'ওকি গাড়িয়াল ভাই’

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 16:45:19

অবিভক্ত বাংলার বিস্তীর্ণ উত্তরবঙ্গের শ্যামল-সবুজ ভূগোলে উচ্চকিত হয়েছিল এক সুরেলা কণ্ঠ। 'ওকি গাড়িয়াল ভাই' বলে উদাত্ত স্বরে তিনি জাগ্রত করেছিলেন চিরায়ত লোকজ গানের ধারা। তিনি ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট আব্বাসউদ্দীন। তার গান ও সুরের উন্মাদনায় লোকায়ত বাংলা ও বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীনতা ও উজ্জীবনের ছোঁয়া।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭শে অক্টোবর বাংলার উত্তরাঞ্চলের জেলা কুচবিহারের তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আব্বাস উদ্দীন আহমদের পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল।

সে আমলের নিয়ম মতে তিনি নিজের এলাকায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ভর্তি হন স্থানীয় বলরামপুর স্কুলে। আব্বাসউদ্দীন ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। ভাগ্য তাকে টেনে নিয়ে আসে গানের জগতে।

সঙ্গীতে সম্পূর্ণভাবে মগ্ন হয়ে তিনি মন-প্রাণ সঁপে দেন। ক্রমেই তিনি একজন জন নন্দিত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দেশজোড়া সুখ্যাতি অর্জন করেন। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তার কণ্ঠে গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে পল্লীগীতিতেই আব্বাসউদ্দীনের কৃতিত্ব, মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। গানের জগতে তার ছিল না কোনো ওস্তাদের তালিম। কিন্তু তিনি কিছু সময়ের জন্য ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছিলেন। তারপর আপন প্রতিভাবলে তিনি সফলতা অর্জন করেন। নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরেন ঈর্ষণীয় সাংগীতিক দক্ষতায়

পণ্ডিত শাকিল রাসেলের রেফারেন্স অনুযায়ী রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া ভাভাগো ভাভা, ক্ষীরোল চটকা গেয়ে আব্বাস উদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদী, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন।

আব্বাসউদ্দীন তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লি গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা অদ্বিতীয়। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে বিখ্যাত এইচ এম ভি বা হিজ থেস্কেটার ভয়েস কোম্পানি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ডগুলো ছিল বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত সফল।

আব্বাসউদ্দীন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দফতরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। বাংলায় একে ফজলুল হকের মন্ত্রিত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাসউদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দফতরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।

আব্বাসউদ্দিন নিছক একজন গায়ক ছিলেন না, ছিলেন সঙ্গীত সাধক। তিনি শুধু গান গেয়ে এদেশের মানুষের মন জয় করেননি, তিনি লোকবাংলার সাংস্কৃতিক জীবনকে স্পর্শ করেছিলেন। তিনি তার সময়কালের জন আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে। তিনি পরিণত হয়েছিলেন জনমানুষের আত্মার কণ্ঠস্বরে।

আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মোট ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই ৪টি সিনেমা হল বিষ্ণুমায়া (১৯৩২), মহানিশা (১৯৩৬), একটি কথা ও ঠিকাদার (১৯৪০)। ঠিকাদার সিনেমাতে আব্বাস উদ্দিন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে তিনি এর চেয়ে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও তা উল্লেখ করেন নি। কারণ সেই চরিত্রগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এসব সিনেমাতে তিনি গানও করেছিলেন। তখনকার দিনে মুসলমান ব্যক্তির সিনেমা করা ছিল একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। ফলে সিনেমায় তার অংশগ্রহণ ছিল যুগান্তকারী।

আমার শিল্পীজীবনের কথা (১৯৬০) আব্বাসউদ্দীনের রচিত একমাত্র গ্রন্থ। তাছাড়া সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং ১৯৮১ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন

১৯৫৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর কালজয়ী সঙ্গীত প্রতিভা আব্বাসউদ্দীন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর