একটা ‘ইশ’ শব্দ করে বালিশে মুখ গুঁজে রইল, খেলা শেষ। ম্যারাডোনাকে দেখা গেলো অশ্রু বিস্ফোরিত চোখে মেডেল নিতে এগিয়ে আসছে। রাসেল এক পলক দেখে আবার শুয়ে পড়ল।

টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধ হয়েছে, কিন্তু রাসেল আর ওঠে না। অনেক বলে কয়ে তাকে এ বিছানা ছাড়ালাম, কিন্তু সে মেঝের ওপর একটা পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে, কারো সাথে কথা নেই। রাসেলকে বললাম ‘তোমার পাঁচ টাকা তো গেল।’ রাসেল জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। খানিক পরে তাকে পাজাকোলে করে আমার বিছানায় এনে শুইয়ে দিলাম।

ভোরবেলা আমি তৈরি হচ্ছি ঢাকা যাব। রাসেল চায়ের কাপে বিস্কিট চুবিয়ে খাচ্ছে। কারো সাথে কথা নেই। দুষ্টমি করে মাকে বললাম ‘আমার টাকা?’  মা রায় দিলেন, সবগুলো টাকা  রাসেলকে দিতে হবে। আমি টাকা এনে রাসেলের কাছে রাখলাম। সে কোনো কথা না বলে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো। খানিক পরে বলল, ‘তুমি জিতেছো, এ টাকা তোমার।’

আমি ফের তার কাছে টাকাগুলো রেখে ঢাকা ফেরার জন্য তৈরি হলাম।

বেলা দুটোয় ট্রেনে উঠি। পারাবত এক্সপ্রেস। হঠাৎ আমার ক্যামেরার ব্যাগটি খোলার দরকার হলো। ব্যাগ খুলে বিস্ময়ের সাথে আমি লক্ষ্য করি, রাসেলকে ফিরিয়ে দেওয়া সেই পনেরটি টাকা সযত্নে ব্যাগের মধ্যে পড়ে আছে।

ঘটনা দুই
১৩ জুলাই ২০১৪ । একে একে নিভিছে দেউটি
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ রাতেই তবে শেষ! একে একে নিভিছে দেউটি....মাইকেলের লেখা এ চরণটির কথা মনে পড়ে গেল।

গত একমাস ধরে আমাদের রাতের রুটিনটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। সকাল থেকেই প্রতীক্ষা থাকত, আজ কার খেলা দেখব! সন্ধ্যা থেকেই খেলার আড্ডায় বসে পড়া। প্রথম দিকে ছিল ম্যারাথন আয়োজন। রাত দশটা, বারোটা আর দুটোয় তিন ম্যাচে ছয় দলের খেলা দেখে তবে ঘুমাতে যাওয়া।

বিশ্বকাপ ফুটবলটা আমাদের এমন মাতায় কেন?

আসলে, বিশ্ব অঙ্গনে যেতে না পারলেও, এই খেলাটি আমাদের গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেক শিশু কিশোরের প্রিয় খেলা। ঘরের বাইরে উঠোন পেরিয়ে কাদামাটির চত্বরে জাম্বুরা দিয়ে ঠেলাঠেলি করে এই খেলা কখনো খেলেনি, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এমন কিশোরের খোঁজ পাওয়া কষ্ট হবে। সুতরাং এই খেলা নিয়ে প্রত্যেক বাঙালির একধরনের নস্টালজিয়া আছে।

আমার দেখায়—সত্তরের দশকে এইদেশে খেলার সবচেয়ে বড় আয়োজন ছিল ফুটবল কেন্দ্রিক। আবাহনী না মোহামেডান—এ নিয়ে কত মারামারি, হৈ হুল্লোড়, উচ্ছ্বাস। আশির দশক থেকে টুকটাক করে ক্রিকেট শুরু হলো, ফুটবলের জৌলুস কমে এলো। আমরা এখন ক্রিকেট নিয়ে আছি, দেশে এবং পৃথিবীময়ও। ক্রিকেটের কথা থাক। ফুটবলের কথা বলি।

বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম দর্শক হই ১৯৮২ সালে, যে বছর আমি এসএসসি পরীক্ষা দিই। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে আমরা ক্যাডেট কলেজে ফেরত গিয়েছি। জুলাইয়ের ১১ তারিখে কলেজ অডিটরিয়ামে আমাদের দেখানো হয় ফাইনাল খেলা। বিটিভি তখন শেষের দিকের এক দুটো ম্যাচ সরাসরি দেখাত। কলেজে তখন রঙিন টেলিভিশন এসেছে। আমরা প্রাণভরে দেখি ইতালি আর পশ্চিম জার্মানির খেলা। জার্মানির কার্ল হিঞ্জ রুমেনিগে আর ইতালির পাওলো রসির খেলা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড নামক একটা পত্রিকায় তাদের ফুলপেজ ছবি ছাপা হতো। সেগুলো রিডিং রুম থেকে চুরি করে এনে কেটে রাখতাম নিজের কাছে। পাওলো রসি গোল্ডেন বুট পেয়েছিলেন, তার টিম জিতেওছিল ফাইনালে।

সে বছরই পত্র-পত্রিকায় খবরে আমরা এক ‘ওয়ান্ডার বয়’-এর কথা শুনি। ওর নাম দিয়াগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়। খুব অল্প বয়স তার। সে নাকি বল নিয়ে মাঠে জাদু দেখায়। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে এসে সত্যি সত্যিই দেখা মেলে এই জাদুকরের সঙ্গে। আমি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়ার মোস্ট ক্লাসের ছাত্র। ওতো সুযোগ হয় না সামনে বসে দেখার। তারপরও কখনো বসে, কখনো দাঁড়িয়ে তিতুমীর হলের টিভিরুমে আমরা দেখি এই ম্যারাডোনার খেলা। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের ছয় ছয় জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে মাঝ মাঠ থেকে যে গোলটা দিলেন, দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া। শুধু তাই নয়, একই খেলায় রেফারির চোখকে ফাঁকি দিয়ে ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়ে গোলটা করল আমাদের সামনেই। সে বছরের বিশ্বকাপটি ছিল ম্যারাডোনার একারই। ম্যারাডোনা ছাড়া আর কোনো খেলোয়াড়ই নজরে আসে না কারো। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে কাপ নিয়ে ম্যারাডোনাই বাড়ি যায়।

মনে পড়ে এই খেলার সময় গ্যালারিতে বসা ম্যারাডোনার গার্লফ্রেন্ড, সঙ্গে দুটো শিশু কন্যা। (পরবর্তী সময়ে ঐ মহিলাকে তিনি বিয়ে করেন এবং এক কন্যাকে আর্জেন্টিনার অপর এক খেলোয়াড়ের সাথে বিয়েও দেন।)

ছিয়াশির বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ মোটামুটি ম্যারাডোনাময় হয় পড়ে। তার প্রভাব পড়ে গ্রাম বাংলাই বেশি। নব্বইয়ের বিশ্বকাপ যখন চলে আমি বুয়েটে। সেমিফাইনালের সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। আমি চলে যাই গ্রামের বাড়ি। ব্যাটারি চালিত একটা ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি কিনে নিয়ে যাই। রাতেরবেলা গ্রামের শ’খানেক কিশোর যুবককে নিয়ে উঠানে বসে খেলা দেখি।

এই নব্বইয়ে এসে তারকার উত্থান ঘটে। ম্যারাডোনাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে পোস্টার দেখি, তার ছবি কাট আউট করে সাজিয়ে রাখা হয় বাড়ির দেয়ালে। কোথাও ব্রাজিলের পতাকাও চোখে পড়ে। আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা ব্রাজিলের প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরস্পরবিরোধী দুই দল মিছিল পর্যন্তও করে। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল পতাকায় সয়লাব হয়ে যায়, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে একক দাঁড়িয়ে থাকেন ম্যারাডোনা। নব্বইয়ের ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল পশ্চিম জার্মানির। সেই ম্যাচের ফুটবল বিধাতা আর্জেন্টিনার পক্ষে ছিল না। জাদুকর ম্যারাডোনার পায়ে সেদিন জাদু খোলেনি। তার ওপর রেফারি ছিলেন আর্জেন্টিনার ওপর ক্ষিপ্ত। দু-দুজন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠান রেফারি। নয়জন খেলোয়াড় নিয়ে ক্লিনসম্যানের পশ্চিম জার্মান বাহিনীর এগারোজন আর একজন রেফারির বিরুদ্ধে ম্যারাডোনা বাহিনী তাল হারিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, ছিচকে কারণে খেলা শেষের ৫ মিনিট আগে জার্মানির পায়ে একটা পেনাল্টিও তুলে দেন রেফারি। ছিটকে পড়ে আর্জেন্টিনা।

এরপর ম্যারাডোনাও খেলা থেকে সরে আসেন। তিনি মাদক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন পরপর তার নামে নানা রকম কুৎসাব্যঞ্জক খবর বেরোতে থাকে। আর্জেন্টিনা পরবর্তী ২৪ বছর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের মুখও আর দেখে না। ম্যারাডোনা নেই কিন্তু আর্জেন্টিনা তো আছে! যে ম্যারাডোনা কোটি কোটি ভক্তকূল তৈরি করে গিয়েছেন—তার উত্তরসূরী হিসেবে আর্জেন্টিনায় এসেছেন লিওনেল মেসি। বার্সেলোনার ক্লাবে খেলা এই খেলোয়াড় যদি আর্জেন্টিনার না হতেন, তবে হিসেবটা হয়তো অন্যরকম হতো। একসময় ম্যারাডোনা কেন্দ্রিক ছিল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা আউট হবার পর আর্জেন্টিনাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবার মেসি এসেছেন, মেসিকে কেন্দ্র করে আবার আর্জেন্টিনাময় হচ্ছে আমাদের দর্শককূল।

কিন্তু ইউরোপিয়ান দেশগুলো যেখানে ‘টোটাল’ ফুটবল খেলে, সেখানে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দিয়ে একটা টিম কতটুকুই বা আসতে পারে। তা যে পারে না, সেটা আমরা গতবার দেখেছি ব্রাজিলের ক্ষেত্রে। যেই না এক ‘নেইমার’ মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন তখনই ব্রাজিল পরিণত হয়ে গেল ‘যে কোনো এক’ দলে। জার্মানির সাথে সাত গোলের পরাজয় হজম করার পরও তারা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছিল হল্যান্ডকে মোকাবেলা করতে। তারা তাদের শক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা প্রমাণ করে ছেড়েছে যে তারা মোটামুটি মানেরই একটি দল। যে দল ‘নেইমার’ বা এ জাতীয় কিছু তারকা খেলোয়াড় নির্ভর।

এই নির্ভরতা আছে আর্জেন্টিনার মধ্যেও। কিন্তু যখন তাদের ম্যারাডোনা ছিল, তখন ম্যারাডোনা একাই সামলে নিয়েছে। একা সামলে নেওয়ার মতো খেলোয়াড় ‘মেসি’ বা ‘নেইমার’ কেউই নন। সুতরাং দলবদ্ধ আক্রমণের কাছে একক নৈপুণ্য ধূলিসাৎ হবে, এটাই বাস্তবিক।

তাহলে আজ রাতে কী ঘটতে যাচ্ছে? ম্যারাডোনার উত্তরসূরী লিওনেল মেসি কি তবে ২৪ বছর আগের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে? সেটা যদি নিতেই পারে কেউ তবে মেসিকেই নিতে হবে। দলগতভাবে জার্মানির যে অবস্থান, আর্জেন্টিনা তার কছে দাঁড়াতেই পারবে না।

একক নৈপুণ্যকারীদের জয় জয়কার ইতিহাস শেষ হয়েছে ম্যারাডোনার পর। এখন এসেছে টোটাল ফুটবল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাওয়ার। ছন্দের সঙ্গে দেহবল যুক্ত করে  যারা খেলছে, তারাই জিতছে।

বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমাদের মাতামাতির দিন শেষ হতে আর কয়েক ঘণ্টা বাকি মাত্র। আজ শেষ রাতেই জানা যাবে ফল। তারপর কাল কিছু হিসাব নিকাশ, দোষারোপ—এসবের আলাপ হবে। তারপর আবার ব্যস্ত হবে চার বছর পর।

আমরা উৎসব প্রিয় একটা জাতি। যে কোনো উছিলায় আমোদিত হতেই পছন্দ করি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানি-স্পেন-নেদারল্যান্ডস-ইংল্যান্ড এসব দেশ কোনোটাই আমাদের না। তাদের কারো জয় পরাজয়ে আমাদের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু তারপরও তাদের উল্লাসে আমাদের উল্লাস। তাদের জয়কে নিজের জয় মনে করে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা। একে একে সবগুলো বাতি নিভে আসছে। এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ফিরে গিয়েছে নিজের দেশে। বিশ্ব ফুটবল মাতানো দক্ষিণ আমেরিকা আর ইউরোপের দুই দেশ রয়ে গেছে। কাপ হয়তো দক্ষিণ আমেরিকাতেই রয়ে যাবে, কিংবা ফেরত আসবে ইউরোপে। কিন্তু তাতে আমার কী!

কবে যে আমাদের একটা দলও ফুটবলের বিশ্বকাপ খেলবে, আর আমরা প্রথম দিন থেকেই সারা দেশময় নিজের পতাকা উচিয়ে সাজিয়ে রাখব, সেই প্রতীক্ষায় থাকি। আজ না হয় আর্জেন্টিনা-জার্মানিতেই থাক।

ঘটনা তিন
১৫ জুলাই ২০১৮ । নতুন তারকার সন্ধানে
বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানিময় হয়ে ওঠে। এক ফেভারিট ইতালি খেলার সুযোগই পেল না। প্রথম রাউন্ডে ছিটকে পড়তে গিয়েও কোনোমতে সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা-জার্মানি। কোয়ার্টার ফাইনালে এসে বিদায় হয় ব্রাজিল। শুধু ব্রাজিলই নয় লাতিন আমেরিকার আর কোনো দলই থাকে না সেমিতে। খেলা চলে আসে ইউরোপের মাঠে। মেসি, রোনালদো বা নেইমার কেউই দলকে নিয়ে যেতে পারেন না। টোটাল ফুটবলের আমলে ইউরোপীয় বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কিংবা নতুন ঝড় তোলা ক্রোয়েশিয়া দখল করে বিশ্বকাপের মাঠ। পুরনো তারকাদের কথা ভুলে গিয়ে ব্যক্তিজীবনের সংগ্রামকে পুঁজি করে বেড়ে ওঠা আফ্রিকান-বেলজিও খেলোয়াড় লুকাকু এসে তারকা বনে যান। কিন্তু শেষ দুই ম্যাচে এসে আগের ঝলক দেখাতে ব্যর্থ হন লুকাকু। আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসেন বেলজিয় হাজার্ড আর ৪৬ বছর বয়েসী ক্রোয়েশিয় প্রেসিডেন্ট সুদর্শনা কলিন্দ কিতারোভিচ। ফাজিল লোকেরা এক আমেরিকান মডেল কোকো অস্টিনের খোলামেলা ছবি দেখিয়ে মজা লুটছে যে, এটাই ক্রোয়েশিয়া মহিলা প্রেসিডেন্টের ছবি। প্রিয় দল, প্রিয় খেলোয়াড়দের হারিয়ে মাঠের চেয়ে আজ ফাইনালে দর্শকের চোখ খুঁজবে ক্রোয়েশিয়ার গ্যালারি। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে রাশিয়া এসে রীতিমত ঝড় তুলে চলে গেছে। সেমিতে তাঁকে দেখেনি কেউ।
আজ নতুন চমক নিয়ে ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে মুখোমুখি হবে ফ্রান্সের। আমার বিশ্বাস, ঔৎসুক দর্শকেরা গ্যালারির দর্শক  নয়, নতুন এক বিশ্বকাপ জয়ীকেও দেখতে পারেন।

পুনশ্চ
খুব ছোটবেলা থেকেই আমি ফুটবলপাগল । ২১-২২ বছর পর্যন্ত খেলেছি। খেলতাম রাইট আউটে। খেলতে খেলতেই শিরদাঁড়া বিকল করে খেলা ছাড়লেও খেলা দেখা ছাড়ি না। ১৯৮২ থেকে সব বিশ্বকাপের প্রায় সব ম্যাচ আমার দেখা। আমার কোনো দল থাকে না, দেশ থাকে না যাকে সাপোর্ট করি। মাঝে মাঝেই কোনো নিরীহ দেশের সাপোর্ট করে খেলা দেখতে বসে পছন্দের দল বদল করা আমার অভ্যাস। যেমন ২০১৮’র বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের খেলা দেখে বলেছিলাম (ফেসবুকে), ফুটবল আর দক্ষিণ আমেরিকানদের নেই, এটা ইউরোপিয়ানদের কাছে চলে এসেছে। শেষ হিসাবে তা-ই মিলে গেল। লাতিনের মধ্যে এখন সবচেয়ে ভালো খেলেছে উরুগুয়ে, আর ইউরোপীয়দের মধ্যে বেলজিয়াম। কিন্তু শেষ ম্যাচে পুরো টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সুন্দর খেলা দেখিয়ে বিদায় নিলো জাপান। এদের খেলাটা চোখে লেগে আছে। মনে হয়েছিল কুড়ি বছর আগেই ব্রাজিল যে খেলা শিখিয়েছিল তার ডিজিটাইজড ভার্সন হচ্ছে জাপান।

খেলা দেখতে দেখতে আরো মনে হলো
১. বাপদাদা কী করেছে এটা কিছুই না, তুমি কী করো সেটাই বিষয় (যেমন ক্রোয়াশিয়া)।
২. তুমি কত জানো বা ভালো কাজ করো (ভালো খেলো) এটা কোনো বিষয় না, কত টাকা ব্যাংকে আছে (মানে গোল করেছ) এটাই হিসাবে আসবে, আর কিছু না।
৩. সুযোগ বার বার আসে না। যখন আসে কাজে লাগাতে হয়। গোল পোস্টের সামনে থেকে টোকা দিয়ে গোল দিতে না পারলে দূর থেকে পরে আর জালে ফেলা যায় না ।
৪. কপালে নাই ঘি, ঠকঠকাইলে হইবে কী? বার বার বারের কোনায় বল লেগে ফেরত আসবে, গোল হবে না। আর কপালে থাকলে বাইরে দিয়ে মারা বল অপনেন্টের গায়ে লেগে আত্মঘাতী পর্যন্ত করায়, এই আর কি!
৫. ফলাফল নৈপুণ্য ভুলিয়ে দেয়। তুমি জেনুইন ভালো না খারাপ ছাত্র তা ভুলিয়ে দেবে ফল প্রকাশের পর।
৬. সব ভালো ছাত্র সবসময় ভালো রেজাল্টে পাশ করে না, অনেক খারাপ ছাত্রও অনায়াসে জিপিএ ৫ পেয়ে যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর