কবিতা ভাইরাস

, শিল্প-সাহিত্য

মুম রহমান | 2023-08-25 06:28:16

হঠাৎ উত্তরার লোকজন অবাক হয়ে গেল। অবাক হওয়ার ঘটনা এ অঞ্চলে আর তেমন ঘটে না। খুন-খারাবি হয়, ধর্ষণ হয়। চুরি, ডাকাতি ছিনতাই প্রতিদিনই হয়। মানুষ আর অবাক হবে কিসে? আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকজন দেখল তাদের আশেপাশের দেয়ালে কী যেন লেখা! এ অঞ্চলের দেয়ালগুলো ধর্ষিত হয়ে গেছে অনেক আগেই। সিগারেট, কোক, সাবান, শ্যাম্পু, শিক্ষক দেই, কাজের বুয়া দেই—এমনি সব বিজ্ঞাপনে জর্জরিত ছিল তাদের দেয়াল। আজ সেইসব লেখা নেই। কে যেন একটা বিশাল ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে দেয়ালের সব বিজ্ঞাপন। এখন তাদের ঝকঝকে সাদা-লাল-কালো-হলুদ দেয়ালগুলোতে একলাইন-দুলাইন-চারলাইন করে নানা রকম লেখা দেখা যাচ্ছে। জসীমউদ্দীন রোডের মুখের ওপর যে বিরাট দেয়ালটা ছিল সেখানে নানা আড়ং আর ভড়ংয়ের বিজ্ঞাপন ছিল। সে দেয়ালটা পুরোটা কালো করে দেওয়া হয়েছে। নিরেট কালো রঙের ওপর লেখা—
   আয়না দেখে অবাক হয়ো না।
   ওটা তোমারই উল্টো দিক।
   নিজের উল্টো দিক অতো পছন্দ করো না
   মনে রেখো, অন্যেরাও সঠিক।
একটু এগিয়ে বিমানবন্দরের সামনের দেয়ালে লালের ওপর লেখা হয়েছে—
   তুমি ল্যাপটপ চালাও, আইফোন চালাও
   তোমাকে চালায় কে
   নিজেকে চালাতে না-জানলে কেমন নাবিক সে?
উত্তরার মেয়র সাহেব আর তার আশেপাশের ১৪টা বাড়িতে লাল-নীল-হলুদ করা হয়েছে দেয়ালগুলোকে। সবগুলো দেয়ালেই লেখা হয়েছে একই কথা—
   আমরা সবাই একেকটা ছোটগল্প
   শেষ হয়েও হই না শেষ
   কয়েক পাতার ভাঁজে গুঁজে
   জীবন কাটাই বেশ।
সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ে রবীন্দ্রসরণির মোড়টা। সেখানে বড় দেয়ালটায় হারপিক, মরটিন, ডেটল কত কিছুর বাহারি বিজ্ঞাপন ছিল। সেইসব বিজ্ঞাপন ঢেকে দেওয়া হয়েছে নীল রঙে। নীলের দুপাশে, উপরে নিচে হলুদ বর্ডার আর মাঝখানে লেখা আছে—
   রবীন্দ্রনাথ, আপনিই আমাদের মহাকাব্য।

ঘটনাটা অবশ্যই রহস্যময়। এটা কোনো গ্রাফিতি আর্টিস্টের কাজ না। গ্রাফিতির ঘরানার সাথে এর মিল কম। বিশেষজ্ঞরা এটাকে চিত্রকলা বা চারুকলার সাথে যোগ করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক যিনি একাধারে টিভি অনুষ্ঠান সঞ্চালক এবং এনজিও কর্মী, তিনি বললেন, এগুলো কবিতা। কেউ একজন কবিতা লিখে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা কখনোই একমত হতে পারেন না। কাজেই অন্য এক অধ্যাপক, যিনি বেশির ভাগ সময়ই দেশের বাইরে থাকেন, তিনি বললেন, এগুলো কবিতা, আমি দেশের বাইরে অনেক জায়গায় দেয়ালে কবিতা লিখতে দেখেছি। এক অনলাইন পত্রিকা বলল, এগুলো এলিয়েনদের কাজ। কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না রাতারাতি এতগুলো আর এত বিশালসব দেয়ালগুলো রঙ করা। শুধু কি রঙ করা? তার ওপর কবিতা লিখে দেয়াও সহজ নয়। হয়তো কাল রাতে স্পেশসিপ নেমেছিল উত্তরাতে। কিন্তু এয়াপোর্টের রাডারে কিছু ধরা পড়েনি। হয় রাডার নষ্ট, কিংবা রাডার কর্মীরা ঘুমাচ্ছিলেন। এই কথায় অবশ্য এভিয়েশনের দায়িত্ববান কর্মীরা হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এইসব হাবিজাবি অনলাইন পত্রিকা আদতে রাষ্ট্রীয় জঞ্জাল, এরা মিডিয়া আবর্জনা।

মানুষের আলোচনা চলতেই লাগল। কিন্তু কোন সমাধান হলো না। উত্তরা থানার পুলিশের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রত্যেক রোডের পাহারাদারকে পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু তদন্তে কিছুই বেরিয়ে এলো না। কে বা কারা এসব লিখে গেছে জানা গেল না। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো ক্ষেপে গেল। তারা বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোকে চাপ দিতে লাগল দ্রুত এইসব মুছে আবার তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। বিজ্ঞাপন কোম্পানি বলল এতে আলাদা খরচ দিতে হবে। তারা তাদের কাজ করেছে, অন্য কেউ নষ্ট করে করে গেলে সে দায়িত্ব তারা নেবে না। তবে ক্লায়েন্টর সেবায় তারা নিয়োজিত, ক্লায়েন্টের অসুবিধা তাদেরই অসুবিধা। এটা তারা দ্রুত ঠিক করে দেবে। ওইসব দেয়ালে শীঘ্রই নতুন করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। কয়েক হাজার ফুট দেয়াল আবার পুনরুদ্ধার করতে হবে। ব্যাপারটি অসাধ্য নয়, তবে ব্যয় সাপেক্ষ। ক্লায়েন্ট টাকা দিলেই তারা ব্যাঙ্কক থেকে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসবে।

পুরো ব্যাপারটি নিয়ে যখন ব্যাপক হইচই চলছে তখন আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে গেল। এবার উত্তরায় নয়, ঘটনা ঘটল শ্যামলীতে। এক শুক্রবারে শ্যামলীর সকল লোক দেখল তাদের খবরের কাগজে কোনো বিজ্ঞাপনই নেই। চতুর্থ পৃষ্ঠায় তিনকলাম দুই ইঞ্চি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন শ্যামলীর আজাদ সাহেব। তিনি সেন্টমার্টিনের একটি রিসোর্ট বিক্রি করতে চান। তার নির্ধারিত বিজ্ঞাপনের স্থলে ছাপা হলো—
   আর মানুষই হলো জীবন্ত সমুদ্র
   তুমি কী করে নেহাতই উপর থেকে দেখে
   তাকে চিনতে পারবে?
প্রথম পাতায় একটা ফোন কোম্পানি নতুন অফার ছেড়েছিল। রাত জেগে চারঘণ্টা কথা বললে ১৩ টাকা বোনাস পাওয়া যাবে। এই বিজ্ঞাপনটি ছিল একেবারে ৮ কলাম তিন ইঞ্চি জুড়ে। লাখ টাকার এই বিজ্ঞাপনের স্থানে ছাপা হয়েছে—
   রাত্রি গভীর হলে কথারা অমূল্য হয়
   কথায় কথায় গভীরতর হয় পরিণয়।
মজার ব্যাপার হলো, এই ঘটনাটা শুধু শ্যামলীতেই ঘটেছে। দেশের অন্য সব এলাকার খবরের কাগজগুলো যা ছিল তাই রয়ে গেল। ফলে যত দোষ গিয়ে পড়ল খবরের কাগজের লোকাল এজেন্টের ওপরে, এজেন্টরা ধরল হকারকে। কিন্তু খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের জায়গায় কেইবা এসব লিখে দেবে? কখন লিখবে? ব্যাপারটা ক্রমশ ভৌতিক মনে হতে লাগল।

জনৈক টকশোবাজ, পত্রিকায় সম্পাদক, গলা ফাটিয়ে বললেন, এটা একটা প্রতিবাদ। কর্পোরেট বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে মানুষ। তাকে মূর্খ বলে গালি দিলেন একজন প্রাক্তন লেখক। এ লেখক অনেক ভ্রমণকাহিনী লিখেছে, যার একটা নামও কেউ জানে না। তবু সে বলল, এগুলো আসলে কবিতা। আমি লেখক হিসাবে বলছি, কোনো কবি আসলে লাইম লাইটে আসতে চাচ্ছেন। কবিতা প্রচারের এ এক অভিনব পন্থা। রাজনীতিবিদ বললেন, হাস্যকর কথা বলবেন না। কবিতা কি গরু ছাগলে লেখে? কবিতা মানুষই লেখে। আর মানুষ নাম চায়। এগুলো যদি কবিতাই হয়, কবিটা কে? কবি তার নাম ছাড়া কেন কবিতা লিখবে?

রেডিও, টিভি, পত্রিকায় চলতে থাকল আলোচনার পর আলোচনা। তারচেয়েও বেশি আলোচনা চলল ফেসবুকে। সেখানে নানা মুনি নানা মত দিতে লাগলেন। তাদের সবার মতই বিরাট গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ এই সুযোগে ফেসবুক সেলিব্রেটিও হয়ে গেল।

অন্যের সুযোগ বাড়াতেই কিনা কে জানে এবার ঘটনা ঘটল চট্টগ্রাম আর সিলেটে। পরপর চারদিন এই দুই শহরে ঘটনার শিকার হলো গাড়ি। আপনারা জানেন গাড়ির সামনের কাচে একটা উইন্ডো ওয়াইপার থাকে। এটা বৃষ্টির পানি সরাতে সহায়তা করে। শ্রীহট্ট আর চট্টগ্রামের কয়েক হাজার গাড়িতে ছোট একটা কাগজের টুকরা পাওয়া গেল। সেইসব কাগজের টুকরায় নানা লাইন লেখা। আরজু সাহেবের গাড়ির উইন্ড শিল্ডে পাওয়া গেল—
   কোনো কিছু খোঁজার দরকার নেই
   বরং তুমিই হারিয়ে যাও
   বাকিরা খুঁজে নেবে তোমাকে।
আরজু সাহেব মুগ্ধ হয়ে লাইনগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি তুলনামূলক সাহিত্যের লোক। দীর্ঘদিন ধরে পড়ালেখা করছেন। তার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন। এমন মোক্ষম কথা তার গাড়ির কাচের সামনে ছোট্ট নোটের মতো করে কে লিখে গেল! সিলেটের পাথর ব্যবসায়ী গোলাম ফেরদৌসের গাড়িতে পাওয়া গেল—
   পাথরের কান্না শুনেছো কখনো?
   তোমার বুকের গহনে পাথর
   টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙে
   তুমি পাথরকে নিরাময় দাও।
বলতে গেলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এই রকম হাজার হাজার লাইন পাওয়া গেল। এক প্রকাশক এগুলোকে সংরক্ষণ করতে শুরু করলেন। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর বই বিক্রির হার কমে গেছে। তিনি এইগুলো ছেপে বইয়ের রমরমা ব্যবসাটা আবার চালু করতে চাইলেন। তিনি বইয়ের নাম দিলেন, ‘প্রেরিত কবিতা’, কবির নাম দিলেন, ‘অচেনা আগুন্তুক’। প্রথম দিনেই তার বইয়ের প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠন আপত্তি তুলল বইয়ের নাম নিয়ে। ‘প্রেরিত’ শব্দটি নিয়ে তাদের আপত্তি। প্রেরিত যে কোনো কিছু একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে নির্বাচিত মানুষের মাধ্যমে আসতে হবে। প্রকাশক ক্ষমা চাইলেন। বইয়ের নাম পাল্টে রাখা হলো, ‘ভিন মানুষের কবিতা’। নাম বদলে বইয়ের বিক্রি আরো বেড়ে গেল। প্রকাশক নতুন গাড়ি কিনে ফেললেন, ফ্লাট বুকিং দিলেন।

কিন্তু মানুষের চমকানো শেষ হলো না। এবার দেখা গেল, টেলিভিশন চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে চলে এলো কবিতা। নানা চ্যানেলে প্রচার হতে লাগল কবিতার মতো লাইন ব্রেকিং নিউজের আকারে।
এক নিউজ চ্যানেলে স্ক্রল হতে লাগল—
   হাত বুলাতে পারিস
   যদি দুঃখের গায়ে
   মাথা রাখিস তবে
   সখী এক বালিশে—
   সুখের আত্মায় ফুঁ দিস
   জল দিস আমার গেলাসে।
চ্যানেলের মালিক হতভম্ব। সাথে সাথে চিফ এডিটরের চাকরি চলে গেল। নোটিশ খেলেন আরো চারপাঁচজন। কেউ কিছু জানে না কিন্তু কী করে প্রচার হলো এসব লাইন! আরেক বিনোদন চ্যানেলে স্ক্রল হতে লাগল—
   তুমিই তো অসুখ
   তুমিই তো ওষুধ
   তুমিই প্রকৃতি
   আর তুমিই আড়াল
   তুমি তো আবছায়া
   তুমি ছিনিমিনি।
লাইনগুলো যে খারাপ তা নয়। এইসব লাইন যে ক্ষতিকর বা বিষাক্ত তাও নয়। কিন্তু কোথায়, কখন কিভাবে এগুলো আসছে কেউ বলতে পারছে না। উৎস আর কারণ খুঁজতে না পাওয়ায় সবারই অস্বস্তি হতে লাগল। মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যেই এক বিশেষ চ্যানেলকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, এর কারণ খুঁজতে না-পারলে চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হবে।

সবার মধ্যেই এক ধরনের উত্তেজনা, আবেগ কাজ করছে। একদিন দেখা গেল বেশ কিছু পুরুষের মানিব্যাগে কবিতা পাওয়া গেছে। অথচ তাদের মানিব্যাগে কোনো টাকা নেই।

ড. আশরাফুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে একজন তরুণ গবেষক অবশেষে ঘোষণা দিলেন, এটা একটা নতুন রোগ। এর নাম কবিতা ভাইরাস। এই রোগ যাদের হয় তারা নিজেরাও জানে না তারা কখন কবিতা লেখে এবং কখন সেটাকে প্রচার করে। রোগী আর সবার মতো সুস্থ আচরণ করে এবং সমাজে স্বাভাবিকভাবে থাকতে চায়, তাই নিজেদের নাম প্রকাশ করে না।

এই থিওরি নিয়েও নানা মুনি নানা মত দিতে থাকল কলামে, টকশোতে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়, একদিন মতিঝিল শাপলা চত্বরের মোড়ে দেখা গেল এক পাগল একটা বড় পুতুল জোগাড় করে এনেছে। সে পুতুলটাকে ধর্ষণ করল তারপর একটা প্লাস্টিকের ছুরি (প্লেনে যেমন দেওয়া হয় মাখন মাখাতে) পুতুলটাকে মারতে লাগল। লোকজন ছুটে আসলো। পাগলকে থানায় নেওয়া হলো। সে স্বীকার করল, তার ভালো লাগে না কিছু, শহরে ধর্ষণ হয় না, খুনাখুনি হয় না, সবাই ছাই কবিতা নিয়ে কথা বলছে, এইটা তার ভালো লাগে না। সে চায় কবিতা ভাইরাস দূর হোক।

মিথ্যা বলব না, অনেকেই পাগলের মুক্তি নিয়ে আন্দোলন করল, মানসিক রোগীর মানবিক অধিকার নিয়ে কথা বলল। পাগল মুক্তি পেয়ে গেল। তার পিছনে একদল লোক সব সময় হাঁটতে লাগল। হাঁটা বাবা ও তার দলবল কবিতার ভাইরাস থেকে সবাইকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগল।

শহরে আবার একটা দুটা করে খুন খারাবি ও ধর্ষণ শুরু হলো।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর