বুয়েটকাল [কিস্তি ৪]

, শিল্প-সাহিত্য

শাকুর মজিদ | 2023-08-23 01:27:04

কিস্তি ৩. বুয়েটপরশ

মুরগী ধরার কাল

বুয়েট ক্যাম্পাসে পা রেখে প্রথম সপ্তাহেই বুঝে ফেলি, আমরা এক একজন রাজনীতি করা বড় বড় ভাইদের কাছে কত কদরের। একেবারে উপরের দিকে যারা আছেন, তারা মাঝের সারির ভাইদের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন, মুরগী ধরে আনার জন্য। এই মুরগীরা হচ্ছে ক্যাম্পাসে নতুন আগমনকারীরা। এমনিতে বুয়েটে যে সকল ছাত্ররা সুযোগ পায়, তারা প্রধানত: মেধাবী। এই মেধাবী ছাত্ররা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত কোনো দলের মিছিল মিটিংয়ে যেত না। মিছিলকারী, মিটিংকারীরা সেরাদের সেরা হতে পারে না। সুতরাং ধরেই নেওয়া হয় যে, এরা একদম ফ্রেশ, কোনোভাবে মাথাটা একটু খেয়ে ফেলতে পারলেই দলে নিয়ে নেওয়া যায়।

এই ক্ষেত্রে ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা আরেক ধাপ এগিয়ে। এদের ক্যাডেট জীবনে রাজনীতি করার কোনো সুযোগই ছিল না। হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, এসবের কথা তারা পত্রিকায় পড়ে মাত্র, তাদের ক্যাম্পাসে এসবের চল তারা দেখেনি। সুতরাং এইসব আনকোরা ছাত্ররা বড় ভাইদের খুব পছন্দের। আমি নিজেও মাঝে মাঝে নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে থাকি। বিভিন্ন হল থেকে বিভিন্ন ক্লাসের বড় ভাইরা আমার রুমে টোকা দেন। আমি বেরুতেই বলেন, আর্কিটেকচারের শাকুর মজিদ এই রুমে না?
বলি, আমি শাকুর।
ও, আচ্ছা। তোমার কত নাম শুনি। আলাপ নাই। তুমি নাকি সাংবাদিক ? লন্ডনের কাগজে তোমার লেখা বেরোয়।
আমি মাথা নাড়ি। বড় ভাই হ্যান্ডশেক করেন। তিনি হাত ছাড়েন না। বলেন, চলো।
কোথায় ভাই?
চলো ক্যান্টিনে বসি। নজরুল ইসলামে চলো, ডিম-খিচুড়ি খাই।
না, ভাই, আমার মেস কার্ড কাটা আছে। আমি ডাইনিংয়ে খাব।
তাইলে, কাল সাড়ে দশটায় সেন্ট্রাল ক্যাফেতে আসো।
আচ্ছা ভাই।
আমি কিন্তু তোমার জন্য দাঁড়ায়ে থাকব। আসবা তো?
চেষ্টা করব।
বড় ভাই ছাই হাতে ধরেছেন আমাকে। তার হাত থেকে কষ্টে ছাড়াই। কিন্তু আমি যে আরো বেশি পিছলা, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। পরদিন কেন, পরের এক সপ্তাহেই সেন্ট্রাল ক্যাফেতে আমি যাই না। সাড়ে দশটার টিফিন ব্রেকে বড়জোর আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টর পেছনে টিচার্স ক্যান্টিনের সামনের পিচঢালা পথের ওপর আমরা বসে চা সিঙাড়া খাই।

মাঝে মাঝে কোনো ভাই এসে বলেন, তোমাকে কোনো না কোনো দলের সাপোর্টে থাকতে হবে। কোন দল নিবা? জামাত—যারা যুদ্ধ অপরাধী? আওয়ামীলীগ—যারা জামাতের সাথে ট্যাগ করে? জাসদ—পৃথিবীর কোথাও সমাজতন্ত্র আছে? ইউনিয়ন করবা—ওটা তো লিপস্টিক পার্টি।
বুঝলাম, তিনি বিএনপি করেন।
আরেক ভাই একবার বলেন, বিএনপি? এটা কোন দল হলো? বন্দুকের ক্ষমতা নিয়ে এরা ক্ষমতায় এসেছে। এরা কিলার। বিচার ছাড়া কতগুলো আর্মিকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিছে জানো?
মজার ব্যাপার, ক্ষমতায় এরশাদ। কিন্তু এরশাদের কোনো ছাত্রদল বুয়েট ক্যাম্পাসে নাই। জাতীয় ছাত্রসমাজ একটা হয়েছিল, কিন্তু সেই দলের কোনো শাখা বুয়েটে নাই। বুয়েটে সবাই এরাশাদবিরোধী দল। আর এই বিরোধী দলের মধ্যে আলাদা আলাদা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্রলীগ আবার একসাথে বলে শেষ করা যায় না। ব্রাকেটে আরো দুটো অক্ষর লিখতে হয়। যারা এর সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। তাদের নামের আদ্যাক্ষর।
ক্যাম্পাসে সাজ সাজ রব। সাড়ে দশটায় টিফিন ব্রেক হলে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থেকে মিছিল বেরোয়। হুদাহুদি মিছিল। সবার এক কথা—
   জ্বালো, জ্বালো, আগুন জ্বালো।
   জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো।
   এরশাদের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে।
তবে মিছিলের প্রারম্ভিক আওয়াজ শুনে দল চেনা যায়। কেউ শুরু করে—জয় বাংলা দিয়ে, কেউ জিন্দাবাদ আর কেউ দুনিয়ার মজদুরকে এক করে।
একদিন এক স্টার লিডার আমাকে পাকড়াও করেন ডিপার্টমেন্টে এসে। নাম বলেন, মোজাম্মেল বাবু। এই নাম আমি ইতোমধ্যে শুনে ফেলেছি। তিনি কবিতা লেখেন। তার কবিতার বই আছে এবং সাদা রংঙের একটা প্রাইভেটকার তিনি চালান। তার গাড়িতে সুন্দরী তরুণীও দেখেছি।
তিনি হন্তদন্ত হয়ে বলেন, শাকুর মজিদ না তুমি?
জ্বী ভাই।
দুইদিন ধরে তোমাকে খুঁজতেছি।
তোমার রুমেও গিয়েছি। তুমি নাই। আজ পেলাম। তোমাকে দরকার আমার।
জ্বী ভাই। বলেন প্লিজ।
আমি একটা পত্রিকা বের করি। এটা এখন থেকে তোমরা বের করবা।
আমি মহা আনন্দিত হয়ে পড়ি। মোজাম্মেল বাবু আমাকে বলেন, আজ রাত দশটায় শহীদ স্মৃতি হলের অমুক রুমে আসো। রম্য’র সাথে কথা হয়েছে, রম্যও আসবে। তোমাদের সাথে আরেক কবির পরিচয় করিয়ে দিব, ওর নাম আনিসুল হক। তোমরা তিনজন মিলে এটা বের করবা।

এবার আমি নিজেই ধরা দেই। রাতেরবেলা রম্যকে নিয়ে হাজির হয়ে যাই। আনিসুল হক আছেন, খাজা শাহান নামে আরেকজন আছেন, তিনি এর প্রকাশক। পত্রিকাটা দেখি। এটা চার পাতার একটা ট্যাবলয়েট। কিছু কবিতা, কিছু জোকস, কিছু এরশাদবিরোধী লেখা। নাম—শিকড়। পত্রিকার দাম—দুই টাকা।

বলা হলো, আগামী সংখ্যা থেকে তোমার আর রম্য’র নাম ছাপা হবে সহকারী সম্পাদক হিসাবে। আর এই ৫০ কপি নিয়ে যাও। বিক্রি করে ১০০ টাকা এনে দিও। এই টাকা লাগবে পরের সপ্তাহের পত্রিকা বের করতে।

আমি পত্রিকা নিয়ে এসে বিক্রি করা শুরু করি। প্রথমেই পাশের রুমে যাই। তিনজন বড় ভাই আছেন। তিনজনের একজন আমাকে চেনেন। তিনি দুই টাকা দিয়ে একটা কেনেন। পাশের রুমের ভাইরা পত্রিকা হাতে নিয়েই বলেন—ও এটা তো মোজাম্মেল বাবুর? না, না, লাগবে না। আমি বলি, ভাই টাকা লাগবে না। এমনি রাখেন এক কপি। আমি এই পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক। সামনের সংখ্যায় আমার নাম ছাপা হবে এখানে।
বড় ভাই বলেন, তুমি বরং এক কপির টাকা নিয়ে যাও। এই পত্রিকা আমরা রাখি না।
কী বেড়াছেঁড়ার মধ্যে পড়লাম রে ভাই। আমি দুইদিন পর মোজাম্মেল বাবুর হাতে ৪০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলি এইগুলো বিক্রি হইছে। বাকিগুলো আমার কাছে আছে। তিনি টাকা রেখে বলেন, বাকিগুলো ফ্রি দিয়ে দাও।
আমি বলি, জ্বী ভাই। দিয়ে দিব।
আর শোন—।
জ্বী ভাই।
আজ রাত দশটায় আমরা মিছিল বের করব। তুমি কি একটি বারের জন্য আসবা? একবার এলেই হবে। আর লাগবে না।
আমি বলি ভাই দেখি।
রাত আমার টিউশনি থেকে ফিরতে ফিরতে এগারোটা বাজে। আমি আরো কিছু সময় রাস্তায় কাটিয়ে দেরিতে হলে ফিরি।

কিস্তি ৫. প্রাক বুয়েটের সাংবাদিককাল

এ সম্পর্কিত আরও খবর