বাস থেকে নেমে গেল মেয়েটা, ভিড় ঠেলে। জামাটা কুঁচকে গেছে। সে ভিড়টার দিকে প্রচণ্ড ঘৃণাভরে তাকাল। ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের মধ্যে কার কার হাত আঁকসির মতো ওর শরীরের কোথায় কোথায় পৌঁছে গিয়েছিল তা কে বলতে পারে! নিরুপায় আমিও মেয়েটার সাথে নেমে গেলাম। না, না, সশরীরে নয়। আমার গন্তব্য আসতে তখনও ঢের বাকি ছিল। আমার ঝিমানো শরীরটাকে বাসে বসিয়ে রেখে আমি নেমে পড়লাম। মেয়েটাকে অনুসরণ করা বড্ড দরকার, জানা দরকার মেয়েটার চোখে জেগে ওঠা ঘৃণা কোথায় গড়ায়। বাসটা চলতে শুরু করলে মেয়েটা জামাটা ঠিকঠাক করে নিল, বিড়বিড় করে কী জানি বলে উঠল। হয়তো একটা গালি দিল। আমার কাছে মনে হলো ‘কুত্তা’ বা ঐ রকম কিছু। তখনই আমার চোখে পড়ল ফুটপাতে একটা কালো কুকুর মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। আমার মায়া লাগল। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার কথা।
তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। এক অমাবস্যা রাতে বন্ধু রেজাদের বাসা থেকে ফিরছিলাম। রাত হয়ে গিয়েছিল বেশ। আমি আগে কখনো এত রাতে বাসায় ফিরিনি। গঙ্গাসাগরের পাশ দিয়ে আসার সময় মনে হলো রাস্তায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। গঙ্গাসাগর ছিল ছয়গণ্ডা-কালীপুর রাস্তার পাশে বেশ বড় একটা দিঘি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার পেছনে একটা দশাসই কালো কুকুর পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শোনা ভূত-প্রেতের গল্পগুলো মনে পড়তে লাগল। মনে হলো তাহলে সেগুলো গল্প নয়, সবই সত্যি! পরক্ষণেই মনে হলো কাউন্ট ড্রাকুলা কি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রানসেলভেনিয়া থেকে চলে এলো আমাদের এই বাংলাদেশের দূর মফস্বলে। আমি হাঁটি, কুকুরটাও এগোয়; আমি থামি, কুকুরটাও থেমে যায়। অন্ধকারে তার মতিগতি বোঝা যাচিছল না। আমি একবার ভোঁ দৌড় দেওয়ার সিদ্ধান্তটা বাতিল করি। দৌড় দিলেই তো আর আমার ঘাড় ড্রাকুলার রক্ত-চোষক দাঁত থেকে রেহাই পাবে না। তবে আমার গতি দ্রুত হয়, কুকুরটাও দ্রুত হাঁটে। কয়েকবার পেছন ফিরে দেখলাম কুকুরটা আমার সাথে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। তবে তার আকৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসছে না, অর্থাৎ সে অন্য কোনো রূপ ধারণ করছে না, বরাবর কুকুরই থেকে যাচ্ছে। আমাদের বাসার গেটের কাছে পৌঁছে আমি পেছন ফিরে দেখলাম কুকুরটা তখনও আছে। কিন্তু আমি বাসায় ঢুকে গেলে কুকুরটা চলে গেল অন্য দিকে।
আমি সোজা চলে গেলাম মায়ের কাছে। তিনি আমার জন্যই জেগে ছিলেন। আমার বিহ্বলতা দেখে মা জানতে চাইলেন, কী হয়েছে তোমার, মুখ এমন ফ্যাঁকাশে হয়ে গেছে কেন? আমি ঘটনা খুলে বললে মা বললেল, চিন্তা করো না, ও তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়নি। অন্ধকারে কুকুর একলা পথিককে কখনো কখনো পাহারা দিয়ে নিয়ে যায়।
এইক্ষণে, এই শহরের রাস্তায় আমার তাই কুকুরটার জন্য মায়া লাগল। মেয়েটা অবশ্য এগিয়ে গেছে। রাস্তা পার হয়ে সে শান্তিবাগের একটা রিকশা খুঁজছিল। তখনই পাশ থেকে ভেসে আসল ভেষজ ঔষধের রেকর্ডকৃত বিজ্ঞাপন। পুরুষের যৌন ক্ষমতা বহুগুণে বর্ধিত করার অব্যর্থ সব দাওয়াই। মেয়েটার কানে গেল কথাগুলো। কিন্তু আমি কুকুরের কথা ভাবতে ভাবতে পিছিয়ে পড়েছিলাম, তাই তার প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। তবে আমি তার রিকশার পিছু পিছু চললাম। কিছুদূর গিয়ে ডান দিকে বাঁক নেওয়ার মুখে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল রিকশাটা। তখন অবশ্য আমি তার চেহারাটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। বয়স বিশের মতো হবে। তার মুখ থমথমে। রিকশা থেকে নেমে সে দোকানিকে বিস্কিট, চা-পাতা আর দেশলাই দিতে বললে পাশের সেলুনের সামনে বেঞ্চ পেতে বসে থাকা ছেলেদের মধ্য থেকে শিস উঠল, মন্তব্য ছুটে এলো—মালডা জব্বর, নয়া আমদানি।
মেয়েটা বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করলে দেখলাম একটা মধ্যবয়সী লোক দরজা খুলল। মাথার সামনের দিকে কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে। লোকটা মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গিয়ে দরজায় বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ইত্যবসরে আমি ঢুকে গেলাম ঘরে মেয়েটার পিছু পিছু। মেয়েটা ধপ করে সোফায় বসে পড়লে লোকটা কথা বলে উঠল।
কী হয়েছে, মা?
বাবা, একটা কথার পরিষ্কার জবাব দাও। হ্যাঁ অথবা না।
কথাটা কী?
তুমি কী কখনো বাসে কোনো মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছো?
মনে হলো লোকটা শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। দেখলাম তার থুতনিটা বুকে ঠেকে গেল। এই রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি আমার আর সহ্য হলো না। আমি বাড়িটা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
বাসে ফিরে দেখি আমার শরীর ঘুম থেকে জেগে উঠছে। আমার পাশের সিটে বসা ছিল এক বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া মেয়ে, সে তখন বাদাম খাচ্ছে। আর বাদাম-বীজের খয়েরি আবরণ উড়ে এসে পড়ছে আমার শার্টে, প্যান্টে। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি, ভাইয়া! কিছু মনে করবেন না। তখনই বিকট একটা শব্দ হলো, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল বাস জুড়ে। বাসটা হঠাৎ থেমে গেল। ড্রাইভারসহ সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। ছেলেবেলার আমার সেই ভয় আবার নিভৃত কোন স্থান থেকে উঁকি দিল। আমি ফ্যাঁকাশে হয়ে গেলাম, পাশে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালাম। সেও ভয় পেয়েছে, তবে আমার মতো এতটা নয়। সে জানালা দিয়ে বাইরে কী হয়েছে তা দেখার চেষ্টা করছিল। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে?
বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে রাস্তার উপর ঝুলে পড়েছে।
বলেন কী? লাইভ তার?
কী জানি!
আমি আঁতকে উঠলাম। উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম ভয়ঙ্করভাবে ঝুলে আছে তারটা আমাদের বাসের গেট বরাবর। বাসটা এগিয়ে যাওয়ার কিংবা পিছিয়ে আসার উপায় নেই, মগবাজারের জ্যাম। তারটার অবস্থানের কারণে কেউ দরজা দিয়ে নামতেও পারছিল না। তখনই সিগন্যাল উঠে গেল, আমাদের বাসটাও এগিয়ে গেল। বিদ্যুতের তারটা সপাটে পড়ল রাস্তায় কারো কোনো ক্ষতি না করে। মগবাজার মোড় অতিক্রম করলে পরে আমার পাশে বসা মেয়েটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল একমুঠো বাদাম। বলল, নিন, খান। আপনি বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ধন্যবাদ বলে বাদামগুলো নিতে গেলে আমার মনে হলো এক টুকরো রোদ আমার হাতে তুলে দিচ্ছে মেয়েটি। আবার মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার কথা। আমার ছোট্ট বোন এক শীতের সকালে বলেছিল, ভাইয়ু, হাত পাত। আমি ডান হাত বাড়িয়ে দিলে সে আমার হাতের তালুতে তার মুঠো রেখে বলেছিল, ভাইয়ু, তোমাকে এক টুকরো রোদ দিলাম। কপালে মেখে নাও। তোমার রাজটিকা হবে। সেদিন আমার মনে হয়েছিল জীবনটা শীতের সকালের রোদের মতোই মনোরম।
আমার গন্তব্য আসলে পরে মেয়েটিকে আবার ‘ধন্যবাদ’ বলে বাস থেকে নেমে পড়লাম।