বৌ কথা কও

, শিল্প-সাহিত্য

তানিয়া চক্রবর্তী | 2023-08-31 23:07:07

দেখবেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্যুদস্ত হয়ে মানুষের যখন ইচ্ছে হয় আরেক কোনো ব্যতিক্রম রূপ নিতে তখন প্রায়ই সে বলে আরজন্মে পাখি হতে চাই। পাখির জীবন আমাদের কাছে মুক্তির জীবন। বাতাসের মধ্যে স্বেচ্ছায় ডানায় ভর দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জীবনে আসলেই রূপকথার মতো। গাছে গাছে, শাখায়-শাখায়, ফুলের স্পর্শে সে এক সর্বকালীন নধর বেঁচে থাকা। তাদের নরম জীবনের মিহিন অনুভূতিতে পৃথিবীকে যেন কাকতালীয় লাগে। ভিন্ন শিস, ভিন্ন ডাক আর তার রং-রূপ আমাদের নিজেকে খুলে দেওয়ার বোধকে জাগিয়ে রাখে। জৈবিক ব্যবহারে সব জীব এক কিন্তু অনুভূতির বৈচিত্র ও তার প্রকাশেই কেউ কেউ এগিয়ে আসে, সে হিসেবে মানুষ খ্যাত। তবে পাখি কিছু কম যায় না, একটি ছোট ঘটনা বলি এ প্রসঙ্গে :

আমার মাসতুতো বোনের দুটি ফিঞ্চ পাখি ছিল। সে একটি সুদৃশ্য খাঁচায় প্রেমিক-প্রেমিকা ফিঞ্চকে রেখেছিল। যদিও খাঁচায় রাখা বিষয়টা সমর্থন করতে পারি না। এবং তার মধ্যে আরো একটি ছোট বেতের বোনা গোল বাসার মতো ঘর ছিল। কেননা স্ত্রী পাখিটির বাচ্চা হওয়ার সময় পুরুষ পাখিটি ঐ বেতের ঘরের মধ্যে খড় দিয়ে বিছানা বানায়। তো ঐ খাঁচায় যথাসময়ে আমার বোনটি শুকনো খড়, দানা ও জল রাখত। পুরো পাখির সংসার সেই খাঁচার বাইরে বসে দেখেছি। হঠাৎ দেখি কী, মেয়ে পাখিটি ঐ বেতের ঘরে ঢুকে গেছে, আর বেরোয় না। আর পুরুষ পাখিটি পুরো দমে খাঁচার ভেতরে জমা শুকনো খড় ঠোঁটে করে বেতের ঘরে জমা করে। মাঝে মাঝে একটু জল ও দানা খায়। এবার দেখা গেল মেয়ে পাখিটি বেশ মোটা হয়েছে, আর বেশ দুর্বল বোধ করি তার ডিম পাড়ার সময় হয়ে আসছিল। বাসা করার পরে ছেলে পাখিটি ঠেলে ঠেলে মেয়ে পাখিটিকে ঐ খড় দিয়ে বানানো বিছানার ওপর শুইয়ে দিলো। আর নিজেও তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সকালে উঠে আমি ও আমার বোন দেখি ছেলে পাখিটি আবার কাজ শুরু করেছে। মেয়ে পাখিটি নিথর। কিছুক্ষণ পরে আমরা বুঝলাম মেয়ে পাখিটি মরে গেছে। কিন্তু ছেলে পাখিটি কী এক সংসার বাঁধার আশায় ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে। এর পরে মরা পাখিটিকে বাসা থেকে বার করা হলে দেখা যায় ছেলে পাখিটি এক জায়গায় বসে থাকে। খায় না, কাজ করে না, শুধু এক কোনে চুপচাপ বসে থাকে। তাই বলি সভ্যতা মানুষ বানিয়েছে ঠিক কিন্তু তাদের ছাড়িয়েও সভ্যতার নিদর্শন এই পাখিরাই রাখতে পারে বোধ হয়।

পাখি যে একটা গ্রামীণ জীবনের কী সুখের জীব তা মানুষ জানে। পাখি, পাখিদের নাচ, সংসার এসব নিয়ে অনেক বই আছে, পারিবারিকভাবে আমি একটি বইয়ের খোঁজে আছি। বইটির নাম বাংলার পাখি, বইটি লিখেছিলেন আমার বড়দাদু মানে মায়ের ঠাকুরদা শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য। বইটি তৎকালীন বাংলায় খুব জনপ্রিয় বই। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী থেকে শুরু করে রবিঠাকুর সকলেই এই বই নিয়ে বড়দাদুকে চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠি আমি দেখেছি। কিন্তু এর দর্শন এখনো পাইনি। আসলে অবিভক্ত বাংলার এই বিশাল গাছ-গাছালি, ফল-ফুলের সমাহারে পাখিদের যে নিদারুণ আস্তানা হবে তা আর ভাবার বিষয় নয়। ইষ্টি কুটুম পাখি, বৌ কথা কও, পান্না কোকিল, কালোবুক বাবুই, ময়না, বুলবুলি, ফিঙে , টুনটুনি—এরা তো জ্যান্ত ফুল। ইষ্টি কুটুমকে হলদে পাখিও বলে বা কালো মাথা বেনেবউ বলেও ডাকা হয়। লালঠোঁট নীলতাউরা, মেটে তিতির, দেশি কানিবক এত যে এরেক রকমের পাখি তাদের ডাক জীবনযাত্রায় এত ব্যাপ্তি তাই তো পৃথিবী এত অপূর্ব। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর “টুনটুনির গল্প” বড় থেকে বুড়ো সকলের প্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ’র লেখায় বারবার পাখিদের কথা এসেছে, তারই প্রাবল্যে পটপরিবর্তনে পরিস্থিতির বদলও যেন পাঠক বুঝে গেছে। মিলনের জন্য কিছু কিছু পাখি অপূর্ব নৃত্যভঙ্গির মাধ্যমে জননের ক্রিয়াকে অব্যাহত রাখে। মনে করি (স্মৃতি থেকে বলছি) “ধন্যি মেয়ে” ছবিতে “বৌ কথা কও” পাখির ডাক নিয়ে এক নাটকীয় দৃশ্য ছিল। তারপর সলমন খানের ছবিতে যথা “ম্যাইনে প্যায়ার কিয়া”-তে পায়রার দৃশ্য তো ভোলাই যায় না। “কবুতর যা যা যা/ পেহেলে প্যায়ার কি পেহেলি চিঠঠি”—এই সেই জনপ্রিয় গান যার আকর্ষণের প্রাসঙ্গিকতায় পাখি। ওষুধ না দিলেও দেখবেন শরীরের এক নিজস্ব ক্রিয়া শরীরের ঘাঁ-কে প্রতিহত করে। তেমনই আমরা যদি জীবনের ছন্দ ভেঙেও দিতে চাই প্রকৃতি সেই ভাঙনকে আদর করে আটকে দেয়। তাই তো এই ফুল, ফল পাখির ব্যাপক সৃষ্টি।

জর্জ এলিয়ট বলেছেন “DELICIOUS AUTUMN! MY VERY SOUL IS WEDDED TO IT, AND IF I WERE A BIRD I WOULD FLY ABOUT THE EARTH SEEKING THE SUCCESSIVE AUTUMNS. বিশিষ্ট বহু লেখকদের লেখায় পাখির কথা আমরা পড়েছি। কবি কীটস বলেছেন “পাখিহীন জগৎ আসলে এক মৃত্যুর দেশ।” রবিঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ কার লেখায় পাখি নেই।

“বাইরে এবং বুকের মধ্যে হিয়ার ভেতর... হিয়ার মধ্যে হারানো এক হলদে পাখি উড়ছে বসছে দুলছে, যেন শৈশবে সেই দোলনা খেলা” এই পঙক্তি উল্লেখ করেছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়”—এইটুকু বাউলগানের শরীর জুড়ে পাখির কথা আর সেই পাখি এক এমন চিহ্ন যা দিয়ে কথা এক গভীর চিন্তায় পরিণত হয়।

আমাদের এই যে সভ্যতার হাঁড়িকুঁড়ি তার মূলে তো শব্দ...যার প্রারম্ভে আমার গলায় কেবল আওয়াজই ছিল। তাই তো এই পাখির ডাকে আমাদের প্রারম্ভিকতারা প্রতিফলিত হয়। ভোরের সংকেত তাদের ডাক। প্রকৃতির বিপর্যয়ে তাদের ডাক। আমাদের খাদ্য—আহ্লাদে তাদের খেলা, ওড়াওড়ি। সত্যি কী, পাখি না থাকলে আমরা প্রকৃতির ঘরকে এত আপন করে নিতে পারতাম না। সত্যজিৎ রায়ের এক অসাধারণ সিনেমা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে দেখা যায় সিনেমার যুব পুরুষটি একটিমাত্রে ডাকে উদাস হয়, সেই ছোটবেলায় ডাক দেওয়া সেই পাখি, সেই পাখির ডাক কখনো কোথাও সে পায় না। শেষে সিনেমায় দেখা যায় জীবনের একটি স্থিত মানিয়ে নেওয়া জায়গায় এসে সে যেন শৈশবের এক টুকরো অংশ ফিরে পায়—সেই পাখির ডাক। বাবুইয়ের বাসা, ঘুঘুর ফাঁদ, বসন্তবৌরির রূপ, ফিঙের শিস, ময়নার কথা, টিয়ার ঠোঁট, পেঁচার রহস্য, পায়রার চিঠি নেওয়া, ঈগলের চোখ, পানকাকের জলে ডুব, ময়ূরের নাচ, চড়ুইয়ের চিড়িক চিড়িক খাওয়া, টুনটুনির দুষ্টুমি, কোকিলের কুহু আরো কত কত কত। পাখিদের রাজ্যে আমরাই অনাগত… আমরা যেন গাছ না কাটি, গাছ শুধু গাছই নয়, ওদের ঐটুকু তো আশ্রয়। ভোরবেলার অ্যালার্মেরা বন্ধ হোক, মধ্যরাতের একা বাড়ি জেগে উঠুক, ফুলের গায়ে রঙ লাগুক, বসন্তে সে পলাশ ফুলে আসুক না মৌটুসিরা! এসব জ্যান্ত ফুলে আমাদেরই তো ফাগ লেগে আছে...

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর