আসুন, আমরা আবদুল খালেকের একটা ছবি আঁকি

, শিল্প-সাহিত্য

মনি হায়দার | 2023-08-31 21:37:00

‘তুমি ফোন করেছিলে?’
‘কোথায়?’
কোথায় শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রী শবনব আরার কোমল চেহারা পাল্টে যায়। স্বাভাবিক চোখ অস্বাভাবিক বড় করে আমার দিকে তাকায়, ‘তুমি আসলে কী? একটা ফোন করবে, সেটাও করতে পারো না! সেইকবে, প্রায় আট নয়দিন আগে মৌচাকে বালিশের অর্ডার দিয়ে এসেছি। লোকটা, খালেক সাহেব বলেছিল চারদিন পরে ফোনে খোঁজ নিতে’...
শবনব আরা নিজের ভূগোল নির্মাণ করে যাচ্ছে। আমি অফিস শেষ করে, বাইরে আরো দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করে রাত সাড়ে ন’টায় বাসায় এলাম। বাসায় আসার আগে মালিবাগ নেমে ফোন দিয়েছি। দু’-দুবার রিং হওয়ার পরও শবনম ফোন রিসিভ করেনি। এই ফোন রিসিভ না করা শবনমের একটা খেয়াল। মোবাইল সেটটা কোথায় থাকে বা রাখে জানে না ও। ফোন বেজে যায়... সেটটা বিছানার ওপর শুয়ে, রিং শোনার কেউ নেই। মেয়ে কলেজে। ছেলে ইউনিভারসিটিতে। শবনব কী করছে? শবনব রান্না ঘরে রান্না করছে। নয়তো বাথরুমে শরীরে সাবান মাখছে। কিন্তু রাত সাড়ে ন’টায় নিশ্চয়ই বাথরুমে শরীরে সাবান মাখার সময় নয়। আমার বিরক্ত ভাবনার মাঝে ফোন বাজে, দেয়ালে তাকিয়ে দেখি, শবনমের ফোন।
আমি কেটে দিয়ে ফোন করি। এবার দ্রুতই রিসিভ করে, ‘হ্যালো?
আমি বাজারে। কিছু আনতে হবে?’
‘হ্যাঁ, ডিম ডাল আর তরবারি নিয়ে এসো।’
‘ডিম?’
‘হ্যাঁ ডিম।’
‘গতকাল না দুই ডজন ডিম আনলাম।’
‘আমি সব খেয়েছি।’ বলে শবনম ফোনটা কেটে দেয়।

আমি বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখি। কত মানুষ, বিচিত্র মানুষ। বাজারে এসেছে বাজার করতে। দোকানীরা কত বিচিত্র পণ্য সামগ্রী সাজিয়ে বসেছে। এইসবের মধ্যে নিজেকে একটা চিড়িয়া মনে হলো। গতকাল দুই ডজন ডিম নেবার পর আজ কেন ডিম নেবো? বাসায় মেহমানও আসেনি। আমি ডাল আর তরকারি কিনলাম। বাসায় ঢোকার পর শবনমের প্রশ্নে ভেতরে ভেতরে বেশ ঘাবড়ে যাই। কারণ, বালিশ।

বালিশ যে মানুষের কত প্রযোজনীয় বস্তু, গত কয়েক দিনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমাদের বাসায় বালিশগুলো অনেক পুরনো। আর পাতলা। রাতে ঘুমাবার সময়ে মাথার নিচে পাতলা বালিশ দিয়ে মাথা বিছানার সঙ্গে ঠেকে। আর এইসব ব্যাপারে আমি বড় অসহয়। যা করার শবনবই করে। যত সহজে বললাম, শবনব করে, এই করাটা অতো সহজ নয়। গত এক বছরে ঘুমাতে যাবার সময়ে কিংবা সকালে ঘুম থেকে উঠবার সময়ে শবনমের মুখের বাণী শুনতে হয়, ‘এই বালিশে মানুষ ঘুমাতে পারে! এ তো বালিশ না, মনে হয় বিছানার ওপর ঘুমাচ্ছি।’ শবনম আপন মনে যদিও বলে, কিন্তু আমি তো জানি আমাকে বলছে। আপন মনে বকে যাওয়ার ঘটনা সংসারের সবাই জানে। আমাদের মেয়ে সূচনাও জানে। জানে পুত্র দৈব্য। কারণ, দোকানে গিয়ে কাপড় তুলা দেখে গোটা চারেক বালিশ বানাতে অর্ডার দেওয়ার জন্য বলেছে।
‘যাও, গিয়ে অর্ডার দাও।’
‘আমি একা যাব নাকি?’
‘কয়েকটা বালিশ বানাবে সেখানেও আমাকে যেতে হবে তোমার সঙ্গে?’
ঠোট উল্টায় শবনব, ‘সজল আমি তোমাকে ছাড়া যেতে পারব না। আমি কোথাও একা যেতে পারি না। জানো না?’
শবনমের এই রোগ, কোথাও একা যেতে পারে না। যেখানেই যাবে সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি সব সময়ে যেতে পারি না। যেতেও ইচ্ছে করে না। শবনব দাম করার সময়ে এমন সব কথা বলে, শুনে ব্রহ্মতালুতে আগুন লাগে। দোকানে প্রবেশ করে আমি পেছনে অপেক্ষা করছি ক্যবলাকান্ত হয়ে। শবনব দরদাম করছে কোনো শ্যাম্পুর। দোকানী বলল, ‘দাম সাতশো টাকা।’
শবনম খুব স্বাভাবিকভাবে বলে, ‘শাতশো টাকা? গত মাসে আমি ফরচুন থেকে নিয়েছি তিনশো টাকায়।’
বেচারা দোকানদার আর কী বলবে! একটা বিষয়ে জানানো দরকার, শবনমের পছন্দ দারুণ। কাপড়ের রঙ যথাযথ পছন্দ করার রুচি ওর অসাধারণ। শবনম দোকানে দোকানে ঘুরবে আর পিছনে পিছনে আমি হাঁটব ব্যাপারটা আমার সঙ্গে মানসিকভাবে যায় না..। তাছাড়া আমি বৌ ন্যাওটা হিসেবে পরিচিতি অর্জন করতেও চাই না। কিন্তু শবনমকে এত সব বলাও যায় না। বললাম একটা ও ভাবল আরেকটা.. নতুন আরেকটা ফ্যসাদ তৈরি হয়ে যাবে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোফায় বসি। নিজেকে অনেকটা অসহায় লাগছে। বালিশ তো সংসারের খুব গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য। আপনি ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়েছেন কিন্তু বিছানায় বালিশ নেই, মাথার নিচে বালিশ দিতে পারলেন না, সুখ পাবেন? আমি নিশ্চিত পাবেন না। এই যে জন্ম থেকে মাথার নিচে বালিশের ব্যবহার, এই ব্যবহার থেকে কোনোভাবে মুক্তি পাবেন? সম্ভব না। জীবন, সংসার, স্ত্রী বিছানা যেমন দরকার, তেমন দরকার বালিশ। আমার করুণ মুখ দেখে শবনমের দয়া হলো, ‘খেতে দেবো?’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ি, ‘দাও। সারাদিন যা ধকল গেল, আমি নিজেকে শুনিয়ে বলি।’
কিন্তু ধরে ফেলে শবনম, ‘কী করো সারাদিন? ওই তো একটা অফিস আছে, সকালে উঠে চলে যাও। সারা দিনে বাসার খবর রাখো? আড্ডা মারো আর মাঝে মাঝে ফাইলে চোখ রাখো, এই তো তোমার অফিস! থাকতে বাসায়, দেখতে চাকরি কাকে বলে।’ উঠে চলে যায় রান্না ঘরে।
আমি প্যান্ট শার্ট পরিবর্তন করে বাথরুমে ঢুকি। চোখে মুখে পানি দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখি। অবাক, আয়নায় প্রতিফলিত এই চেহারার লোকটা আমি? আমি এতটা ক্যবলাকান্ত? যে আমি শৈশবে যৌবনে বাবা দাদাকে স্ত্রীর কাছে বকা খাচ্ছে দেখে মনে মনে বলেছিলাম, দেখে নিও। আগে বড় হই। বিয়ে করার পর দেখাব বউ কেমন করে বকে স্বামীকে!
‘এই তোমার হলো?’ ডাইনিং টেবিলের হুংকার শুনে দ্রুত বের হয়ে আসি। টেবিলে আমার পছন্দের তরিতরকারি দেখে খুব ভালো লাগে। শবনম আমাকে বকে, শবনম আমাকে শাসন করে, শবনম আমাকে অপদস্ত করার চেষ্টা করে, শবনম আমার গ্রাম্য মা বাবা নিয়ে বিশ্রী মন্তব্য করে। আমার হৃৎপিণ্ড ফালা ফালা হয়ে যায়, কিন্তু আমি জানি, শবনম ছাড়া আমার একটা দিন, একটা রাতও চলবে না। শবনম যে আমাকে ভালোবাসে..। এই ভালোবাসা আমি কোথায় গেলে পাব?
খাবারের থালায় ভাত তরকারি নিতে নিতে বলি, ‘কালকে ঠিকই অফিস থেকে আসার পথে মৌচাক নেমে বালিশ দেখে আসব।’
‘বালিশ দেখে আসবে মানে কী? বালিশ কি আমার জন্য রেখে আসবে? আমি গিয়ে নিয়ে আসব?’
প্রিয় ইলিশ মাছের সঙ্গে সাদা মখমলে ভাত মুখের ভেতরে আটকে যায়। সূচনা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। আমি পানি খাই। এবং গলা স্বাভাবিক হলে বলি, ‘আমি কি সেটা বলেছি?’
আমার চোখের ওপর চোখ রাখে শবনম, ‘তুমি কী বলেছো? তুমি বলেছো কালকে ঠিকই অফিস থেকে আসার পথে মৌচাক নেমে বালিশ দেখে আসব।’ তাকায় সূচনার দিকে, ‘তোর পাপা এসবই বলেছিল কি না?’
মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় সূচনা। সূচনাকে তো সাক্ষী মানার দরকার ছিল না। আমি তো ওই কথাগুলোই বলেছিলাম। তো এখন কী হবে। আমি কথা ঘুরাই, ‘দেখো শবনম আমি বলতে চেয়েছি অফিস থেকে আসার পথে আমি মৌচাকে যাব। আর বালিশঅলার কাছে গিয়ে জানব তোমার অর্ডার দেওয়া বালিশ তৈরি হয়েছে কি না? যদি হয় টাকা দিয়ে নিয়ে আসব। ঠিক আছে?’
শবনমের মুখে হাসি, ‘তুমি কত টাকা দেবে?’
‘যত টাকায় তুমি চারটে বালিশ তৈরি করতে দিয়েছো, সেই টাকাই দেবো।’
‘সেই টাকাটা আমাকে দাও।’
‘মানে?’
সূচনা হাসে, ‘পাপা মা টাকা দিয়ে এসেছে।’
‘ঠিক আছে, সেই টাকাটা তোমাকেই দেবো। কিন্তু সেই বালিশওয়ালাকে কোন দোকানে পাব? বালিশওয়ালা দোকানের নাম কী?’
শবনম খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। আমি ভাত মাখতে থাকি। মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আমার অসহায়ত্ব দেখে মিটিমিটি হাসে। আমি মনে মনে বলি, মারে তুই আজকে আমার অবস্থা দেখে হাসছিস, একদিন তুই আমার মতো একজন পুরুষকে ঠিক তোর মায়ের মতো নাকাল করবি।
ভাবনার চেয়েও দ্রুত গতিতে চলে আসে শবনম। হাতে একটা রশিদ। আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে, ‘নাও।’
আমি রশিদখানা নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরি, মেসার্স বসুন্ধরা বেডিং স্টোর। প্রোপাইটার : আবদুল খালেক। ৩৩ আনারকলি মার্কেট, নিচতলা। খাওয়া শেষ। রশিদ নিয়ে চলে যাই বাথরুমে। হাত মুখ ধুয়ে বেডরুমে এসে খুব যত্ন করে রশিদটা জামার পেকেটে রাখি। এবং বুঝতে পারি, অফিস থেকে ফেরার পথে অবশ্যই মৌচাকে নেমে মের্সাস বসুন্ধরা বেডিং স্টোরে গিয়ে আবদুল খালেকের সঙ্গে দেখা করে বালিশ নিয়ে বাসায় ফেরার একটা কাজ করতে হবে। যতভাবে এই কাজ থেকে রেহাই চেয়েছিলাম, তত দ্রুতবেগে কাজটা আমার ঘাড়েই চাপল।

পরের দিন, মঙ্গলবার অফিস থেকে একটু আগেই বের হই। নবারপুরে এক বন্ধুর কাছে যাব। বন্ধুর অফিসে কাজ সেরে আসব মৌচাকে, মেসার্স বসুন্ধরা বেডিং স্টোরে। বন্ধুর অফিসের কাজ শেষ করে একটা রিকশা নিয়ে মৌচাক মার্কেটের সামনে এসে দেখি, সব দোকানপাট বন্ধ। ঘটনা কী? আজকে তো সরকারি কোনো শোক দিবস না। দোকানপাট বন্ধ কেন?
দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, মঙ্গলবার মৌচাক মার্কেট বন্ধ থাকে। আমি হাসিমুখে বাসায় ফিরে এলাম কিন্তু সুখ সইলো না কপালে। চোখ কপালে তুলে শবনমের প্রশ্ন, ‘খালি হাতে কেন? বালিশ কই?’
‘আজ মঙ্গলবার।’
‘তো?’
সূচনা জবাব দেয়, ‘আজ মঙ্গলবার হলে মৌচাক মার্কেট বন্ধ।’
‘এই লোকটা যেখানেই যায়, সেখানেই একটা ভজঘট পাকায়। আজ কেন মঙ্গলবার হবে? কোনো মানুষ এই বালিশে ঘুমাতে পারে? মনে হয় তেনার ওপর মাথা রেখেছি। বিছানা থেকে এক ইঞ্চিও উঁচু নয়। ওই বালিশে ঘুমাতে গেলে আমার ঘাড় ব্যথা করে।’
‘এক কাপ চা দেবে?’
‘বসো, আনছি’, আমার দিকে ক্রোধের তীব্র বান হেনে রান্নাঘরে চলে যায় শবনম আরা। এই শবনম আরাকে ভালো না বেসে পারা যায়? শবনমের এক হাতে বাঁকা বাশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য। কোমলে কঠোরে শবনম আরার সঙ্গে গত বিশ বছরের বসবাস। অনেক শিখেছি ওর কাছে। শেখার কোনো শেষ নেই।

হয়তো চায়ের পানি চুলোয়ই ছিল, দ্রুত এক কাপ চা, এক বাটি মুড়ি এনে সামনে রাখে। আমি চায়ের সঙ্গে মুড়ি খাই, খেতে পছন্দ করি, বেচারা আমার জন্য মৃুড়ি এনে রাখে। যদিও বলে, চায়ের সঙ্গে মুড়ি খায় গ্রামের লোকেরা। আমি বুঝতে পারি না, এই বাংলাদেশে বাস করে কেন গ্রামীণ মানুষদের প্রতি এক ধরনের অবহেলার মার্বেল ছুড়ে মারে, শহরে বেড়ে ওঠা এইসব কামিনীরা! ওরা জানে না, গ্রামের কৃষকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষ না করলে, সুসজ্জিত গৃহের ডাইনিং টেবিলে বসে ভালো মন্দ খেয়ে মোটা তাজা। না, আর লেখার দরকার নেই। শবনম আরা জেনে গেলে আমার সামনে আবার বিপদ নেমে আসতে পারে।

রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ে পাতলা বালিশের ওপর মাথা রেখে সত্যিই খুব বিরক্ত লাগছে। বালিশ নিয়ে কোনো কবি কি কবিতা লিখেছে? মনে পড়ে না। জীবনের খুব প্রযোজনীয় অনুষঙ্গ বালিশ নিয়ে কোনো কবি কবিতা লেখেনি? কবিরা তো খুব সংবেদনশীল, অথচ বালিশের মতো সংবেদনশীল প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে কোনো কবিতা নেই? আমাদের কবিদের সংবেদনশীলতা কি তলানিতে নেমে এসেছে? আমি পাতলা বালিশে মাথা রেখে, শবনম আরার শরীরের মিষ্টি গন্ধ নিতে নিতে সিদ্ধান্ত নিই আমার তিন কবি বন্ধু টোকন ঠাকুর, শিহাব শাহরিয়ার আর মতিন রায়হানকে বলব বালিশ নিয়ে কবিতা লিখতে।
আমার শরীরের ওপর শবনম আরা ডান পা তুলে দিয়ে বুক মিশিয়ে দেয় পিঠের সঙ্গে, ঠিক এই মর্মান্তিক মুহূর্তে আমার মনে আসে, গল্পকাররাও কি বালিশকে চরিত্র করে কোনো গল্প লিখেছেন? মনে পড়ে না বালিশ সংক্রান্ত কোনো গল্পপাঠ করেছি। আহারে আমাদের গল্পকারদের কী হলো? জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনীয় বালিশ নিয়ে কোনো গল্প লেখেন নাই? আমি আবারও সিদ্ধান্ত নিই গল্পকার বফিকুর রশীদ, নিয়োগী মোজাম্মেল হক আর পাপড়ি রহমানকে বলব, বালিশ নিয়ে গল্প লিখতে। বালিশকে চরিত্র করে কোনো গল্প লেখা হয়নি, এই ভয়ঙ্কর তথ্য যদি বালিশেরা জানে, প্রতিবাদে বালিশেরা যদি রাস্তায় নেমে আসে, মিছিল শুরু করে, আমরা আর মাথার নিচে থাকব না, যদি বালিশের সব তুলোরা বের হয়ে রাস্তা অবরোধ করে... আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। এই ঝিমঝিমের মধ্যে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হই, যেভাবেই হোক, আমি আগামীকাল মৌচাকের আনারকলি মার্কেটের নিচতলায় গিয়ে মেসার্স বসুন্ধরা বেডিং স্টোরের মালিক আবদুল খালেকের সঙ্গে দেখা করে বালিশের একটা দফারফা করেই ছাড়ব।

প্রতীজ্ঞানুসারে, পরের দিন অফিস থেকে বেরিয়ে বিকেলের দিকে মৌচাক মার্কেটের পিছনে আনারকলি মার্কেটের মের্সাস বসুন্ধরা বেডিং স্টোরে চলে যাই। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আবদুল খালেক আছেন?’
কোমরের লুঙ্গি গোছাতে গোছাতে এক হুজুর টাইপের লোক সামনে আসে, ‘কী কইলেন?’
‘আবদুল খালেক আছেন?’
‘না।’
‘কোথায় উনি?’
‘বাইরে গেছেন।’
‘আসবেন কখন?’
আমাদের কথার মধ্যে দোকানের পিছন থেকে একজন তরুণ এসে দাঁড়ায়, ‘দুলাভাই আজকে আসবে না।’
খালেকেক যখন দুলাভাই বলেছে, বুঝতে পারি, ভদ্রলোক সর্ম্পকে শ্যালক। এবং শ্যালককে দেখে হুজুর টাইপের লোকটা দোকানের পেছনে চলে যায়। বুঝতে পারি, আবদুল খালেকের অবর্তমানে শ্যালক সাহেবই মালিক হয়ে বসেন। আমি শ্যালক সাহেবের দিকে জিজ্ঞেস করি, ‘আবদুল খালেক কোথায়?’
‘দুলাভাই একটা বিয়া খাইতে গেছে। আজকে আইবে না।’
আমি আজকে অনেক সাধনায় মেসার্স বসুন্ধরা বেডিং স্টোরের সামনে এসে একেবারে শূন্য হাতে ফিরে যেতে চাই না। বললাম, ‘আমার কয়েকটা বালিশের অর্ডার দেওয়া আছে।’
‘রশিদ আনছেন?’
‘এনেছি’, জামার বুক পকেটে হাত দিলাম, নেই রশিদ। আমি নিজের কাছেই নিজে ধরা পড়ে গেছি, গানের অনুসরণ করে, প্যান্টের পকেটে খুঁজলাম, নাই। নাই তো নাই। আমার দিকে তাকিয়ে আছে আবদুল খালেকের শ্যালক। চোখে মুখে ভাবলেশহীন একটা দৃশ্য ফুটিয়ে, ভাবখানা এই রকম যে আমি আসব দোকানের সামনে, আর আমার পকেটসমূহে হাতড়ে খুঁজব কিন্তু পাব না, পুরো ঘটনাটা ঘটবে, লোকটা জানত।
মুখে এক ধরনের হাসি এনে বলি, ‘রশিদটা পাচ্ছি না।’
‘রশিদ না পাইলে আপনার বালিশ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’
‘আগামীকাল আসি?’
ঘাড় ঝাঁকায় আবদুল খালেকের শ্যালক, ‘আহেন।’

আমি বিধস্ত হয়ে চলে আসি। যথারীতি বাসায় শবনম আরার কঠিন চোখ এবং মুখের উৎসারিত বাণীর সম্মুখে পড়তে হয়। আমি নতজানু হয়ে সবটাই হজম করি। এবং আবারও প্রতীজ্ঞায় নিজেকে আবদ্ধ করি, আগামীকাল প্রয়োজনে ছুটি নিয়ে যাব আবদুল খালেকের মের্সাস বসুন্ধরা বেডিং স্টোরের সামনে। যেভাবেই হোক, আগামীকাল আমাকে বালিশের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতেই হবে। এই প্রতীজ্ঞা নিয়ে যথারীতি শবনম আরার পাশে বিব্রত আমি পাতলা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে রইলাম। কিন্তু বিধি কেবল বাম না, মহাবাম। অফিসে যাওয়ার পর সুপার বস ডেকে আমাকেসহ অফিসের আরো তিনজনকে পাঠালেন, ঢাকার বাইরে, মুন্সিগঞ্জে এক কাজে। কাজ শেষে ঢাকায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা, পরের রাত এবং পরের রাত এইভাবে পার হওয়ার পর, এলো শুক্রবার, ছুটির দিন। দুপুরে খাবারের টেবিলে আমার স্ত্রী শবনম আরা বললে, ‘আজ বিকেলে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে মৌচাক মার্কেটে যাব বালিশগুলো আনতে।’
আমার বুক হিম হয়ে আসে, এক বন্ধুর বাসায় যাবার প্রতীজ্ঞা আছে। ওর বাসায় আরো দুজন ইয়ার আসবে। একটু পানাহার হবে... কিন্ত সেই ঐতিহাসিক ঘটনা কি আমার প্রিয়তম স্ত্রী শবনম আরাকে বলা যায়? বললে, আমার মস্তকে মস্তক থাকবে? বিশাল শোক বুকে নিয়ে দুপুরের ভাতঘুম দিলাম। ঘুম থেকে ওঠার পর শবনম আরা প্রসাধনে বসে যায় বিশাল আয়নার সামনে। আমাকে বলে প্রস্তুত হতে। আমি কেবল গায়ের শার্টটা খুলে আলমারি থেকে একটা শার্ট হাতে নিয়েছি, শবনম আরা বলল, ‘একটা ফোন করো তো আবদুল খালেককে।’
পানাহার থেকে বঞ্চিত হবার কারণে আমি বালিশ, আবদুল খালেক আর শবনম আরার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। বললাম, ‘যাবার জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছি, আবার ফোন কেন?’
‘আরে করেই দেখো না। মুখে পাফ মাখতে মাখতে বলে শবনম, কষ্ট করে গেলাম কিন্তু পেলাম না তোমার সেদিনের মতো’...
চোখের সামনে আমার ব্যর্থতার খতিয়ান দেওয়ায় মেজাজ খিচড়ে গেলেও শান্তির স্বার্থে মেসার্স বসুন্ধরা বেডিং স্টোরের রশিদ বের করে, শবনম আরার পাশে বসে, মোবাইলে ফোন দিলাম। ও মন রমজানের রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ.. রিং টোনে গান বাজে আবদুল খালেকের ফোনে। আমার মুমূর্ষু বিকেলটা আরো ক্লেদাক্ত হয়ে যায়, এই গান রমজানের শেষে ঈদের জাতীয় সঙ্গীত আমাদের দেশের, আর সেই সুন্দর সুরের গানটাকে বারোমাস লোকটা মোবাইলের রিংটোন বানিয়ে রেখেছে? আবদুল খালেকের রুচির প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হলো। অসময়ে এই রিংটোন আমার মধ্যে এক ধরনের বিষাদগ্রস্ততা তৈরি করে। কানের পাশ থেকে মোবাইলটা একটু দূরে সরিয়ে রাখি, যাতে ওই গানের সুর অসময়ে মরমে পশিয়া না যায়। কিন্তু রিং থেমে যায়, কেউ ফোন রিসিভ করে না।
‘কী হলো?’ জিজ্ঞাসা শবনম আরার।
‘আবদুল খালেক ফোন ধরছে না’, আমি নিরাসক্ত গলায় বলি।
‘আবার করো।’
বাধ্য স্বামীর মতো আমি আবার রিং করি। আগের মতো ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ গান যাতে না শুনতে হয়, সেজন্য কান থেকে মোবাইল দূরে রাখি। রিং টোন আবারও শেষ হয়, কেউ রিসিভ করে না।
‘দেখলে তো’, চুলে চিরুণি চালাতে চালাতে বলে শবনম আরা, ‘ফোন না করে গেলে আজকেও খালিহাতে ফিরতে হতো।’

আমি ভেতরে ভেতরে উল্লসিত, শালার উজবুক আবদুল খালেক ফোন না ধরায়। আমি নিশ্চিত শবনম আরা মৌচাকে যাওয়া বাতিল করবে। আর বাতিল করলেই আমি বন্ধুর বাসায় পানের আসরে যেতে পারব। আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে না দেখা আবদুল খালেকের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধে আক্রান্ত, আবদুল খালেক, তুমি আমার প্রাণের বন্ধু। তুমি আমার বোতল বন্ধু। আমি চুপচাপ বিছানায় বসে আছি। ধ্যানে আমি চলে গেছে বন্ধুর পানশালায়। বন্ধু ইকবাল বলেছিল, আজকের পানীয় পান হবে অন্য স্টাইলে। পানীয়ের সঙ্গে থাকবে ইলিশ মাছ ভাজি আর মুড়ি ভর্তা। তিনটি ইলিশ মাছ ভাজি করা হবে।
‘আবার ফোন দাও’... প্রসাধন সেরে এবার পোশাকের দিকে নজর দিয়েছে শবনম আরা। আমার সামনে পরনের শাড়ি খুলেছে, প্রতিরাতের দেখা শরীর এই মুহূর্তে দেখে চোখে আবার নেশার পাল তুলে দিয়েছে। আমি এক হাতে আবদুল খালেককে রিং করে অন্যহাতে ধরি শবনমের দুটো পায়রার একটিকে, আহা কী নরম, কী পেলম, গত বিশ বছর ধরে এই পায়রার মালিক আমি, যতবারই ধরি, ততবারই নতুন লাগে, ততবারই... আমার দিকে কপট দৃষ্টিতে তাকায় শনবম আরা, কিন্তু আমি থোড়াই পরোয়া করি। করোটির ভেতরে আমি এই মুহূর্তে বিছানায় যাবার চরম মুহূর্ত আঁকছি কামরুল হাসানের ছবির মতো, ঠিক সেই সময়ে মোবাইল রিসিভ করে, ‘হ্যালো?’
ওপাশে আবদুল খালেক নয়, এক মহিলার কণ্ঠ।
আমার করোটির ভেতরে শবনম আরাকে বিছানায় নেওয়ার যে চিত্রকল্প তৈরি করছিলাম, সেই ছবি মোবাইলের ওপাশে নারী কণ্ঠের সুরে পানসে হয়ে যায়।
‘এটা কি আবদুল খালেকের নাম্বার?’
‘হয়। হ্যার নাম্বার।’
‘আপনি কে?’
‘আমি হ্যার স্তিরি।’
আমার হাসি পায়, ‘আমি হ্যার স্তিরি’ শব্দ তিনটি শুনে। ইতিমধ্যে আমার হাতের মুঠো থেকে শবনম আরা কবুতর জোড়া সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে পেটিকোট ছেড়ে নতুন পেটিকোট পরছে। চোখে আমার বিদুৎ খেলছে।
‘আমাদের বালিশ চারটা কি হয়েছে? অনেক দিন হয়েছে আজ নিতে আসতে চাই। আপনি আবদুল খালেককে দিন’...
ওপাশে কয়েক মুহূর্ত চুপ, আমিও চুপ। পেটিকোটের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে আমার ওপর শবনম আরা চোখ রাখে।
‘কই দিন আবদুল খালেককে’... আমি তাড়া দিই।
‘আমি হেরে কেমনে দিমু’... আবদুল খালেকের স্ত্রী সাত সাগরের কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি হতভম্ব, বুঝে গেছি আবদুল খালেকের ঘটনা। লোকটা এই দুনিয়ার তামাম মেঘমাল্লারের গান শোক সন্তাপ চাওয়া পাওয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি মোবাইলের লাউড স্পিকার খুলে দিলাম... মোবাইলের ওপাশের কান্নার প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়ে আমাদের শোবার ছোট্ট ঘরে। ব্রা পরতে পরতে শবনম আরা বসে আমার সামনে।
‘আমি হেরে কেমনে দিমু’... আবদুল খালেকের স্ত্রী জীবনের সকল শোক উজার করে দিয়েছে, ‘হে তো তিন দিন আগে মইরা গেছে। ও আল্লারে এহন আমার কি অইবে’... আমরা দুজনে সেই বিলাপ শুনতে শুনতে আবদুল খালেকের স্ত্রীর অথৈ শোক আমাদের দুজনকেও আক্রান্ত করে। আমাদের চোখ ভিজে যায়, আমার না দেখা বালিশ মেকার আবদুল খালেকের জন্য বুকের মধ্যে শোকের স্রোত বইতে থাকে। আমি মনে মনে আমাকে প্রশ্ন করি, আবদুল খালেক কেমন ছিলেন? হালকা লম্বা? নাকি বেঁটে? মুখে কি দাড়ি ছিল? আবদুল খালেক কি পান খেতেন? কেমন ছিলেন বালিশ মেকার আবদুল খালেক?
আসুন, আমরা আবদুল খালেকের একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করি।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর