নিজের মত প্রকাশ করে সক্রেটিসকে পান করতে হয়েছিল হেমলক, রাশিয়ায় বরিস পাস্তেরনাকসহ অনেক লেখককে হতে হয়েছিল নির্বাসিত, হুমায়ুন আজাদ হয়েছিলেন হামলার শিকার, তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার হয়েছেন নির্বাসিত। এমন অজস্র উদাহরণ দুনিয়া জুড়ে। কথা হচ্ছে ‘কতটুকু স্বাধীনতা আপনি পেতে চান?’ এ প্রশ্ন ছিল ডিডোডাসের—প্লেটোর কাছে। প্লেটো উত্তরে বলেছিলেন, “যতটুকুর দায় মানুষকে ভালোবেসে নেওয়া যায় ততটুকু।”
কিন্তু তার উত্তরে আমরা পরিষ্কার নই ‘দায়’টা কতটুকু? আর ‘ভালোবাসাবোধ’ তো ব্যক্তি, মতাদর্শ বিশেষে আলাদা। ঢাকা শহরে কি চাইব পূজা বেদির মতো নেকেড হয়ে কোনো সুস্থ মানুষ হেঁটে যাক? এ বিষয়ে উত্তর খোঁজার আগে দেখা দরকার ঠিক এখন বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেমন? দেখা যাচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ইউরোপের দেশ জার্মানিতে লেখকদের স্বাধীনতাই ‘হুমকির’ মুখে। কখনো সরাসরি, কখনো সামাজিক মাধ্যমে আক্রমণ ও হুমকির ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনেক কিছু লিখতেও ভয় পাচ্ছেন লেখকরা।
২০১৮ সালে জার্মানির পেন সেন্টার এক গবেষণায় প্রকাশ করেছে এমন ‘ভয়াবহ’ তথ্য।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করা পেন ইন্টারন্যাশনালের সদস্য জার্মানির পেন সেন্টার। ‘ফ্রি স্পিচ আন্ডার প্রেশার’ বা ‘চাপের মুখে মতপ্রকাশ’ শীর্ষক এই গবেষণায় সহযোগী ছিল উত্তরপূর্ব জার্মানির রোস্টোক ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর মিডিয়া রিসার্চ। গবেষকদের দাবি, এটিই জার্মানিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে করা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গবেষণা। গবেষণার আগে এক জরিপের মাধ্যমে লেখকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। শুধু জার্মান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদেরই এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ তাদের কাছে অনলাইনে একটি ফরম পাঠানো হয়, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে তারা তাদের অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা ও কিভাবে এমন ঘটনা তাদের কাজকে প্রভাবিত করেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
কোন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন বা পরাধীন, তা মূল্যায়ন করে প্রকাশিত এ বার্ষিক প্রতিবেদনে তুরস্ককে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় জেল’ হিসেবে। ২০১৬ সালের কথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে সে দেশে অনেক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে এরদোয়ান সরকার। প্রতিবেদনে তুরস্ক আছে ১৫৭ নম্বরে।
৫২৬ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে প্রতি চার জনে তিন জন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ৬০ শতাংশ লেখক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাঁদের লেখার স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন।
প্রতি দুইজনে একজন নিজের বা বন্ধুদের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ৩১ শতাংশ করা হয়েছে সরাসরি মৌখিকভাবে৷ অবশ্য শারীরিক সহিংসতার কথা বলেছেন কেবল ২ শতাংশ লেখক।
জার্মান পেনের মহাসচিব কার্লোস কলাডো সাইডেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, “একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে এমন ফল ভয়াবহ।” তারমানে রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ তার স্বার্থে আঘাত লাগলেই টেনে ধরবে আপনার টুটি। তাহলে সক্রেটিসের হেমলক পানের সমাজ থেকে আমরা কতদূর এগুলাম? একসময় গ্রিসীয়রা মনে করতেন, কবি ও কবিতা একটা দৈবসত্তা এবং তা সব কিছুর ঊর্ধ্বে—যা ছিল প্লেটোর স্বাধীন চিন্তার বিরোধী। একজন স্বাধীন চিন্তার মানুষের কাছে কোনো কিছুই যুক্তি-তর্কের উপরে নয়। প্লেটো নিশ্চয়ই স্বীকার করতে চাইবেন না যে, কবির কোনো কবিতা আলোচনা সাপেক্ষ নয়। এবং সেটিই শেষ কথা। গ্রিক মহান কবি হোমার নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ কবি। কিন্তু তাই বলে তার কবিতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে এমন ভাবা প্লেটোর পক্ষে সঙ্গত ছিল না। তাই তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন দার্শনিক রাজাকে। যিনি একদিকে হবেন প্রচুর জ্ঞানী অন্যদিকে হবেন প্রখর নেতা। প্লেটো মনে করতেন, স্বাধীনতা যেন স্বেচ্ছাচারিতার রূপ না নেয়। কিন্তু তিনিও স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প
তার অনেক অনেক পরে নাইজেরিয়ায় ১৯৫৯ সালে জন্ম নেওয়া বুকার পুরস্কার পাওয়া বেন ওকরি নতুনভাবে প্রশ্ন তুলেছেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে। তিনি মূলত উত্তারধুনিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের শক্তিশালী লেখক হিসেবে সারা দুনিয়াতেই ব্যাপক পরিচিত। তিনি বলছেন, নিঃশর্ত স্বাধীনতা ছাড়া একটি রাষ্ট্রের জনগণ ভালো বা পরিপূর্ণ হতে পারে না। এটি ব্যতীত সাহিত্যও ভালো হতে পারে না। সাহিত্যের পূর্বশর্ত হলো স্বাধীনতা। জন বেভেরলি রবিনসনের বক্তব্যও তাই। মাত্র দেড় পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ আছে তাঁর। প্রবন্ধটা লিখেছিলেন ১৮৯৪ সালে। নাম ‘হোয়াট ইজ ফ্রিডম?’ এ প্রবন্ধ পড়ে ভেবেছি এত আগে জন্মানো মানুষ এত দূরের চিন্তা কিভাবে করেছিলেন। রবিনসনের জন্ম ১৮৫৩ সালে এবং মারা যান ১৯২৩ সালে। তিনি একজন individualist anarchist লেখক। লেখক freedom এবং liberty দুটো শব্দ বারেবারে ব্যবহার করছিলেন। ফলে অনুবাদের সময় যাতে বিভ্রান্তি তৈয়ার না হয় করা হয় সেজন্যে ‘স্বাধীনতা’ই রাখা হলো।
হোয়াট ইজ ফ্রিডম (মূল প্রবন্ধ)
‘আপনার কি মনে হয় স্বাধীনতা সবার জন্যে মঙ্গলজনক?’ এক মেধাবী নারী আমার কাছে জানতে চাইলেন ‘লাগামহীন ক্ষমতার নানা উদাহরণ যদি ধরুন, যেমন রোমান সম্রাটেরা, তাদের তো নিশ্চয়ই স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু, সেটা থাকা কি ভালো ছিল?’তাই স্বাধীনতার সম্পূর্ণ ধারণা মনে জায়গা করে নেয়ার আগে মানুষ তা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যে চুরি করে সে কি স্বাধীন নয়? যে বউ পিটায়, সে কি স্বাধীন নয়?
এসময় আমরাও পাল্টা জানতে চাই, ‘যখন রোমান সম্রাটরা শাসন করেছিলেন, তারা হয়তোবা স্বাধীন ছিলেন, কিন্তু, শাসিতরা কি স্বাধীন ছিল? চোর হয়তোবা স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু যাকে চুরি করছে সে যে নিগৃহীত হচ্ছে তাতে তো কোন সন্দেহ নাই। যে তার বউকে পেটাচ্ছে, সে হয়তোবা তার শারীরিক শক্তির জোরে বউ পিটাতে স্বাধীন, কিন্তু বউ কি স্বাধীন? স্বাধীনতা মানে আরেকজনের মাথায় মুগুর মারার স্বাধীনতা নয়।’
বুঝলাম এখানেও আপনার আপত্তি রয়েছে। আপনি হয়তোবা বললেন, ‘ধরুন, দুজন ব্যক্তি একই কাজ করতে চায়, এক্ষেত্রে তারা সমঝোতায় আসবে কিভাবে? মনে করুন, আমি একটা নির্দিষ্ট জমিতে একটা বাড়ি তৈরি করতে চাই এবং অন্য আরেকজনও একই জমিতে তার বাড়ি তৈরি করতে চায়। এক্ষেত্রে কিভাবে আমরা দুজনেই নিজেদের খুশিমতো কাজ করার স্বাধীনতা পেতে পারি?’
এ প্রশ্নের জবাব হলো, ‘সকলের স্বাধীনতাই যৌক্তিক এই রীতি যদি আমরা মেনে নেই, তাহলে যে ঘটনাগুলো অন্যের স্বাধীনতা চর্চার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে, সেগুলোর সমাধান খুব সহজেই হয়ে যাবে। একই জমি নিয়ে সমস্যাটা সমাধান এভাবে করা যায় যিনি আগে দাবি করবেন তিনি ওই জমিতে বাড়ি বানাতে পারবেন।’
ধরেন, রাস্তায় হাঁটার স্বাধীনতা সবারই আছে, কিন্তু এর মানে এই না যে একে অন্যের গায়ে এসে পড়তে হবে।কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সাংঘর্ষিক কর্ম ও একে অন্যকে দখল করার মতো ঘটনা ব্যতীত যখন আমরা সবার জন্যেই স্বাধীনতা এই নীতি পরিত্যাগ করি; সে স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়, কেউ না কেউ কাউকে না কাউকে দমন করবেই। এই দমন প্রক্রিয়ারও কোনো সীমানা নাই। যে ঘটনায় কর্মের সাথে কর্মের সংঘর্ষ হয় সেটা হতে শুরু করে একেবারে যেখানে সংঘর্ষ দূরে থাক, সবার সম্মতি আছে এমন ঘটনা পর্যন্তও সে (দমন প্রক্রিয়া) নিজেকে প্রসারিত করে থাকে। রোববারের আইন (Sunday laws), অন্যান্য দিনে স্বাধীনভাবেই যা কেনা যায় তা সপ্তাহের একদিন কিনতে নিষিদ্ধ করা, স্পষ্টতই জঘন্য। কেনাকাটার কর্ম যেখানে সপ্তাহের ছয়দিন অন্য কারো স্বাধীনতায় বাধা দেয় না, সেখানে সপ্তম দিন এটা বাধা দেবে তা চিন্তা করাই নির্বুদ্ধিতা। এই আইনগুলো প্রণীত হয় যারা এটাকে সমর্থন করে তাদের স্বাধীনতার জন্যে নয়, বরং, এই জন্যে যে তারা অন্যের ওপর তাদের চিন্তা ও কর্ম চাপিয়ে দিতে চায়, এবং সেটা অন্যদের স্বাধীনতার বিনিময়েই। তারা চান, এবং আমাদের প্রত্যেক আইন-প্রণেতারাই চান, সবার ওপর কিছু নির্দিষ্ট কর্ম চাপিয়ে দিতে, কারণ এগুলো ধর্ম অথবা প্রথা অথবা কুসংস্কার দ্বারা অনুমোদিত। প্রকৃতপক্ষে, এই হোয়াইট ক্যাপরা সাধারণত কমিউনিটিতে সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, চার্চ ও রাষ্ট্রের স্তম্ভ।
একটা সময় ছিল যখন স্বাধীনতা বরাদ্দ ছিল মাত্র এক ব্যক্তির জন্যে, যার কাছে সবাই ছিল স্বেচ্ছাদাস। কিন্তু এখন ভিন্ন পরিস্থিতি। প্রচুর লোকের হাতে ক্ষমতা আছে এবং তা ব্যবহার করাও তারা শিখছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের থেকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সবাইকে তাগাদা দেওয়ার প্রয়োজন আর এখন নেই। বরং, আমাদের এখন এই প্রেরণা দিতে হবে যে, স্বাধীনতা মানে নিজের স্বাধীনতা চর্চার পাশাপাশি অন্যকে স্বাধীন হতে দেওয়া। তবে এর বিপরীতে দাসত্বের মনোভাব যা আমরা অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, যা অন্যকে আমাদের পথে চলতে বাধ্য করে, তার ওপরেই বর্তমানের শাসন-ক্ষমতা নির্ভর করে। যারা মনে করে তা দিয়ে শাসন করবে তারা আসলে নিজেরাই দাসত্বকে কবুল করে।
এটা সত্য যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা আছে, কিন্তু এর অন্ধ ব্যবহার সবসময়ই ব্যবহারকারীকে পাল্টা আঘাত করবে। এবং সেটা করবে অর্থনৈতিক দাসত্বের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনের মাধ্যমে যা কিনা শাসক ও শাসিতকে সমানভাবেই পেষণ করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠকে বুঝতে হবে যে, যা আমরা বোঝাতে চাচ্ছি একমাত্র স্বাধীনতা রক্ষার কাজে ক্ষমতাকে ব্যবহার করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ও যথার্থ।
এরমানে স্বাধীনতাকে কিভাবে আদায় করে নিতে হবে এটা বোঝা যায়। আরেকটি দিক রয়েছে সেটি হলো রাজনীতিকে বোঝার জন্যও লেখকদের স্বাধীনতা জরুরি। যেমন ধরুন আমরা জীবনানন্দ পড়ি ঘোরগ্রস্ত হওয়ার জন্যে। ফ্লাবার্ট পড়ি সৌন্দর্যের জন্য, জেমস জয়েস পড়ি হাওয়া ও আগুনের ভাষা বোঝার জন্য, কোয়েলহো পড়ি শিকার বোঝার জন্যে, পড়ি জেন অস্টেন তার মনস্তত্ত্বের জন্য। কিন্তু কালো এবং আফ্রিকান লেখকদের মাঝে কি পাই? পাই সেখানকার দাসত্ব, উপনিবেশিকতা, দারিদ্র্য, গৃহযুদ্ধ, বন্দিদশা, নারী হেনস্থা—এসব বোঝার জন্যে।
বেন ওকরি বলছেন, ‘দ্য ওয়ে টু ফ্রিডম’ প্রবন্ধে, “জেমস জয়েসের ‘দ্য ডেড’ মূলত একটি পার্টিকে ঘিরে রচিত যেটি এক শীতের রাতে ডাবলিন শহরের একটি পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়। সেই পার্টিতে লোকজন কথা বলে, মিউজিক বাজতে থাকে এবং একজন মহিলা একজন তরুণের কথা স্মরণ করে যে বহু বছর আগে তার বিরহে মৃত্যুবরণ করে। আইরিশদের দুর্ভিক্ষ, আইরিশ জাতীয়তাবাদ অথবা সম্ভাব্য কোনো বিষয় এখানে বিষয়বস্তু নয়। মূল বিষয় হলো স্মৃতি, মিউজিক অথবা আয়ারল্যান্ডে তুষারপাত। গল্পের তাৎপর্য হলো মানব হৃদয়ের পরোক্ষ প্রকাশ, এবং হৃদয়ভঙ্গের কোনো গল্প, ছলাকলার কাহিনী এবং কোনো সুদৃশ্য সংক্ষেপে বর্ণনা করা। যদি তিনি আইরিশদের দুর্ভিক্ষ নিয়ে লিখতেন তাহলে তিনি আমাদেরকে ‘দ্য ডেড’র মতো কালোত্তীর্ণ একটি লেখা উপহার দিতে পারতেন না।
আমাদের সময়ে আমরা বিষয়বস্তুর প্রতি অন্ধ হয়ে আছি কেননা আমরা শিল্পের সত্যিকারের তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছি। যদি একটি উপন্যাস দাস ব্যবস্থা নিয়ে রচিত হয়, আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে করি এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একজন ছোকরা যে কিনা অত্যধিক পাম ওয়াইন পান করে তার থেকেও অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কালো এবং আফ্রিকান ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা বিয়োগান্তর ( tragedies), অবিচার এবং নিরন্তর সংগ্রামের ঘটনাগুলো প্রকাশ করার জন্য আফ্রিকান লেখকদের মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর এটি অন্যান্য সাহিত্যের তুলনায় এই আফ্রিকান সাহিত্যকে অনেক বেশি কমিটেড বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তোলে। এই কারণে হয়তো এই সাহিত্য কম বৈচিত্র্যপূর্ণ, কম উপভোগ্য এবং স্বাভাবিকভাবে কম টেকসই।”
মানে যারা পলিটিক্যাল ইতিহাস পড়ার কারণে আফ্রিকান সাহিত্য পড়বেন বলছেন তাদের উত্তরটা দিলেন বেন ওকরি।
উত্তর তো দিলেন না, খোঁচা মারলেন। বুঝেছেন তো, নাকি?
তিনি ওই প্রবন্ধে বলছেন, “আপনি লেখকের স্বাধীনতা চান? স্বাধীনতা পেলে কী করছেন? ধরুন আপনি শেক্সপিয়রের লেখা থেকে সাধারণ মানুষের কঠিন জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণাও করতে পারবেন না। তার নাটকগুলোতে আপনি কোথাও জানতে পারবেন না যে তার সময়ে লোকজন তাদের শৌচাগারের বালতিসমূহ জানালার বাইরে খালি করে রাখত এবং স্ট্রাটফোর্ড—আপন—এভন’র স্ট্রিটগুলো দুর্গন্ধে ভরে উঠত। তার সৃষ্টিকর্মগুলো স্থায়িত্ব লাভ করেছে। এই সাহিত্য অনবরত মানবাত্মাকে উদ্ভাসিত করে এবং মানব জগতের মহত্ত্ব এবং অদ্ভুতুড়ে বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের সজাগ করে।
আরো পড়ুন ➥ সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা
এখানে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো Cervantes দাসত্ব সম্পর্কে জানতেন, মুরদের নির্বাসন সম্পর্কে জানতেন। তিনি লেপান্টের যুদ্ধে তার হাত হারিয়েছিলেন। তিনি স্পেনের নিষ্ঠুর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন না। তারপরেও তিনি Don Quixote-এর তুলনায় আমাদের মানসপটে খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে পারেননি। Don Quixote এই উপন্যাসটি একজন মানুষকে ঘিরে যিনি অ্যাডভেঞ্চারের জীবন বেছে নেন।
হোমার একজন মানুষের অসন্তুষ্টি চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে ট্রয় নগরীর পতনের কাহিনী বলেছেন। সফোক্লিস একজন রাজার নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডের ইতিহাস বলেছেন। তারা গ্রিক ইতিহাসের ভয়ংকর ঘটনার গল্প বলেননি। তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’-এ একটি মহৎ বিষয়বস্তু আছে। তবে এটি তার অন্তর্দৃষ্টি এবং তাঁর লেখনী এই বিষয়বস্তুকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছে। পুশকিন রাশিয়ার ভয়ানক এবং অসাধারণ ইতিহাসে মগ্ন থাকতেন। তিনি বয়ারের উৎপীড়ন সম্পর্কে জানতেন। ইভান দ্য টেরিবলের দীর্ঘ ছায়া, কৃষকগোষ্ঠীর মানবেতর জীবনযাপন সম্পর্কে জানতেন। তিনি নির্বাসন সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। তারপরেও তার বিখ্যাত Eugene Onegin যাকে রাশিয়ান সাহিত্যের উৎস বলে বিবেচনা করা হয়, রচিত হয়েছে নির্লিপ্ত অভিজাতবর্গদের নিয়ে এবং তার ছোট গল্প The Queen of Spades, অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ছোট গল্প; সেটিরও মূল বিষয় ছিল জুয়া খেলা।
এরমানে সেল্ফ সেন্সরশিপ থাকাটাও উচিত একজন স্বাধীনতাকামী লেখকের জগতে।এখনো মনে হয় ভলতেয়ারের সেই কথাটা প্রাসঙ্গিক। সেই যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাহাতে তোমার মতো অবাধে বলিতে পার, তাহার জন্য আমি নিজের প্রাণ অবধি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।”
কিন্তু এখন আমরা যেন স্মরণে রাখি রবিনসনের সেই কথাও এক রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আপনার পা যেন আমি মাড়িয়ে না দিই। ব্যঙ্গ কবিতা রচনার মাধ্যমেই ভলতেয়ার সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ করেন। খ্রিস্টান গির্জা ও তৎকালীন ফরাসি সামাজিক আচার ছিল তার ব্যঙ্গবিদ্রুপের লক্ষ্য। ভলতেয়ার তার সাহিত্যজীবনে সর্বোচ্চ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন একজন গদ্যলেখক হিসেবে। ভলতেয়ারের সাহিত্যকর্মের মধ্যে দু হাজার গ্রন্থ এবং ২০ হাজার চিঠি রয়েছে। ভলতেয়ারের আসল নাম ফ্রাঙ্কো ম্যারিক এ্যারোয়েট। একসময় এ্যারোয়েট অজ্ঞাত কারনে ভলতেয়ার নাম গ্রহণ করেন।
পরবর্তী জীবনে ভলতেয়ার ইতালীয়, স্পেনীয় ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। নাগরিক স্বাধীনতা, বিশেষত ধর্মের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তার অবস্থান ছিল অটল। সে সময় ফ্রান্সের কঠোর সেন্সর আইন উপেক্ষা করে সামাজিক সংস্কারের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ভলতেয়ার।
তিনি বলেছেন যেখানে ‘অজ্ঞতা যত বেশি’ সেখানে ‘অসহিষ্ণুতা এবং নিষ্ঠুরতা তত বেশি’... এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাশক্তি বিকশিত না হওয়ার কারণেই সমাজে এইসব অন্যায় ঘটে থাকে। তিনি বলতেন শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞরাই অশুভ শক্তির পরিণতি সম্বন্ধে জানলে চলবে না, তাঁদের জানাতে হবে দেশের তরুণদের। তবেই তারা যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে একে প্রতিহত করতে পারবে।
ভলতেয়ার কারা অন্তরিন অবস্থায় মাত্র এগার মাসে ‘হেনরিয়ের্ডে’ নামে একটা মহাকাব্য রচনা করেন। কাব্যগ্রন্থটি পরর্বতীকালে তাঁকে প্রভূত খ্যাতি এনে দিয়েছিল। তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম বিবেচনা করা হয়। ১৭১৮ সালে ভলতেয়ার রচনা করেন ’ওয়েডিপে’ নামক এক ট্রাজিক নাটক। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের বিদগ্ধ সমাজ এই অসাধারণ কবিকে হোমার এবং ভার্জিলের সমকক্ষ বলে অভিনন্দিত করেছেন। তার মতোই ছিলেন ফ্রান্সের দেকার্ত।
১৫৯৬ সালের ৩১ মার্চ, ফ্রান্সের তোরাইন গ্রামে এক ধনাঢ্য পরিবারে রেনে দেকার্ত জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বর্তমান নাম তার সম্মানে ‘দেকার্ত’ রাখা হয়েছে।
ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত একটা নতুন দর্শন দিতে ব্যস্ত না হয়ে দর্শন নির্মাণের জন্য একটা পদ্ধতি বের করতেই আগে মন দেন। তাঁর এই শুরুর রচনার নাম ‘মেডিটেশন্স্ অন ফার্স্ট ফিলোসফি’। এর প্রথম কথাই হচ্ছে, সন্দেহ করো, অস্বীকার করো। তার লেখালেখি জগতে আসার গল্পটা বেশ মজার। জার্মানির নিউবার্গ শহরে তখন কনকনে শীত। শীতে কাঁপতে কাঁপতে এসে নিজের রুমে ঢুকলেন ২৩ বছরের যুবক রেনে দেকার্ত। লিখতে শুরু করলেন দেবতার বাতলে দেওয়া উপায়সমূহ। তিনটি বিষয়ের ওপর কাজ করবার উপায় বলেছেন দেবতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি আর দর্শন। সে রাতের প্রায় ১৮ বছর পর ১৬৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘ডিসকোর্স ডি লা মেথড’ (ডিসকাশন অব দ্য মেথড) এবং ‘লা জিওম্যাত্রি’ (জিওমেট্রি)। এই দুটি বই তাকে ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন দিয়েছে। দুটি বইয়ের মাঝেই তিনি উল্লেখ করেছেন ১০ নভেম্বরের সেই শীতের রাতের কথা।
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন
দেকার্ত মানুষের চিন্তা ও ধারণাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ১) সৃষ্ট ধারণা যা মানুষ ভেবে-চিন্তে তৈরি করে, ২) অস্থানিক ধারণা, যা ভাববার প্রয়োজন হয় না; যেমন, গরম পানি হাতে পড়লে তৎক্ষণাৎ গরম লাগার কথা চিন্তা করবে মানুষ এবং ৩) সহজাত চিন্তা যা মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এগুলো চাইলেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, মানুষ চাইলেই একটি ত্রিকোণ বস্তুকে চতুষ্কোণ বলে ভাবতে পারে না। অন্যদিকে দেকার্তের দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ‘ডুয়েলিজম’ বা দ্বৈতবাদ। এই তত্ত্বের প্রধান কথা হচ্ছে, আমাদের দেহ এবং মন সম্পূর্ণ পৃথক দুটি সত্তা। তাই দেকার্তে লেখকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেছেন, “স্বাধীনতা আপেক্ষিক। চূড়ান্ত স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। আর স্বাধীনতাকে বোঝার জন্য পরাধীনতাও অস্তিত্ব রয়েছে।” তিনি ভলতেয়ারের চেয়ে অন্য ঘরানার চিন্তা জগতে। তবে ভলতেয়ারের সঙ্গে মিল রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মন্টেস্কুর।
মন্টেস্কু তার বিখ্যাত ‘দ্য স্পিরিট অফ লজ’ (The Spirit of Laws)-এ রাজার দৈবস্বত্ব নীতির সমালোচনা করে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য আইন, শাসন ও বিচারবিভাগের পৃথকীকরণের কথা বলেন। মন্টেস্কুর আর-একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘দ্য পার্সিয়ান লেটারস’ (The Persian Letters)। এই বইয়ে তিনি বিপ্লব-পূর্ব ফরাসি সমাজব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন।
রানি মেরি অ্যান্টয়নেটের নিজস্ব সহচরীসংখ্যা ছিল ৫০০। রাজা, রানি, রাজকুমার ও রাজকুমারীদের প্রমোদভ্রমণের জন্য রাজদরবারে প্রায় দুই হাজার ঘোড়া ও ২০০ অশ্বশকট সব সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকত। এসব বিষয় ফরাসি জনগণের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। এতে রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়। অবস্থা এমন হয়েছিল যে ৫ অক্টোবর প্যারিস থেকে মহিলাদের ভুখামিছিল বা হাঙ্গার মার্চ অব দ্য ওমেন ভার্সাই রাজপ্রাসাদের কাছে পৌঁছে রুটির দাম কমানোর দাবি জানায়। তখন রানি মেরি অ্যান্টয়নেট অবাক হয়ে মিছিলের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, এরা কী চায়? তাঁর সহচরী উত্তর দেন, এরা রুটির দাম কমাতে বলছে, রুটি চায়। রানি অবাক হয়ে বললেন, রুটি কেন? এরা কেক খেতে পারে না! প্রকৃতপক্ষে রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে বিলাস ব্যসনে জীবনযাপন করে রানি অ্যান্টয়নেট নিজ দেশের সাধারণ মানুষের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে মন্টেস্কু বলেছেন, “বিক্ষোভ করা যেমন ন্যায্যত রানীর বিরুদ্ধে আবার রানীর প্রমোদ করারও পক্ষে আমি।”
কিন্তু ঠিক ভলতেয়ার, মন্টেস্কুর মতন এত উদার রেডিক্যাল না কবি আদোনিস। তার সাথে মিল রয়েছে বেন ওকরির। তারা স্বাধীনতা কারা হরণ কেন শোষকরা সে প্রশ্নও তুলেছেন। আদোনিসের জন্ম সিরিয়ায় ১৯৩০ সালে। জেল খেটেছেন। দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে প্রথমে লেবাননে পরে প্যারিসে বসবাস করছেন। তার সেরা কবিতার বইয়ের নাম ‘সংস অব মিহিয়ার অব দামাস্কাস’। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, “আগের আরব কবিরা ধর্মে আগ্রহী বা অনাগ্রহী যা-ই হয়ে হোন না কেন, ধর্মকে দেখেছেন খুবই ট্রিপিক্যালি। আরবের প্রখ্যাত কবি আবুল আলা ইমামি খুব সুন্দর করে বলেছিলেন, ‘মানুষ দুই রকমের। কারো ধর্ম আছে, যুক্তি নেই। কারো যুক্তি আছে, ধর্ম নেই।’ সংস অব মিহিয়ার-এ এই ধারণাটিকে আমি চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছি। পরম বিচারে তো ধর্ম ব্যক্তির একান্ত উপাদান। সমাজকে গড়ে উঠতে হবে মূল্যবোধ, মানবাধিকার আর স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে। তাই সাহিত্য করার জন্য স্বাধীনতা জরুরি। ইসলামি সংস্কৃতির ভেতরে আমরা ইবনে রুশদের মতো ভাবুককে জন্ম দিয়েছি, পাশ্চাত্যের কাছেও যিনি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চিন্তাধারা পড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ফলে ইউরোপে যে স্বাধীনতা আছে বলা হয় সেটি ‘খুবই স্থুল অর্থে দেখানো স্বাধীনতা’। আমাদের মতো দেশের কবিদের লড়তে হচ্ছে রক্ত ঝরিয়ে ঝরিয়ে। আমাদেরকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়তে হবে সব ধরনের ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের ওপর।”
আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার
কিন্তু রাষ্ট্রেরও ধারণক্ষমতা রয়েছে তার চরিত্রানুযায়ী। লেখক তার দৃষ্টিকে কেবল সমকালেই সীমাবদ্ধ রাখেন না, সে যেমন অতীতকে অভিজ্ঞতা করে বর্তমানে দাঁড়িয়ে লেখে, লেখে বর্তমানের বিবর্তিত আগামীর রূপ, তখন তার বিষয়গুলোও রূপলাভে নতুন কাঠামো দাবি করে, তা পূরণে প্রয়োজন হয়ে পড়ে স্বাধীনতা, কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্র তা দিতে অক্ষম। টলস্টয় তার ‘শিল্প কী’ বইয়ে শিল্পসাহিত্যকে গণমুখী করার কথা বলেছেন এবং সমাজচিত্রটি স্পষ্টতর করে সৃষ্টির পক্ষে থেকেছেন। সে কারণে স্বাধীনতা পেতে হলে মোহ ত্যাগ ও দলবাজি অবশ্যই পরিহার করতে বলেছেন।
শেকসপিয়র, গ্যাটে, সারভানতেস, বালজাক, পুশকিন এরকম আরো অনেকে যে সৃজনশীল কাজে সেরা হয়ে আছেন তা স্তুতির সাহিত্য বা শিল্পকর্মের জন্য নয়, তা ছিল সেসময়ের সামাজিক চাহিদাকে সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা, যেহেতু সমাজের বিবর্তনের রূপ বদল ঘটলেও বদল ঘটেনি সমাজ অস্তিত্বের মূল চেহারাটার। কিন্তু সৃজনসম্পৃক্তরা তার মৌলিক ধারাগুলো অনুধাবন না করে অস্থির প্রবণতাগুলোকে উপজীব্য করে সৃজনে সম্পৃক্ত রয়েছেন ফলে এক দিকে তাদের স্বাধীনতা যেমন তেমন কোনো দরকারি নয়, তেমনি তারা যে আবদ্ধতায় আছে তাও অনুধাবনে তারা সক্ষম নয়। অথচ একজন ভালো ঔপন্যাসিক যেমন সমাজচিত্র তৈরি করে নিখুঁতভাবে রাজনৈতিক চেহারাটার মুখোশ উন্মোচন করতে পারেন, তেমনি একজন রাজনীতিবিদও পারেন না। একজন সাহিত্যিক যেমন করে সমাজটা জানেন তেমন রাজনীতির কোনো ব্যক্তিও জানেন না। এই সত্য শিল্পী-সাহিত্যিকেরা উপলব্ধি করতে পারলে স্বাধীনতার প্রশ্নটি তার কাছেও পরিমাণগত ও গুণগতরূপে ধরা দেবে। তখন তিনি লিখবেন সেই বিষয়ের বাস্তবতা কিভাবে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বা আবৃত রয়েছে নানা ষড়যন্ত্রকারী শক্তির কাছে এর বিরুদ্ধে। এ এক অন্যরকম লড়াই। একজন চে গুয়েভারা বিপ্লবী হয়ে ওঠেন পাবলো নেরুদাকে পড়েই। একজন চার্লি চ্যাপলিন কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন মহাত্মা কার্ল মার্কসের চিঠি পড়েই। নকশাল আন্দোলনই অমিয়ভুষন মজুমদারকে স্বাধীনতা প্রশ্নে এও ভাবতে শিখিয়েছে, প্রতিটি ইজমই কারাগার। যারা কোনো না কোনো ইজমে আস্থা রাখে তারা আসলে ওই কারাগারেই বাস করে।
শুরুর দিকে ‘হোয়ট ইজ ফ্রিডম’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। তাই শেষটা করি এবছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পিটার হান্ডেকে দিয়ে। তিনি বলেছেন, “মানুষ স্বাধীনতা চাইলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে পরাধীনই থাকতে পছন্দ করে। নাহলে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ ইশ্বরের পরাধীনতা মেনে নিত না। আর ঈশ্বরকেও যারা অস্বীকার করে বিজ্ঞানবাদী হয়ে ওঠেন তারাও ‘বিজ্ঞান’কে ‘রিলিজিয়ন’ এই রূপ দেন। ফলে ‘ফ্রি উইল’ নেই। তাঁর ‘দ্য ফ্লাইট’ বইটি লেখার পর এ বিষয়ে গার্ডিয়ানকে সাক্ষাৎকারে এসব বিষয়ে বলেছিলেন। ফ্লাইট বইতে দেখা যায় অনিশ্চয়তার শিকার হওয়াই যেন মানুষের করুণ পরিণতি।
মানে জীবন ও জগতকে যদি কারাগার ভাবেন বা ভাবতে শেখেন তবেই আপনি সেই ফাঁদগুলো টপকে ধীরে ধীরে এগুতে থাকবেন ফানা হতে হতে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো স্বাধীন সত্তার লড়াইয়ে। নাহলে? ঘুম আর স্বপ্ন। ঘুমের ভেতরই সব।