যুদ্ধ বিশ্বসাহিত্যে স্থান পেয়েছে। কিছুদিন আগে দুটো মুভি দেখি, একটি ভারতীয় মুভি, নাম ‘হায়দার’, অন্যটি সাড়া জাগানো মুভি ‘দ্য পিয়ানিস্ট’। ‘হায়দার’ মুভির পরিচালক ছিলেন বিশাল ভরদ্বাজ। এটিতে একটা ডায়ালগ ছিল যার বাংলা করলে এমন দাড়ায়, ‘দুটো হাতির যখন লড়াই হয় পায়ের নিচে ঘাস দলে যায়। সাধারণ মানুষ তো মরবেই ভাই।’ এরও অনেক আগে ফয়েজ আহমেদের অনুবাদে পড়েছিলাম উর্দু গল্প ‘রাভী পার’। তখন কৈশোর পেরুনো আমি। সেই গল্প তখনই আমাকে বিষণ্ণ সন্ধ্যা উপহার দিয়েছিল। গল্পটা এমন, ১৯৪৭, ভারত ভাগ হলো। এক পাঞ্জাবী পরিবারকে চলে আসতে হয় পাকিস্তান থেকে ভারতে। সেই নিয়ে গল্প। এক গরিব পরিবার ছিল তো একরকম পাকিস্তানে। কিন্তু তাদের আসতে হচ্ছে ভারতে। ঠিক সেই সময় তার বউয়ের বাচ্চা হলো। তাও জমজ। তবু তাদের জন্মভিটে ছেড়ে, এতদিনের গড়ে ওঠা জীবন ছেড়ে, জমজ বাচ্চাদের কোলে নিয়ে চলে আসতেই হচ্ছে। তারা কোনো রকমে উঠে পড়ল এক ট্রেনের ছাদে। মায়ের কোলে দুই বাচ্চা। ট্রেন চলেছে এক অন্ধকার রাতে ভারতের দিকে। ভিড়ের চাপে, প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় বাবা-মা খেয়ালই করেনি কখন তাদের এক বাচ্চা মারা গেছে। বাবা এক বাচ্চার গায়ে হাত দিয়ে দেখল বরফের মতো ঠান্ডা। তখন আর দুঃখ করারও সময় নেই। মাকে বলল ছেড়ে দাও, ও আর নেই, মারা গেছে। ছেড়ে দাও বললেই কি আর ছাড়া যায়। মায়ের মন, কী জানি, কোলে থাক, যদি হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে আবার! এই তো এলো আমার কোলে, কয়েক ঘণ্টা আগেই জন্ম হলো। ট্রেন এগিয়ে চলল। এগিয়ে চলল। আর একটু এগুলোই ভারত। সবাই তাকিয়ে আছে অন্ধকারে ভারতের দিকে। এসে গেল রাভী নদী যাকে বলি ইরাবতী। গমগম করে ট্রেন নদী পার হয়ে যাচ্ছে। কে যেন পাশ থেকে বলে উঠল, সর্দারজী, মরা বাচ্চাকে আর কোলে রেখে লাভ নেই, গুনাহ হবে, নদীতে ভাসিয়ে দিন। সর্দারজীর তখন মাথার ঠিক নেই। বউয়ের কোল থেকে জোর করে বাচ্চাকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে দিল নদীর জলে। রাতের আন্ধকারে একটি বাচ্চার কান্নার কচি গলা কাছ থেকে দূরে মিলিয়ে গিয়ে শব্দ হলো ঝপ্। পরক্ষণে সর্দারজীর কী মনে হতে বউয়ের কোলে হাত দিল, তার বউ মরা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তখনও কাঠ হয়ে বসে আছে। অন্ধকারে সর্দারজী ও তার বউয়ের পরষ্পরের দিকে শূন্য দৃষ্টি। এই তো হারানো, রাজনীতির মারপ্যাঁচে সাপলুডো খেলার দান থেকে একটা প্রাণের ঝরে পড়া।
খুশবন্ত সিংয়ের প্রথম উপন্যাস ট্রেন টু পাকিস্তান। বইয়ের মূল চরিত্র জুগগাত সিং, অন্য একটি চরিত্র মানো মাজরার জেলার হুকুম চাঁদ। একটি পার্শ্বচরিত্র কেমন করে উপন্যাসের মূল ঘটনার ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করতে পারে, তা দেখিয়েছেন খুশবন্ত। ডাকাতির অভিযোগে প্রায়ই কারাগারে আটক থাকত জুগগাত সিং। চারপাশে দাঙ্গা শুরুর পর ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ মানো মাজরায় এসে বুঝতে পারেন যে, কোনো সময় সেখানকার মুসলমানরা হামলার মুখে পড়বে, তাই সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়ার। এর আগেই পাকিস্তান থেকে এক ভুতুড়ে ট্রেন আসে। সে ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য কাঠ জোগাড় করতে হয় আর মানো মাজরা গ্রামের মানুষ দূর থেকে দেখে আকাশ ভর্তি ধোঁয়া। সেই ট্রেনভর্তি ছিল হিন্দু ও শিখদের লাশ। এ ঘটনার পর আশঙ্কা শুরু হয় এই শরণার্থী মুসলমানদের নিয়ে যে ট্রেন পাকিস্তান যাবে তাতে প্রতিহিংসাবশত হামলা হবে। সে হামলা প্রতিরোধের কোনো উপায় প্রশাসনের ছিল না বলে অসহায় হয়ে পড়েন হুকুম চাঁদ। ঠিক তখনই তার মাথায় এলো অন্য ভাবনা। তিনি ছেড়ে দিলেন জুগগাত সিংকে। হুকুম চাঁদ মনে করেছিলেন, অন্য কোনো উপায় না হলেও জুগগাত নিশ্চয়ই ওই ট্রেন নিরাপদে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। কারণ সেই ট্রেনেই রয়েছে তার মুসলমান প্রেমিকা নুরান। হুকুম চাঁদের ধারণাই ঠিক হয়েছিল। মুসলমান প্রেমিকার জন্য জুগগাত সিং বাঁচিয়ে দিয়েছিল সেদিনের ট্রেন। ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা। আর নুরানের চরিত্রটা খুশবন্ত কেমন বর্ণনা করেছিলেন? প্রথম দিকে কামতাড়িত এক উঠতি বয়সী নারী যে কিনা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে জুগগার সঙ্গে রাতের অন্ধকারে মিলিত হয়। সেই নারী পাকিস্তান চলে যাওয়ার নির্দেশে বলেছিল, কে আমাদের বের করে দেবে গ্রাম থেকে? এ গ্রাম আমাদের সবার। মুসলমান মেয়ে হয়েও উচ্চারণ করেছিল ‘সতশ্রী আকাল’। যুদ্ধকে ভালোবাসাই হারিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেই ভালোবাসা টিকে থাকে কি ক্ষমতা চর্চার রাজনীতিতে? আমার উত্তর জানা নেই। তবে এটি জানি টান বলে একটা কথা আছে সেটি জারি রাখলে সবই সুন্দর হয়ে ওঠে। টানটা কেমন?
একটা সিনেমার শুটিংয়ের সময়ে এক পরিচালক ও এক লেখকের গল্প বলি। ইন্টারেস্টিং। সেই চিত্র পরিচালক চিলির, কিন্তু আজ বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল তাঁর নিজের দেশ থেকে, যখন অগস্তো পিনোচেত সালভাদোর অ্যালেন্দেকে সরিয়ে মিলিটারি কূপের মাধ্যমে চিলি দখল করে। তাঁর মতো আরো অনেককে, তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের, হয় গুলি করে মারা হয়, কারাবদ্ধ করা হয়, নয়তো নির্বাসিত করা হয় সেই সময়ে। যখন পিনোচেত এর কূপ নেমেছে চিলিতে, তখন লিতিন শ্যুট করছিলেন তাঁর The Promised Land নামক ছবির শেষ দৃশ্য। এই ছবি একটা গ্রামকে নিয়ে, যার অনুর্বর জমিতে ফসল ফলে না কিছুতেই। সেই গ্রামে এসে পৌঁছায় একটি মেয়ে ও তার আরো কিছু সহকর্মী, যারা ওই গ্রামের মানুষদের শেখায় কিভাবে ফসল ফলাতে হবে, তাদের আরো নানা স্বপ্ন দেখায় আর নিজেরাও জড়িয়ে পড়ে সেই স্বপ্ন সত্যি করতে। শেষ দৃশ্যে ক্ষেতময় সবুজ ফসল ফলেছে, আর অসামান্য সুন্দরী সেই নায়িকা নগ্ন হয়ে একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে সেই ফসলের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে দিগন্তের দিকে—সুররিয়াল একটি দৃশ্য, একটা অলীক রুপকথার ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন লিতিন। কিন্তু সেই রুপকথায় বাস্তব ঢুকে পড়ল। শ্যুটিং চলাকালীন মিলিটারি হেলিকপ্টার নামল সেই ফসলের ক্ষেতে, এবং গুলি চালাতে শুরু করল। ক্রু মেম্বাররা পালাতে লাগল, কিন্তু লিতিন আর তাঁর ক্যামেরাম্যান রয়ে গেলেন। লিতিন নির্দেশ দিলেন, যাই হোক, ক্যামেরা চালিয়ে রাখো। নায়িকা কিছু বুঝতে পারার আগেই তাঁর বুকে গুলি লাগল, তিনি তখন ঘোড়ার পিঠে, ঘোড়া ছুটছে দিগন্তের দিকে। ক্যামেরা ধরে ফেলল সেই দৃশ্য—স্বপ্নের মতো এক নগ্ন সুন্দরী সাদা ঘোড়ার পিঠে ছুটে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে, তার বুকে এসে লাগল গুলি, ছিটকে পড়া রক্তে ভেসে গেল সাদা ঘোড়ার গা, তার মৃতদেহ নিয়ে ঘোড়াটা ছুটে চলল ডুবন্ত সূর্য্যের দিকে। ক্যামেরা ও রিল নিয়ে লিতিন পালাতে পেরেছিলেন। দৃশ্যটি এভাবেই দেখানো হয়েছিল ছবিতে। এভাবেই, Promised Land শব্দের মানে বদলে দিয়েছিলেন লিতিন, ম্যাজিক আর রিয়ালিটিকে মিশিয়ে দিয়ে। সেইসঙ্গে, ঘটমান বর্তমানকে ইতিহাসের জন্য অমর করে রেখেছিলেন তাঁর ছবিতে। সেই লিতিন, চিলি থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ছটফট করতেন ফিরে যাওয়ার জন্য, ওখানকার অনাচারের প্রতিবাদ করতে একটা ছবি বানানোর জন্য। কিন্তু সে ছবি চিলিতে না যেতে পারলে কিভাবে বানাবেন? শেষে, এক দারুণ চক্রান্ত রচনা করে ছদ্মবেশে চললেন তিনি চিলিতে। নতুন পরিচয়ে, এমনকি একজন নকল বউকে সঙ্গে নিয়ে, একটা অ্যাড ফিল্মের ডিরেক্টর সেজে, গোটা ইউনিট নিয়ে। কেউ জানত না তিনি আসলে কে, শুধু তাঁর নকল বউ জানত। অ্যাড ফিল্মের শ্যুটিং চলত বিরাট ঘটা করে একদিকে, অন্যদিকে একটা হ্যান্ডিক্যামে লিতিন তুলে চলেছেন আসল ছবি, গোপনে, একজন স্পাইয়ের মতো। শেষের দিকে প্রায় ধরা পড়তে পড়তেও পালাতে পারেন। এক রোমহর্ষক সত্যি গল্প। আবার সেই ম্যাজিক রিয়ালিজম। ম্যাজিকের মতো রিয়ালিটি। ফেরার সময়ে, প্লেনে একজন লিতিনের পাশে বসেন। লিতিন তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারেন, এ লোকটা মিত্রপক্ষের। তাঁকে গল্পটা বলতে থাকেন লিতিন। সেই লোকটা, যাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি হলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। প্লেনে শোনানো সেই গল্প নিয়েই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লেখেন, Clandestine in Chile।
তো এসব যুদ্ধ, ছায়াযুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধের কথাই বলছিলাম। কিন্তু যদি বিশ্বসাহিত্যের পিছনের দিকে ফিরে তাকাই তবে কী দেখি, হোমার খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দে সবচেয়ে পুরান যুদ্ধ ট্রজান ওয়ারকে লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর মহাকাব্য ইলিয়াড আর ওডিসিতে। দেখি, মহাভারতে , রামায়ণে, বিষাদসিন্ধুতে কারাবালার প্রান্তরে কী যে অসহায় মুখ আর এক শ্রেণীর বীরত্বগাথা। গ্রিক মিথ অনুসারে ট্রয় নগরীর যুবরাজ প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করার পরই শুরু হয় ট্রয়ের যুদ্ধ। ইলিয়াডে সেই কাহিনীই বিবৃত হয়েছে ট্রয় পুড়ে ছারখার হওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু হেলেন উদ্ধার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহান বীর একিলিসের মৃত্যুও সেই আখ্যানের মর্মন্তুদ উপাদান। জয় ও পরাজয়ের মধ্য দিয়ে একপক্ষের আনন্দোল্লাসের পাশে বিজিত গোষ্ঠীর অবসাদ ও পরাজয়ের গ্লানিও উপেক্ষিত হয়নি মহৎ সাহিত্যিকদের হাতে। ‘মহাভারতে’র কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ভর করে আজও মানুষকে হাহাকারে নিমজ্জিত করে। দ্রোপদীকে নিলামে তোলার মতো ঘটনা, সীতাকে সতীত্বের অগ্নি পরীক্ষা, আহা কী যে উপহাস। ঊনিশ ও বিশ শতক হলো যুদ্ধ সাহিত্যের স্মরণীয় কাল। টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ বহুমাত্রিক উপন্যাস। রাশিয়ার অভিজাত জনগোষ্ঠী, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আর রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে এখানে। ১৮১২ সালে মহাবীর নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এটির আখ্যান নির্মিত।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫) সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্গারেট মিচেলের (১৯০০-১৯৪৯) ‘গন উইথ দি উয়িন্ড’ (১৯৩৬) একটি রোমান্টিক উপন্যাস। দুটি নর-নারীর প্রেমের সম্পর্কের অমোঘ বিধান হিসেবে গৃহযুদ্ধ ও নির্মীয়মাণ যুগের অশনি আছড়ে পড়েছে গল্পের কাঠামোতে। অন্যদিকে জন জ্যাক দেখালেন যুদ্ধ দূরবর্তী দুই প্রান্তের মানুষকে এক স্থানে টেনে আনে, গড়ে ওঠে সৌহার্দ্য। তাঁর উপন্যাসে দেখা যায়, দুটি চরিত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্কে জড়িত হয়ে শেষ পর্যন্ত সেই সম্পর্কের বাইরে এসে নিজেদের আবিষ্কার করে ওই যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) পৃথিবীর অসংখ্য লেখককে আন্দোলিত করেছে। বিশেষত তার পরপরই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা মানুষকে নতুন সংগ্রামের সম্মুখীন করে। তারা নিজেদের দেখতে পায় আরেক যুদ্ধে নিজেদের অনিচ্ছায় জড়িয়ে যেয়ে বিপর্যস্ত হতে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আত্মজৈবনিক ভঙ্গিতে ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ (১৯২৯) লিখে চমকে দিয়েছিলেন। হেমিংওয়ে ছিলেন ‘ওয়ার প্রোডাক্ট’। গোটা মার্কিন সাহিত্যে তাঁর মতো করে যুদ্ধকে আর কেউ উঠিয়ে আনতে পারেননি। ফলে বিশ্বসাহিত্যে ওয়ার রাইটিংস বা যুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যকর্মের প্রসঙ্গ উঠলেই তার নাম সবার আগে নিতে হবে। হেমিংওয়ের সাহিত্যে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও যুদ্ধ-পরবর্তী নিঃসঙ্গতা বা হতাশার কথা যেভাবে এসেছে তিনি নিজে যুদ্ধসৈনিক না হলে হয়তো সেভাবে আসত না। ব্যক্তিজীবনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে ফ্রন্টে কাজ করেছেন। যুদ্ধে আহতও হয়েছেন।
যুদ্ধকালে হেমিংওয়ে প্রথমে যান প্যারিসে, এরপর মিলানে। যেদিন তিনি মিলানে পৌঁছান, সেদিনই সামরিক ভাণ্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে। হেমিংওয়ে সৈনিকদের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীর মর্গে বয়ে আনেন। তিনি ওই প্রথম প্রত্যক্ষ করেন যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র। এরপর তিনি নিজেও অস্ট্রিয়ার মর্টার সেলে আহত হন। ওই সময় তিনি ইটালিয়ান সৈন্যদের মধ্যে চকোলেট ও সিগারেট বিলি করছিলেন। আহত অবস্থায় তিনি মিলানের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে নার্স Agnes von KurowsK-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরিচয় থেকে প্রণয়। যার অনুপ্রেরণায় তিনি লেখেন পৃথিবী বিখ্যাত উপন্যাস ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’। একইভাবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘আইল্যান্ডজ ইন দ্য স্ট্রিম’ও তাঁর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে রচিত। এরিক মারিয়া রেমার্কও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অসামান্য রূপকার হিসেবে আমার প্রিয়। তাঁর ‘অল কোয়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে’র (১৯২৯) পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় রয়েছে এক জার্মান সৈনিকের শারীরিক ও মানসিক চাপ, তাঁর অনুভূতির অসামান্য বর্ণনা। যুদ্ধের ফ্রন্ট থেকে সৈনিকের নিজগৃহে ফেরার আকুতি। আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী বয়ান ‘আনা ফ্রাংকের ডায়েরি’। এই আনাফ্রাংক কোনো যোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ভুক্তভোগী পলায়নপর একজন কিশোরী। তিনি যুদ্ধকে দেখেছেন একজন বিপর্যস্ত মানুষের চোখ দিয়ে। যুদ্ধের অপারেশনাল ন্যারেটিভ নিয়ে হয়তো অনেক বই লেখা হয়েছে কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এনা ফ্রাংকের ডায়েরি হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দলিল। হয়েছে জনপ্রিয়। আনা ফ্রাংকের মতো হলেন নেলি সাক্স।
হিটলারের আক্রোশে কোটি মানুষের মৃত্যু যেমন হয়েছিল, তেমনি দেশহারা হয়েছে লাখো ইহুদি। দেশান্তরি হওয়া ইহুদিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জার্মান-সুইডিশ নোবেল বিজয়ী কবি ও নাট্যকার নেলি সাক্স। ১৮৯১ সালের ১০ ডিসেম্বর জার্মানির বার্লিনে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে কবিতা ও গল্প লেখা শুরু করেন সাক্স। জার্মানির পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশও করে জার্মান পত্রিকাগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের বছর ১৯৪০ সালে মাকে নিয়ে জার্মানি থেকে পালিয়ে সুইডেন চলে যান সাক্স। সেখানে গিয়েও জার্মানির গুপ্তচর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি তারা। তাদেরকে এক সপ্তাহ পর ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে বলা হয়। কিন্তু ১৯০৯ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী কবি লেগারলফের সহায়তায় তারা সে যাত্রায় বেঁচে যান। নেলি সাক্স ও তার মাকে আশ্রয় দিতে সুইডিশ রাজপরিবারকে বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন লেগারলফ। সীমান্ত এলাকায় শরণার্থী শিবিরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাক্স এতটাই ভয় পেয়েছিলেন, এক পর্যায়ে তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে লেগারলফের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন সাক্স। রিফিউজি হিসেবে সুইডেন পালিয়ে যাওয়ার পর সাক্স তার মাকে নিয়ে এক কামরার ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া নেন। তারপর জীবিকা নির্বাহের জন্য অনুবাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। স্টকহোমেই সাক্স তার বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। খুব দ্রুত সাক্স সুইডিশ ভাষা রপ্ত করেন এবং ১৯৫২ সালে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। সে সময়ে বিশ্বযুদ্ধ ও সার্বিক সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার অনেক শক্তিশালী কবিতা ও নাটক রয়েছে। ১৯৫০ সালে তার মায়ের মৃত্যু হলে তিনি ভীষণ ভেঙে পড়েন।
নেলি সাক্স প্রথম জীবনে মূলত রোমান্টিক ধারার কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তার জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। তার অনেক লেখা ইহুদিদের প্রতি নাজি বাহিনীর নির্যাতন মুখপাত্রের ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছিল। সংকটময় ও কণ্টকাকীর্ণ জীবনে তিনি বেশ কিছু অসাধারণ রচনার জন্ম দিয়ে গেছেন। সাক্সের উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে—‘ডেথ, ‘এক্লিপস অব স্টারস’, ‘নো ওয়ান নোস্ হয়ার টু গো’, ‘ফ্লাইট অ্যান্ড মেটামরফোসিস’ এবং নাটক ‘ইলি’ [১৯৫১]। ১৯৬৬ সালে নেলি সাক্স সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।
স্পেনের গৃহযুদ্ধও (১৯৩৬-১৯৩৯) আমাদের দিয়েছে অসামান্য কিছু সৃষ্টি। স্পেনের গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-১৯৩৯) শুরু হয়েছিল সেখানকার সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকজন জেনারেলের স্বঘোষিত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। রিপাবলিকদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্ব বিদ্রোহে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে রিপাবলিকানদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এবং অনেকেই স্পেন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জার্মানিতে তখন হিটলার আর ইতালিতে মুসোলিনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই ফ্যাসিস্টদের স্পেনের প্রতি কুদৃষ্টি পড়ার কথা। অপরদিকে পরাভূত রাজতন্ত্র ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল আর সুযোগ খুঁজছিল। তাই সে হাত করল ফ্যাসিস্টদের সাথে, দাঁড় করানো হলো ফ্রাঙ্কো নামে এক সুযোগসন্ধানী সেনাপতিকে। স্পেনের অধীন আফ্রিকার মরক্কোতে বর্বর যুদ্ধে তার বেশ খ্যাতি আছে যদিও সেখানে স্পেন প্রচণ্ডভাবে হেরে যায়। গির্জা আর রাজতন্ত্রের মদত দিতে ১৯৩৬ সালে সে স্পেনে প্রবেশ করে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া। বত্রিশ মাসের এই যুদ্ধে স্পেনের অন্তত দশ লক্ষ লোক মারা যায়। স্পেনই বোধহয় প্রথম দেশ যেখানে কবিরা সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত থেকে এবং লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ করে শেষ পর্যন্ত প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। স্পেনে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ে প্রথমেই প্রাণ নিল শ্রেষ্ঠ কবি ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার যাকে হত্যা করার পর তাঁর কবর পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, কারাবাসে মৃত্যু হলো মিগেল হার্নান্দেজের। মিগেল হার্নান্দেজের জন্ম ১৯১০ সালে, পূর্ব স্পেনের ওরিউয়েলা গ্রামে। তিনি ছিলেন একজন রাখাল, ওরিউয়েলা গ্রামে ছাগল চড়াতেন। তিনি লেখাপড়া শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, প্রায় একা একাই। গাঁয়ের চার্চের গ্রন্থকার তাকে সন্ধান দিয়েছিলেন স্পেনের সাহিত্যের স্বর্ণযুগের। গোঙ্গারো, কেভেদো, লোপে দে ভেগা, কালদেরোনসহ আরো অনেক স্মরণীয় কবি নাট্যকারকে এই চার্চের ধূলিধূসর লাইব্রেরিতে আবিষ্কার করেছিলেন হার্নান্দেজ। একদিক থেকে সেটা তার পক্ষে ভালোই হয়েছিল। কেননা স্বর্ণযুগের পর স্পেনের সাহিত্যে সে একটা বিষম বন্ধ্যা ও ঊষর যুগ গেছে। কবিতা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে বিংশ শতাব্দীতে—ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা, রাফায়েল অ্যালবার্তি, আস্তোনিয়ো মাচাদো, ভিসেন্তে আলেইহান্দ্রে, হোর্হে পরপর অনেকগুলো নাম জ্বলজ্বল করতে থাকে। যেন কেউ দীর্ঘদিন পর অসাড় কোনো ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। কিন্তু সেই জাগরণ যে স্পেনের রাজনৈতিক নবজাগরণের সময়েই ঘটেছিল, এটা কোনো কাকতাল নয়। এই কবিদের সকলেই যে ফ্রাঙ্কো বিরোধী ছিলেন, সকলেরই যে বিশ্বাস ছিলো সাম্যবাদে—এটা বুঝিয়ে দেয় যে দেশের রাজনৈতিক জাগরণের সঙ্গেই জড়ানো ছিল সাহিত্যেরও নবজাগরণ।
এদেরই মধ্যে একজন কবি হার্নান্দেজ। হার্নান্দেজকেও গ্রেফতার করে বিনাবিচারে আটকে রাখা হলো ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার জেল কুঠুরিতে, যেখানে তার ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিল ক্ষয়রোগ। ১৯৪২-এর বসন্তে, যক্ষ্মায়, ফ্রাঙ্কোর জেলখানায় একটানা তিন বছর কাটানোর পর মৃত্যু হয় কবি হার্নান্দেজের। অথচ তার বয়স তখনও বত্রিশও হয়নি। মিগেল হার্নান্দেজের প্রথম কবিতার বই ‘অনেক চাঁদে দক্ষ’ বেরোয় ১৯৩৩ সালে, যখন তার বয়স মাত্র বাইশ। তার ঠিক তিন বছর পর বেরোয় তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘যে বজ্র কখনো থামে না’। তার দু বছর আগে চিলির কবি পাবলো নেরুদা মাদ্রিদে এসেছিলেন চিলির দূতাবাসে কাজ নিয়ে। মাদ্রিদে যে বাড়িতে নেরুদা তাঁর স্ত্রী দেলিয়ার সাথে থাকতেন, সেটা অল্পদিনেই কবিদের ওপেন হাউস হয়ে উঠল। সবচেয়ে বেশি যেতেন গার্থিয়া লোরকা ও হার্নান্দেজ। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুলাই ফ্রাঙ্কো উত্তর আফ্রিকা থেকে হামলা চালাল। নেরুদা, কন্সাস হিসেবে তার যে ক্ষমতা, তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে ঘোষণা করলেন, চিলি স্পেনীয় রিপাবলিকের পক্ষে। তাকে মাদ্রিদ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। কিছু কবিদের সহায়তায় নেরুদা স্পেনের উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করেন।
স্পেনের গৃহযুদ্ধে ধ্বংসলীলার শিকার একটা শহর গের্নিকা। স্পেনের বাস্ক অঞ্চলের রাজধানী গের্নিকা। স্পেনের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজনীতির আস্তানা ছিল এই বাস্ক অঞ্চল। ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল, হাটবাজারের দিন, বিকেলের প্রথম দিকে ফ্রাঙ্কোর সাহায্যে নিযুক্ত জার্মান বিমানবহর ঝাঁকে ঝাঁকে এসে সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে গের্নিকার ওপর বোমা বর্ষণ করে। শহরটা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। দু হাজার মানুষ নিহত হয়। তারা সবাই বেসামরিক লোক। গের্নিকার ধ্বংসের খবর যখন পাবলো পিকাসোর কানে পৌঁছে তখন তিনি প্যারিসে। খবর শোনার পর তিনদিন ঘুমাতে পারেননি। পিকাসো প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও তার জন্ম স্পেনের মালাগায়। গরিব ঘরের ছেলে ছিলেন তিনি। স্পেনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এড়াতে চলে আসেন প্যারিসে। যাহোক, গের্নিকার ধ্বংসলীলার কথা তাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। তারপর উন্মাদের মতো আরম্ভ করেন টুকরো টুকরো স্কেচ। প্যারিসের ওয়লর্ড ফেরার প্যাভিলিয়নে ১৯৩৭ এ দেখানো হলো ‘গের্নিকা’। সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীতে এটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। শোনা যায়, পরে জার্মান বাহিনী পিকাসোর ছবি প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করে, হিটলার পিকাসোর ছবি নষ্ট, পচা বলে ধিক্কার জানায়। তখন প্যারিসে হিটলারের প্রতিনিধি ছিল আবেটস। একদিন সে এসেছিল পিকাসোর স্টুডিওতে। এসে লোভ দেখিয়ে বলল, “মহাশয় পিকাসো, আপনি তো তেল কয়লা খাবার দাবার পাচ্ছেন না ঠিক মতো, কষ্ট পাচ্ছেন শুধু শুধু, ব্যবস্থা করব কিছু?” পিকাসো তখন খুব শান্তভাবে তাকে দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। আবেটস পেছনে ফিরতে যেয়ে চোখ পড়ল গের্নিকার দিকে। বলল, “ও তাহলে এটা আপনারই কাণ্ড?” পিকাসো উত্তর দিলেন, “না। এটা তোমাদের কাণ্ড।” অবশেষে ১৯৩৯ সালে বামপন্থী রিপাবলিকান সরকার যুদ্ধে হেরে যায়। ফ্রাঙ্কো সরকারের ক্ষমতা দখল করে।
এবার কিছু যুদ্ধের পটভূমিকা নিয়ে তৈরি মুভির কথা বলি। মুভির নাম ‘স্যাক্রিফাইস’। পরিচালক আন্দ্রে তারাকোভস্কি। অ্যালেক্স্যান্ডারের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমানের শব্দে পাগল পাগল লাগে। মনে হয় তার সসীম মাথার ভেতর বড়ো বড়ো যুদ্ধ বিমান ঢুকে ঘুরছে। সে চায়, যুদ্ধ থামুক। কিভাবে সে থামাতে পারে যুদ্ধ। তার বাড়ির গভর্নেস তাকে বলে এক ভুডু প্রথার কথা। সে হলো এক ডাইনি। যদি একদিন মেয়েটির সঙ্গে যৌনসঙ্গম করে, এবং সেদিনই সে তার বাড়িটা পুড়িয়ে দিতে পারে, তবে সেই স্যাক্রিফাইস পৌঁছবে দেবতার কাছে। তিনি থামিয়ে দেবেন যুদ্ধ। অ্যালেক্স্যান্ডার তার বৌ-ছেলেমেয়েকে পিকনিকে পাঠিয়ে নিজে যায় সেই অভিসারে। মাটির দশ ফিট ওপরে উঠে ভাসতে থাকে তারা সঙ্গমকালীন। ফিরে এসে অ্যালেক্স্যান্ডার তার বাড়ির সমস্ত চাদর, বেডকভার, টেবলক্লথ জড়ো করে ড্রয়িংরুমের মাঝখানে রাখা বড় টেবিলটার ওপর। একটা দেশলাই জ্বলে ওঠে ফস করে। সেই দেশলাই ছুঁইয়ে দেয় সে চাদরের এক কোণায়। এরপর আড়াই মিনিট ধরে স্ক্রিনে আগুনের ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। কিভাবে আগুন একটু একটু করে খাচ্ছে একটা বাড়িকে। অ্যালেক্স্যান্ডারের বাড়িকে। সাইলেন্স। কমপ্লিট সাইলেন্স। শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডে আগুনের চড়চড় শব্দ। আড়াই মিনিটের টানা শট। এক নির্বোধ দর্শকের মনেও ঠিক ততটাই ভাঙচুর ঘটাবে ওই দৃশ্য। পৃথিবীর আদিমতম শব্দ। আগুনের শব্দ। মাত্র আড়াই মিনিট। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে সেই ডাইনি দেখছে দিগন্তে পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়া। নৈস্তব্ধ ভঙ্গ করে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। অ্যালেক্সান্ডারকে নিতে আসছে ওরা অ্যাসাইলাম থেকে। কোন অ্যাসাইলামে নিয়ে যাবে ওরা তাকে? এ হচ্ছে আন্দ্রেই তারকোভস্কি’র ‘স্যাক্রিফাইস’ ছবির শেষ দৃশ্য। ওই অ্যালেক্স্যান্ডারকে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে খুব। চোখের সামনে যখনতখনই আগুন জ্বলে ওঠার দৃশ্য দেখতে পাই।
আরেকজনের কথা মনে পড়ছে তার নাম, আন্তোনিয়েত। ঠিকই ধরেছেন আপনি। জ্যঁ রিসের লেখা ‘ওয়াইড সারগ্যাসো সি’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের নাম আন্তোনিয়েত। তাকে আমরা অনেকদিন আগে থেকে চিনি। বিখ্যাত ‘জেন আয়ার’ উপন্যাসের নায়ক রচেস্টারের সেই পাগল বউ, যে চিলেকোঠা থেকে চিৎকার করত। তার গল্পটাই লিখেছিলেন জ্যঁ রিস। তার উৎখাত, তার ডিস্প্লেসমেন্ট, স্পেনের সমুদ্র-অর্কিড-সূর্যাসতের ক্যুলিব্রি এস্টেট থেকে তাকে হিঁচড়ে নিয়ে আসা কার্ডবোর্ডের শহর লন্ডনে, তার আহত হওয়া, তার বিশ্বাস হারানো, পাগল হতে থাকা, বন্দী হওয়া—এসমস্ত কথা লিখেছিলেন জ্যঁ রিস। একদিন আন্তোনিয়েত, কিভাবে ও কেন, তার বরের প্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঝাঁপ দিল ছাদ থেকে, তা বর্ণনা করেছেন। ‘জেন আয়ার’ উপন্যাসে যা ছিল শুধুই ঘটনা। সেই উপন্যাসের পাগলী, যে ছিল নামহীন এবং বক্তব্যহীন, তাকে ভাষা দেওয়ার জন্যই লেখা ‘ওয়াইড সারগাসো সি’। রচেস্টারের পাগলী বউ কি বলত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে? বলত, “তোমরা কোথায় যাও। এত ব্যস্ত কেন তোমরা? তোমরা কোথায় যাও?”
একদিন রচেস্টার জানতে চায় তার বউয়ের কাছে, “তুমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় ছুটে চলা মানুষদের এসব কেন বলো?”
পাগলী বউ রেড ওয়াইন গিলে। চুরুট টানে। সেই পাগলী বউকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধই। মুভির নাম ‘দ্য সাইল্যান্স’। পরিচালকি রিচার্ড জব্রি। শিন্ডলারস লিস্ট-এর কথা মনে আছে তো? গাড়িটার দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন অস্কার শিন্ডলার। সেখানে গাড়ির বদলে দশটা মানুষ থাকতে পারত, বাঁচতে পারত আরো দশটা জীবন। অথবা কোট পিনটার দামে কেনা যেত আরো দুজনকে। কিন্তু হায় যুদ্ধ! কত সস্তা এর কাছে সবকিছু। লিয়াম নেসন ও স্যার বেন কিংসলে অভিনীত ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ ছবির শেষ দৃশ্য এটি। শুধু এই দৃশ্যই বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি বাহিনীর ভেতরে থেকেও মানবতার প্রখর দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইতিহাস। শিন্ডলার ও তাঁর ইহুদি হিসাবরক্ষক স্টার্নের প্রখর দূরদর্শিতায় ১২০০ নিরপরাধ ইহুদি বেঁচে যায় জার্মান কন্সেট্রেশন ক্যাম্প থেকে। পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ। থমাস কেনেলি রচিত জীবনিভিত্তিক বই ‘শিন্ডলারস আর্ক’-কে উপজীব্য করে নির্মিত এই ছবি অস্কার, গোল্ডেন গ্লোবসহ অজস্র পুরস্কার জয় করে নেয়।
আরেকটি বিখ্যাত মুভি ‘দ্য পিয়ানিস্ট’। শুরুতে বলেছিলাম এ মুভির কথা। অস্কারের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে সেরার পুরস্কার ঘরে তুলেছিলেন আড্রিয়েন ব্রডি এই ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ দিয়েই। রোমান পোলোনস্কির অন্যতম সেরা কাজ মানা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিকে। পোলিশ পিয়ানোবাদক ওয়াদিসওয়াফ স্প্লিজমানের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও হলোকাস্টের নগ্নরূপ উঠে এসেছে এই যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে। যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে তা ভুলে থাকার জন্যে পিয়ানো বাজানো? কম কথা নয়।
ক্রিস্টোফার নোলানের যুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ডানকার্কে’। এটিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই নির্মিত। ব্রিটেন-আমেরিকা-ফ্রান্স-নেদারল্যান্ড, এই চার দেশের প্রযোজনায় তৈরি এই ছবির মূল গল্প আবর্তিত হয়েছে ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের ডানকার্কে ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ঙ্করী ঘটনাকে ঘিরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স থেকে ব্রিটিশ সেনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় জার্মান সেনাবাহিনীর হামলার দারুণ রূপায়ন দেখা গেছে এই মুভিতে। যদিও উইনস্টন চার্চিল সেসময় এই ঘটনাকে ‘ব্যাপক মিলিটারি দুর্যোগ’ হিসেবেই অভিহিত করেছিলেন।
কোয়ান্টিন টারান্টিনোর ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’ মুভিতে গল্প বলার স্টাইলটাই আলাদা। সবাই যে পথে হাঁটে সেই পথে তিনি পাও মাড়ান না। তাই যুদ্ধের গল্প বলার ধরনেও তিনি দেখিয়েছেন অন্য স্বাদের খোঁজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্থান ঘটে নাজিদের। আর এর পাশাপাশি তাদের দমন করতে এগিয়ে আসে একদল ইহুদি-আমেরিকান যোদ্ধা, যাদের নাম ‘বাস্টার্ডস’। মুভিতে নির্বিচার ইহুদি হত্যার চাইতেও গুরুত্ব পেয়েছে এর বিরুদ্ধে জেগে ওঠা শক্তির দৃশ্য। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনার বেলাতেও যে মেল গিবসন সফল, তার আরেকটি প্রমাণ ‘হক শ রিজ’। ২০০৪ সালে প্রচারিত ‘দ্য কনসাইন্শাস অবজেক্টর’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এন্ড্রু গারফিল্ডকে নিয়ে তৈরি করেন এই মুভিটি। অধিকাংশ যুদ্ধের মুভির মতো এটিও জীবনীভিত্তিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া আমেরিকান ডাক্তার ডেসমন্ড ডসের অভিজ্ঞতা নিয়েই তৈরি হয়েছে এ মুভি। ডেসমন্ড ডস এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন দেখেন লাশের সারি সারি স্তূপ। ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে নাহ, গুলাগুলির শব্দ নয়, এক করুণ প্রেয়ার সং। এরকমই আরেকটি মুভি, সেভিং প্রাইভেট রায়ান। এটিও স্টিফেন স্পিলবার্গের। ১৯৪৪ সালের এক সত্য ঘটনার পটভূমিতে নির্মিত এই ছবিটি সর্বকালের অন্যতম সেরা ওয়ার মুভিজ হিসেবেও স্বীকৃত। যুদ্ধকেন্দ্রিক অসংখ্য ছবির মধ্যে মাত্র কয়টির নাম নেওয়া বেশ দুঃসাধ্য। আমাদের বাংলায় আমার দেখা সেরা মুভিগুলো হচ্ছে, সুবর্ণরেখা, আগুনের পরশমনি। খুব একটা ভালো কাজ হয়নি বাংলায়।
তবে কিছু উপন্যাস ও কবিতায় এসেছে ভালোভাবে। স্বল্পপরিসরে কয়েকটি নিয়ে বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসের পটভূমি ব্রিটিশ শাসনের সূর্য যখন মধ্য দুপুর পার করছে। যখন হিন্দুদের মধ্যে জাত্যাভিমান প্রবল। মুসলমানরা যখন তাদের কাছে অস্পৃশ্য। বিরোধ মেটাতে যখন ইংরেজরা ‘বঙ্গভঙ্গে’র ঘোষণা দেয় তখনকার চিত্র দিয়ে শুরু হয়েছে উপন্যাস। গোটা উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে ময়মনসিংহ এক অচেনা গ্রাম বান্ধবপুরের মানুষের জীবনপ্রবাহ এবং সময়ের সাথে সাথে তার পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে। হরিচরণ সাহা, উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, বিস্তর টাকা পয়সার মালিক হওয়া সত্ত্বেও সমাজচ্যুত হন এক মুসলমানের ছেলের জীবনরক্ষা এবং তাকে ঠাকুরঘরে নেওয়ার দায়ে। হিন্দু সমাজেও তিনি হয়ে পড়েন অস্পৃশ্য। হরিচরণ বাকিজীবন জনহিতকর কাজে উৎসর্গ করেন, তপস্যায় পরিণত হন ঋষি হরিচরণে। জমিদারি কিনে নিলে তাকে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার নানান বিধান নিয়ে আসে পণ্ডিতেরা। ঋষি হরিচরণ টাকায় শুদ্ধি হওয়ার এই ব্যবস্থা নাকচ করে সমাজের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। হরিচরণের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন এক পাগল মাস্টার। ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায় না এই শশী মাস্টার ছিলেন দুই ইংরেজের খুনী, এক বিদ্রোহী যিনি পরবর্তীতে মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে চট্টগ্রামের অস্ত্রলুটের সময় শহীদ হন। গানপাগল এই বিদ্রোহী মানুষটা বান্ধবপুরে এসে প্রেমে পড়ে যান মুসলমান মেয়ে জুলেখার। অনিন্দ্যসুন্দর এই নারী, যার গানের গলা মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো গীতিকারকে, তার স্থান ছিল নদীর ওপারে রঙিলা নটীবাড়িতে।
মুসলমান শিশু ছুঁলে জাত চলে যায় কিন্তু কামের কাছে প্রতিটি মানুষ গোলাম। রঙ্গিলা নটীবাড়িতে হিন্দু মুসলমানের লুকিয়ে আসা যাওয়া তারই প্রমাণ। হিন্দুদের উগ্র জাত্যাভিমান আর এই অস্পৃশ্যনীতি বাঙালি মুসলমানের মনে কিভাবে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে তার প্রমাণ মেলে ধনু শেখের চরিত্রে। পরিবার নিয়ে অনাহারে দিনযাপন করা ধনু শেখ হরিচরণের সাহায্যে শুরু করে লঞ্চ ব্যবসা। ধর্মের হাওয়া বুঝে ব্যবসা করে অল্প দিনের মাঝে লাখের বাতি জ্বলে ধনু শেখের ঘরে। সুযোগসন্ধানী ধনু শেখ পরবর্তীতে ইংরেজ সরকার কর্তৃক খান সাহেব ও খান বাহাদুর খেতাব লাভ করে। ছোটবেলায় এক হিন্দু ময়রার কাছে ধর্মের জন্য অপমানিত হয়ে যে প্রতিশোধের অনল চাপা ছিল, বিত্তশালী হওয়ার পর সেই আগুনে পুড়ে অনেক হিন্দু বাড়িঘর। যে জাত নিয়ে হিন্দুদের ছিল এত অহমিকা সেই জাতভ্রষ্ট করে তাদের ধর্মান্তরিত করে যেন চাপা আগুনে ঘি ঢেলেছে ধীরে ধীরে। এমনকি যে হরিচরণ তার ভাতের সংস্থান করেছিল, তার মৃত্যুর পর তার জমিদারি ভোগদখল শুরু করে এই ধনুশেখ। হরিশংকর মৃত্যুর আগে তার জমিদারি লিখে দিয়ে যান জহির নামক সেই মুসলমান ছেলেটিকে, যার জীবন বাঁচাতে গিয়ে সমাজচ্যুত হয়েছিলেন তিনি। জহিরের নানান অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন জায়গায়। এই জহিরের পীড়াদায়ক মৃত্যুর কারণও এই অতিপ্রাকৃত যোগসাজশ।
হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সাদামাটা কিন্তু ভিন্নধর্মী বর্ণনাকৌশল। ‘মধ্যাহ্ন’ও তার ব্যতিক্রম নয়। উপন্যাসের একটা অংশজুড়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বান্ধবপুরের কিছু চিন্তাহীন মানুষ, যাদের এই যুদ্ধে কোনো লেনদেন নেই তারাও যুদ্ধ নিয়ে উত্তেজিত, হিটলার আর স্টালিনের রণকৌশল নিয়ে চিন্তিত। উঠে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষুদ্র ইতিহাস, হিটলারের পরাজয়, যে জাপানের কলকাতা আক্রমণ করার কথা তারই সাহায্যে চট্টগ্রাম দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের আক্রমণের মতো চমকপ্রদ তথ্য। যুদ্ধের দরুণ মন্বন্তরে ক্ষুধা কিভাবে মানুষগুলোকে জাত ভুলিয়ে দিয়েছিল তার গল্প উঠে এসেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুরুষের অহং, হিল্লা বিয়ে এই ব্যাপারগুলো কিভাবে অশান্তি আর রেষারেষিই বাড়িয়েছে তা হুমায়ূন দেখিয়েছেন নিজ ভঙ্গিমায়। তার ‘একাত্তর’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ বা আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, শহীদুল জহিরের ‘কাঁটা’তেও এসেছে যুদ্ধ প্রেক্ষিত।
এসেছে প্রাচীন ‘মহাভারত’ ও ‘কারবালার প্রান্তর’-এ যুদ্ধ। মহাভারতের জন্মান্ধ ক্ষত্রিয় রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও কারবালার দামেস্ক রাজা মোয়াবিয়ার পারসোনিলিটির মধ্যে একটা মিল রয়েছে সেটি কি আপনারা টের পেয়েছেন? পিতা ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধনের প্রতি স্নেহে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সংঘটনে পরোক্ষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পাণ্ডব পুত্রদের প্রতি তার সহানভূতি থাকলেও দ্বিতীয়বার দ্যুত ক্রীড়ায় ধৃতরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ছিল। যার ফলে পাণ্ডব ভ্রাতাদের বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস থাকা ছিল যেন নিয়তি। মুসলিম মিথে দামেস্কপতি মোয়াবিয়ার প্রাথমিকভাবে নিয়তি ভাঙার প্রবল চেষ্টা থাকলেও পরবর্তীকালে পুত্রের প্রতি অপত্যস্নেহ কারবালার যুদ্ধ সংঘটনে নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে। তবে তা কোনোভাবে ধৃতরাষ্ট্রের মতো প্রকট নয়। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের ক্ষেত্রে যুদ্ধ বিজয়ী পাণ্ডবদের স্থানে সৌজন্য সাক্ষাতকালে ভীমের লৌহমূর্তিকে ক্রোধবশত আলিঙ্গন করে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। ধৃতরাষ্ট্রের রাজপরিষদ বিদুর আর মোয়াবিয়ার প্রধানমন্ত্রী হামানের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মিথে তার ভূমিকা একইরকম ঐক্যরেখায় চিত্রিত। বিদুর দুর্যোধনের রাজপরিষদের আওতাভুক্ত হয়েও সবসময় পাণ্ডবদের পক্ষে কাজ করেছেন, অন্যদিকে মোয়াবিয়ার প্রধানমন্ত্রী হামান হাসান হোসেনের কোনো উপকার করতে না পারলেও মঙ্গল কামনা করেছেন। দুটি মিথেই রাজচক্রান্তের কাছে রাজ্যের দুই প্রধান পুরুষকে কোণঠাসা অবস্থায় আবদ্ধ দেখা যায়।
পুরাণের দুটি চরিত্র দুর্যোধন ও এজিদের যুদ্ধ কৌশল,সমরনীতি, সাহস, নিষ্ঠুরতা, রাজ্যলোভ আকাশ বিস্তারী। দুটি ভিন্ন পেক্ষাপট, ভিন্ন ভূখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও ভয়ংকর নৃশংস দুটি যুদ্ধ হওয়ার ফলে প্রধান দুই নেতার শেষ পরিণতিতে নান্দনিক ঐক্য রয়েছে। কারবালা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইমাম আবু হানিফা যখন এজিদকে মহাপরাক্রমে বধ নিমিত্ত তাড়া করছে তখন এজিদ প্রাণ ভয়ে অশ্ব ত্যাগ করে দামেস্কপুরীর বৃক্ষলতাপূর্ণ দুর্গম অংশে একটি অন্ধকার কূপে ঢুকে পড়েন। পুরাণবিদদের ধারণা রাজপ্রাসাদ আঙ্গিনায় ভূ-অভ্যন্তরে কোনো গুপ্তপুরী ছিল। কেননা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এজিদ পরিবার ও আত্মীয়দের উপস্থিতি দেখা যায়নি। ধারণা করা যেতে পারে তারা গুপ্তপুরীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এজিদ ইমাম হাসানের হাতে বধ্য নয় তাই অন্ধকার কূপে নিমজ্জনের মধ্য দিয়ে তার চরিত্র পরিণতি লাভ করেছে। লক্ষ করুন এখানে, এজিদের পলায়নচিত্রের সাথে কুরুক্ষেত্রের পরাজিত বলশালী দুর্যোধনের পলায়নচিত্রকে। কুরুক্ষেত্রে কৌরবসেনাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে দুর্যোধন অশ্ব ত্যাগ করে দেহে রক্তক্ষত আর চিহ্ন নিয়ে শুধুমাত্র গদা হস্তে দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে পালান। গদাটি যেন তার জেদ, বল আর তেজোদীপ্ততার চিহ্নচিত্র। দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের জলে প্রবেশ করে উপরিস্থিত সমস্ত জল জাদুবলে স্তম্ভিত করে দিলেন। এজিদের কূপে দুর্যোধনের হ্রদে নিমজ্জনের মধ্যে ঐক্য থাকলেও দুটি ঘটনা স্বকীয়তায় বৈচিত্র্যপূর্ণ।
ফোরাত পারে কারবালার প্রান্তরে হোসেনের কোলে এজিদ সৈন্য কর্তৃক তীরবিদ্ধ পিপাসার্ত শিশুপুত্র মহাভারতের অর্জুনপুত্র বালক অভিমন্যু বধের সমান্তরাল নিষ্ঠুর চিত্রকল্প হয়ে উঠে। হোসেনের আরেক পুত্র ওহাবকেও এজিদ সেনারা একত্রিত হয়ে চতুর্মুখী আক্রমণে শরাঘাতে হত্যা করে। হোসেন পিপাসায় মৃত প্রায় শিশুপুত্র নিয়ে ফোরাতের জল চাইতেই এজিদ সেনা হোসেনের বুক লক্ষ্য করে বাণ ক্ষেপন করে। নিক্ষিপ্ত বাণে শিশুপুত্র বিদীর্ণ হয়ে যায়।
কুরুপ্রান্তরে ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধে পাণ্ডব সেনাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিনষ্টির জন্য যখন যুধিষ্ঠিরকে হত্যার দায়িত্ব অর্পিত হলো দ্রোনাচার্যের ওপর, তখন সংশপ্তক ৮ সেনাগণ অর্জুনকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখল—যাতে যুধিষ্ঠির বধ বাধামুক্ত হয়। দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠির বধ নিমিত্ত চক্রবুহ্য রচনা করে মহাপরাক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন। আপাত অর্জুনবিহীন পাণ্ডব পক্ষ চক্রব্যুহ ভেদ করতে অভিমন্যুকে পাঠালেন। বালক অভিমন্যু চক্রব্যুহ ভেদ করার কৌশল জানলেও তা থেকে বের হবার কৌশল জানতেন না। ফলত অভিমন্যু চক্রের ভেতর দ্রোণ, দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি, জয়দ্রথ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে মারা যান। অভিমন্যুর মৃত্যুতে শোকার্ত অর্জুনের ‘হা পুত্র’ হাহাকার কুরুপ্রান্তর কাঁপায়। অনুরূপ চিত্রকল্প পাঠকদের স্মৃতি ও মনে কারবালার প্রান্তরে হোসেনের আর্তনাদের সমান ছবি হয়ে উঠে। পুত্র স্নেহের চিরন্তন ও শাশ্বত অনুভূতি জাতি-ধর্ম-কাল-ভূখণ্ড ভেদেও এক—হিন্দু ও মুসলিম দুটি পুরাণেই তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রে শরবিদ্ধ ভীষ্ম আর কারবালার পুরাণে শরবিদ্ধ দুলদুলের অভেদ চিত্রছবি পাঠকের মনে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, প্রেক্ষাপট, ভূগোলবর্তী হওয়া সত্ত্বেও নান্দনিক ঐক্যছবি তৈরি করে। কারবালার প্রান্তরে হোসেনের তীরবিদ্ধ অশ্ব দুলদুল প্রভুর শিরহীন দেহ নিয়ে ছুটে চলে হোসেন শিবিরে। এজিদ পক্ষের সৈন্য আবদুল্লাহ্ জেয়াদ, সীমার, অলিদ প্রমুখ চারপাশ থেকে শর নিক্ষেপ করছে—শ্রাবণ বৃষ্টির মতো অজস্র তীর দুলদুলের বুকে, পিঠে, গ্রীবার সমগ্র শরীরে বিদ্ধ হয়। শরবিদ্ধ চিত্রকল্পের সাথে ঐক্য থাকলেও শরবিদ্ধ ভীষ্মে সূর্যের উত্তরায়ণ অবস্থানে ইচ্ছামৃত্যু চরিত্রটিকে ভিন্নমাত্রা দান করেছে। ভীষ্ম স্বয়ং যুধিষ্ঠিরকে তার হত্যার কৌশল বলেছিলেন। নিরস্ত্র, ভূ-পতিত, ধর্ম ও ধ্বজবিহীন, পলায়মান, ভীত, শরণাপন্ন স্ত্রী, স্ত্রী নামধারী পুরুষ, বিকলেন্দ্রিয়, এক পুত্রের পিতা, অমঙ্গলসূচক ধ্বজধারী এবং নিচ জাতির সঙ্গে ভীষ্ম যুদ্ধ করেন না, তাই অর্জুন দ্রুপদ-পুত্র মহারথ শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মকে হত্যা করলেন। শিখণ্ডীর পশ্চাদে অর্জুন, ক্রমান্বয়ে ভীম, নকুল, সহদেব, ঘটোৎকচ, সাত্যকি, যুধিষ্ঠির, ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীষ্মের শরীরে এত তীর নিক্ষেপ করেছিল যে দুই অঙ্গলি পরিমাণও অবিদ্ধ ছিল না। ভীষ্ম শরাবৃত দেহ ভূমি থেকে শূন্যে সূর্যের উত্তরায়ণের অপেক্ষায় থাকল যুদ্ধ শেষ হওয়া অব্দি। শরবিদ্ধ দুলদুলের পরিণতি মুসলিম মীথে নাই—তাকে অসংখ্য তীর আর শরীর ভরা রক্তচিত্র নিয়ে হোসেন শিবিরে ফিরতে দেখা যায়। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ ব্যাস ব্রহ্মা কর্তৃক আদিষ্ট লেখক—যিনি আদি থেকে তার সময়কাল পর্যন্ত ধর্ম সংশ্লিষ্ট ঘটনার লিপিকার। আর অন্য পুরাণটি মুসলিম মিথ লিপিকারদের হাতে সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
কুরুক্ষেত্রের সমস্ত যুদ্ধের কার্যকারণও দেবতাদের তৈরিকৃত নিয়তি। কারবালার পুরাণেও নিয়তিই। কারবালা যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হলেও যুদ্ধ হওয়ার প্রধান বড় কারণ জয়নব নামের নারী চরিত্র। মহাভারতে দ্রৌপদীর অসম্মান ও বস্ত্রহরণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। একদিকে জয়নব অন্যদিকে দ্রৌপদী। দুই নারী। এক মুখ। ও আচ্ছা, আরেকটি মুখকে যুক্ত করা যায়, সেই মুখ হেলেনের। হেলেন ও নারী। তার জন্যেই ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল! মানে যুদ্ধের পৌরানিক গালগল্পে নারীমুখই যেন দায়ী ‘যুদ্ধ’র জন্য! কী পুরুষতান্ত্রিকভাবে দেখা। সেটিও যেন আমরা ভুলে না যাই।