প্রাণপ্রিয় পোষ্য

, শিল্প-সাহিত্য

তানিয়া চক্রবর্তী | 2023-08-29 08:38:24

আমরা সকলে জীব, আমাদের জীবজ আচরণগুলোও এক—তাহলে আমরা সভ্যতার মধ্যে আলাদা কী করে? আলাদা, আমাদের অনুভূতির ব্যাপকতায় আর শিল্প ও বোধ-বুদ্ধির প্রয়োগে। কিন্তু এই সভ্যতা যখন তথাকথিত অসভ্যের কাছে হেরে যায়, আমরাও হেরে যাই। ভোলগা, গঙ্গা, সিন্ধু ফেলে আজ আমরা বহুতলবাসী উন্নত জীব, সেই আত্মস্থ পশুপালন আমাদের আরো আরো উন্নত হয়েছে, কোথাও হিংস্রও হয়েছি আমরা, সেটাই আমাদের আড়ালের অবনমন। আমেরিকায় সাতকোটিরও বেশি মানুষ যেখানে পোষ্য নিয়ে সুখী বোধ করে সেখানে চীনে ত্রিশ হাজারের বেশি কুকুরকে হত্যা করা হয় মাংস ও চামড়ার জন্য। কুকুর—যে প্রাণীটির মানুষের সঙ্গে বন্ধুতা ও আন্তরিকতার সম্পর্ক সবচেয়ে দৃঢ়, তাকেও মানুষ খেতে দ্বিধা করেনি। ২০১৮ কলকাতা ফিল্ম ফেস্টে ইরানের একটি ছবি “কুপাল” দেখে স্তম্ভিত হই। কুকুরপ্রিয় এক মালিক কুকুরের জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তান সব হারিয়েছেন ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাসে। একদিন নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে সে কুকুরটিকেই তাকে নিজ হাতে মারতে হয়েছিল। রয়াল স্ট্যাগের “খামোশিয়া” বলে একটি ছবিতেও অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায় কুকুরের। অভিনেত্রীর সবচেয়ে প্রিয় জন তার কুকুর কিন্তু বাইরের লোক দেখে এই কুকুর তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে রক্তাক্ত করছে। গুলি করা হয় কুকুরটিকে। পরে জানা যায় অভিনেত্রী বিষ খেয়েছেন আর তাকে বাঁচাতেই কুকুরটি সেই প্রয়াস করেছিল।

বলা হয় যারা সাইনোফোবিক মানে কুকুরে ভয় পান তারাই যদি শিশুকাল থেকে কুকুর পোষেন, তবে সবচেয়ে কাছের মানুষ হতে পারেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমার পিসির মৃত্যুর পর তার দুই পোষ্যকে ইচ্ছামৃত্যুর মতো জীবনকে শেষ করে দিতে। আমার পিসতুতো দাদার প্রাইজের চেয়ে বেশি রিমি, টিঙ্কির প্রাইজে ভর্তি থাকত ওদের আলমারি, ওরা মাঝে মাঝেই স্পোর্টসে জিতে নিয়ে আসত। পিসির অকাল মৃত্যুর পর ওদের দেখেছি সব বিষয়ে নিস্পৃহ হয়ে যেতে। যাদের চিৎকারে মানুষ টিকতে পারত না, তারা চিরকালের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল, খাওয়া বন্ধ করে দিলো, তারপর একমাসের ব্যবধানে দুটো কুকুরই মারা গেল। অথচ মানুষও তার নিকটাত্মীয়ের শোকে বেশিদিন কষ্ট না পেয়ে নিজের কাজে ফিরে আসে। আমার এক বন্ধুকে দেখেছি সে তার জীবনের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে বারবার ডগহাউসের কথা বলে। সে সত্যি বোঝে কুকুরের মতো কৃতজ্ঞ জীব আর নেই। সম্প্রতি রাস্তার একটি বিপর্যস্ত কুকুরকে তুলে এনে নিজের শতকাজের মধ্যেও কুকুরটিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের বাড়িতে স্থান দিয়ে দুই মাসেই স্বাস্থ্যবান ও উজ্জীবিত করে তুলেছে। কুকুরটির নাম দিয়েছে চিকমাগালুর নাফাকুম। সে বেঁচে উঠে জীবন পেয়েছে আর আমার বন্ধুটি পেয়েছে সার্থক বন্ধুতার স্বাদ। জীবন আসলে জীবনের কাছেও ইতিবাচক সুখ চায়, জীবন চায় জীবন তার কাছে আহ্লাদিত থাক। মানুষ মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্তির পর পুনরায় প্রাপ্তির জন্য আশাবাদী হয়ে ওঠে ফলে স্থান, অনুভূতি বদলে যায়; বুদ্ধি ও ভোগের প্রাবল্য তাকে স্বার্থপর করে তোলে, যে কারণে মানুষ পূর্বোক্ত জায়গাকে ভুলতে বা ত্যাগ করতে পারে। সারমেয় পারে না, পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে, সে ভালোবাসার কৃতজ্ঞতা আজীবন ভুলতে পারে না। আর মানুষ তা বুঝেছে বলেই কুকুরকে ভালোবেসেছে, মানুষ বুঝেছে এখানে ভালোবাসা বেঈমানী করে না।

Emily Dickinson বলেছেন “Dogs are better than human beings because they know but do not tell.” কোথাও শুনেছিলাম “THERE IS NO PSYCHIATRIST IN THE WORLD LIKE A PUPPY LICKING YOUR FACE” এ কথাই বোধ করি সত্যি।

রাস্তার ছোট কুকুরের ছানাকে চারচাকাগুলো মাঝে মাঝে অসেচতনায় মেরে চলে যায়, মানুষ এতই নির্মম যে তারা থমকানো তো দূর, চোরের মতো পালায়; নিজের প্রাণ ছাড়া বাকি সব প্রাণ হেলাফেলার। সম্প্রতি শুনলাম রাস্তা তৈরির সময় একটি কুকুরকে সরানো না গেলে তার গায়ে গরম পিচ ঢেলে দেওয়া হয়। মানুষ তাদের বাড়তি খাবার বাইরে ফেলে দেয় তবু কুকুরকে দেয় না। যারা দেয় তারা জানে মানবতার কাছে কৈফিয়ত দেওয়াও একটা সুখ। পৃথিবীর বিখ্যাত কুকুরদের মধ্যে লাইকার কথা আমরা জানলেও আরো অনেকের খবর রাখি না। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সেই বিশিষ্ট মনিবপ্রিয় কুকুর হাচিকোর মূর্তি আছে। জাপানিদের কাছে এক স্মরণীয় গল্প, এই নিয়ে বিখ্যাত সিনেমাও হয়েছে। মনিবের জন্য অপেক্ষারত কুকুর একদিন দেখল মনিব প্রতিদিনের মতো আর ফিরছে না কিন্তু সে অপেক্ষা ছাড়ে না বছরের পর বছর। তারপর আছে সেলিব্রিটি কুকুর “রিনটিন্টিন” যার অভিনয়ে অভিভূত অস্কারমুখী হলিউড, কুকুর কিনা তাই সে পুরস্কার পেল না কিন্তু ছেয়ে রইল নিজের ক্ষমতার দক্ষতায়। বব্বি নামের আরেক কুকুর যে দীর্ঘ ছয়-সাত মাস ধরে বহু পথ পেরিয়ে না জানি কী অমোঘ টানে হারিয়ে যাওয়ার পরও মনিবের কাছে এসে পৌঁছেছিল কেবল নিজের ভালোবাসার তৎপরতায়।

শুধু কুকুর কেন, বিড়াল কি কিছু কম ভালোবাসার? ছোট ছোট নধর ছানাদের দেখলে খুব হিংসুটে মানুষের মনেও দু’মিনিটের ভালোবাসা উঁকি দিতে পারে। কিছু দেশ তো বিড়াল পোষাকে ভীষণ ইতিবাচক মনে করে। স্টুয়ার্ট লিটল সিনেমার বিড়ালটির ভূমিকা কি কিছু কম ছিল বলে মনে হয়! আর বিড়ালের বাড়ি চেনার ক্ষমতা থাকে অবিস্মরণীয়। কুকুর আসলে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, একাকীত্ব সবকিছুর ফাঁক মেটায়। দেখা গেছে যে সমস্ত কুকুর তীব্র বিপজ্জনক তারাই সঠিক প্রশিক্ষণে প্রভুর জন্য প্রাণ দিতে পারে, যেমন বক্সার, হাস্কিস, গ্রেট ডেন, ডোবারম্যান পিনসার্চ, আলাস্কান মালামিউস, পিটবুল, জার্মান শেফার্ড ইত্যাদি।

আসলে মনে করা হয় কুকুরের পূর্বতন সূত্র যুক্ত জাতি নেকড়ে। নেকড়ের সঙ্গে জনন ঘটিয়েও মারাত্মক শক্তিশালী শিকারী কুকুরের আগমন হতে পারে। একাধারে শক্তিশালী, বুদ্ধিমান, প্রভুভক্ত প্রাণীকে কাছে টেনে মানুষ নিজের নিরাপত্তা বানিয়েছে, সুখী হয়েছে তবু কিছু কিছু জায়গায় এদের প্রতি অত্যাচার দেখে নিজেদেরই হীন মনে হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন মানবশিশুর মতো কুকুর নিজের বন্ধুদের বুঝতে পারে, তারা নাকি স্বপ্নও দেখে। বলা হয় যখন কুকুরটি ডানদিকে ঘাড় হেলিয়ে বসে থাকে সে নাকি মনে মনে খুব খুশি সেটা বোঝাতে চায়। মানুষের থেকে যে প্রাণীর ঘ্রাণশক্তি ১০ হাজার গুণ বেশী ভাবুন সে কত তুখোর হতে পারে। আজ থেকে প্রায় ৩০ হাজার বছর পূর্বে প্রথম কুকুর মানুষের কাছে আসে, সেই অবলার এমন ক্ষমতা যে সে মানুষের মনের নাগাল পেয়ে গেল। শোনা যায় হিটলারের সেনাবাহিনী কুকুরের ক্ষমতা দেখে তাকে কথা বা সাংকেতিক শব্দ শেখানোর চেষ্টা করেছিল যদিও তারা ব্যর্থ হয় কিন্তু এ তো সত্য এত শর্তহীন এক জীব পশুজগতের সভ্যতার কাছে আমাদের মনুষ্যবোধকে ছোট করে দিতে সক্ষম।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর