“রাস্তার নাম পাল্টায় একদিন
ধারা পাল্টায় মাও সে তুংয়ের চীন
প্রেম পাল্টায়, শরীরও পাল্টে যায়
ডাকছে জীবন, আয়, পাল্টাবি আয়”
- কবীর সুমন
সবার ফিলোসফি একইরকম হবে এটি ভাবা অবান্তর। আবার কিছু কিছু মানুষের চিন্তাজগত কাছাকাছি থাকে। কেউ পাল্টায়। কেউবা না। তবে সময়ের গর্তে পাল্টে যায় সবই। এমন একটা সময় ছিল, আমাদের দেশেও গ্রামে বাড়ির উঠোনে বসত গল্প বলার আসর। একজায়গা থেকে একজন শুরু করে একজন থেমে যেত, অন্যজন সেখান থেকে শুরু করত। যেমন চিনুয়া আচেবে নোবেল পাওয়ার পর আমাদের জানান, তিনি গল্প লেখা শিখেছেন শৈশবে, যখন তাদের বাড়ির উঠোনে গল্প বলার আসর বসত। কবিগান তো এখনো রয়েছে। আবার রয়েছে ধরেন ইজম বা মতাদর্শিক ভিত্তিক সাহিত্যের ঘরানা। যেমন রোমান্টিক ঘরানা, জাদুবাস্তবতা ঘরানা, সুররিয়ালিস্টিক ঘরানা, পোস্ট মর্ডানিস্টিক ঘরানা, পোস্ট কলোনিয়াল ঘরানা এরকম অনেক অনেক।
আধুনিক বিশ্ব-সাহিত্যে আমরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতন্ত্র কিংবা ধারণাবাদের সঙ্গে পরিচিত হই। রেনেসাঁ-পরবর্তীকালে লেখকদের দলবদ্ধ কার্যক্রম আমাদের নজরে আসে। কখনো কখনো কোনো কোনো ধারণার সঙ্গে ব্যক্তি-লেখকের নাম জড়িয়ে পড়ে। আবার কখনো-বা দশক বা শতাব্দী পেরোনোর পর জানা যায়, ওই সময়ে কবি-সাহিত্যিকরা দলগতভাবে একটি ধারণা কিংবা আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন। ১৭ ও ১৮ শতকে রোমান্টিক লেখকদের ‘অ্যামাটরি ফিকশন’ সম্ভবত প্রথম গোষ্ঠীগত সাহিত্যের ধারণার জন্ম দেয়। এরপর আবির্ভূত হয়েছে মেটাফিজিক্যাল পোয়েটস, দ্য অগাস্টানস্। ১৯ শতকের রোমান্টিসিজম, গোথিক নভেল, লেক পোয়েটস, ডার্ক রোমান্টিসিজম, রিয়েলিজম, ন্যাচারালিজম, সিম্বলিজম পৃথিবীময় খ্যাতি নিয়ে আজও বহাল রয়েছে। ২০ শতকে আসে অস্তিত্ববাদ, মডার্নিজম, দ্য লস্ট জেনারেশন, ডাডাবাদ বা এন্টি-আর্ট, সুররিয়ালিজম, সাউদার্ন অ্যাগ্রেরিয়ানস, ওলিপো, পোস্ট-মডার্নিজম, ব্ল্যাক মাউন্টেইন পোয়েটস, বিট পোয়েটস, হাঙরিয়ালিস্ট পোয়েটস, কনফ্যাশনাল পোয়েট্রি, নিউ ইয়র্ক স্কুল, ম্যাজিকেল রিয়ালিজম, পোস্ট-কলোনিয়ালিজম, প্রোকল্পনা মুভমেন্ট, স্পোকেন ওয়ার্ল্ড। ২০ শতকের শেষে এবং একুশ শতকের প্রথমপাদে নিউ ফরমালিজম এবং পারফরমেন্স পোয়েট্রি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাহিত্য-আন্দোলন কিংবা গোষ্ঠীতন্ত্র কোনো কোনো চিন্তা বা ভাবধারা প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন করলেও অন্তরালে কিন্তু ব্যক্তির চিন্তার বিকাশই সবসময় প্রাধান্য পেয়েছে।
গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার চেয়ে ব্যক্তিই সাহিত্যে প্রভাব ও পরিচিতি নিয়ে হাজির থেকেছেন সর্বকালে। এখনো পর্যন্ত ব্যক্তিরই জয়-জয়কার। তবু কিছু সাহিত্যে দলবাজির কথা বলি। যেমন, ব্ল্যাক লাইটার জেনারেশন। “এক ধরনের অঙ্গীকার, এক ধরনের বার্তা প্রদান, এক ধরনের প্রতিবাদ করা—এসব ছাড়া আর কিছুই লেখা সম্ভব নয়। আফ্রিকার জীবনটাই এমন হয়েছে যে আপনাকে প্রতিবাদ করতেই হবে; আপনাকে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতেই হবে।” আফ্রিকার মহান সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে বলেছিলেন এই কথা। তিনি এইসব কথা বলেছিলেন আফ্রিকার উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশিকতার প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে। তিনি তাঁর সাহিত্য করেছেন এই দায়বদ্ধতা থেকেই। তার অনবদ্য উপন্যাস ত্রয়ী (ট্রিওলজি) ‘থিংস ফল এ্যাপার্ট’, ‘নো লংগার এট এজ’ ও ‘এ্যারো অফ গড’-এর দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। এর বাইরে ‘দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি’ ও ‘এন্টহিল অফ দ্য সাভানা’-এ প্রসঙ্গগুলো আরো জোরালোভাবে এসেছে। তিনি একসময় ব্ল্যাক লাইটার জেনারেশনের নেতৃত্ব দেন। এমন আরেকজন হচ্ছেন, হামিদুকেন। ছিল জেনারেশন টুয়েন্টি সেভেন। এ জেনারেশন গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ফেদেরিকো ডেল সেগরাদো কোরাজন ডি জিসাস গার্সিয়া লোরকা। সেই বিপ্লবী কবি। ছিলেন একজন স্পেনিশ কবি, নাট্যকার ও থিয়েটার পরিচালক। জন্ম ৫ জুন ১৮৯৮ সাল। জন্মস্থান ফুয়েন্তি ভ্যাকুয়ারস আন্দালুসিয়া, স্পেন, আর মৃত্যু ১৯ আগস্ট, ১৯৩৬ সাল। তার মৃত্যু স্থান ছিল গ্রানাডায়। সাহিত্যচর্চায় তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন সালভাদর দালি, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, লুইস বানুয়েল ও প্রমুখ লেখকদের দ্বারা। বিশ্বখ্যাত সাকরেড হার্ট বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেন।
১৯১৯ সালে লোরকা মাদ্রিদে আসেন এবং সেখানে তিনি চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির সাথে সাক্ষাত লাভ করেন যিনি তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করেছিলেন। স্পেনিশ ভাষায় লেখা লোরকার দুটি বিখ্যাত কাব্য সংকলন হলো ‘কনসিয়নস’ বা সঙ্গীত এবং ‘রোমানসিরো গিতানো’ বা দ্য জিপসি বালাদ। লোরকা ছিলেন স্পেনের বিখ্যাত কবিদের অন্যতম ও একজন সেরা নাট্যকার। লোরকার কাব্যে ছিল তিন মাত্রার সাহিত্য অলঙ্কার ও রোমান্স। ১৯৩৬ সালে স্পেনিস সিভিল ওয়ার শুরু হলে তিনি গেরিলাদের হাতে আটক হন। আগস্টের ১৯ কিংবা ২০ তারিখ ফ্রাঙ্কোর লোকেরা কবিকে বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করেন। তার মৃতদেহ কখনো খুঁজে পওয়া যায়নি।
আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার
‘জেনারেশন টুয়েন্টি সেভেন’ ছিল বিখ্যাত সব কবিদের আন্তর্জাতিক একটি সংগঠন। তাদের কাজ ছিল কবিতার মাধ্যমে দেশে দেশে বিপ্লব করা। এরকম আরেকটি গোষ্ঠীর নাম ‘জেনারেশন অব ফোরটি ফাইভ’। ১৯২৩ সালে জন্ম নেওয়া ইদা হচ্ছেন উরুগুয়ের ‘জেনারেশন অব ৪৫’ নামে পরিচিত শিল্প আন্দোলনে অংশ নেওয়া সর্বশেষ জীবিত ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইদা রোমানস ভাষার সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর মেক্সিকোর এফআইএল সাহিত্য পুরস্কার পান। এ জেনারেশনের লেখক-কবিরা বিশেষত বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন।
নারীবাদী কবি-লেখকরা একটি দল করেছিলেন। সেটির নাম, ‘থার্ড ওয়েব জেনারেশন’। রেবেকা ওয়াকার কুইয়ার (এলজিবিটি) এবং অশ্বেতাঙ্গ নারীদের ওপর অধিক দৃষ্টি দেবার জন্য প্রথম ‘তৃতীয় তরঙ্গ’ শব্দটিকে ব্যবহার করেন। নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গ একটি বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় নারীবাদী কর্মকাণ্ড এবং আলোচনা নিয়ে পরিবেষ্টিত। যদিও তৃতীয় তরঙ্গের সঠিক সীমানা কী সেটি একটি বিতর্কের বিষয়, তবু সাধারণত নব্বয়ের দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কালকেই তৃতীয় তরঙ্গের ব্যাপ্তিকাল হিসেবে ধরা হয়। একে একটি ইন্ডিভিজুয়াল মুভমেন্ট বা ‘একক আন্দোলন’ বলা হয়, কারণ নারীবাদীকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করাও এর আওতায় পড়ে। তৃতীয় তরঙ্গের উত্থানের আংশিক কারণ হলো দ্বিতীয় তরঙ্গের ব্যর্থতা, এবং ষাট, সত্তর ও আশির দশকে তৈরি হওয়া আন্দোলন ও কর্মপ্রচেষ্টাগুলোর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। তৃতীয় তরঙ্গে নারীবাদকে বিস্তৃত করে আরো অনেক পরিচয়কে এর আওতাভুক্ত করা হয় এবং আরো অনেক বর্ণ, জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পটভূমিকে এখানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এভাবে একে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রতিক্রিয়া ও অবিচ্ছিন্নতা হিসেবে দেখা যায়। এতে দ্বিতীয় তরঙ্গের কনস্ট্রাক্ট বা অবকাঠামোর একটি আংশিক অস্থিতিশীলতাও বিদ্যমান। তৃতীয় তরঙ্গ শুরুর কয়েক বছর পূর্বে, ১৯৮৯ সালে একটি সম্পর্কযুক্ত ধারণা ইন্টারসেকশনালিটির জন্ম হয়। কিন্তু এই তৃতীয় তরঙ্গেই এই ধারণাটিকে গ্রহণ করা হয়।
রেবেকা ওয়াকার কুইয়ার ১৯৯২ সালে এনিটা হিল কেসের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। যেসব পুরুষ নারীদের ওপর যৌন হয়রানি ও অন্যান্য নির্যাতন করে, এবং এরকম অবিচার করেও তাদের প্রিভিলেজ বা সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহার করে তারা বিচারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়, সেইসব পুরুষের দ্বারা নারীদেরকে চুপ করিয়ে রাখার যে ঘটনাগুলো তার চোখে পড়ে, তার বিরুদ্ধে রেবেকা ওয়াকার কলম ধরেছিলেন, এবং বলেছিলেন, “আমি উত্তর-নারীবাদ নারীবাদী নই। আমি হলাম তৃতীয় তরঙ্গ।” থার্ড ওয়েব জেনারেশনের সদস্যদের মতে, নারীবাদ রাজনৈতিক পরিবর্তনের চাইতে ব্যক্তিগত ও ব্যক্তিতাবাদী পরিচয়ের ওপরে অধিক দৃষ্টিনিক্ষেপ করে।
কিন্তু এ জেনারেশনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কলম ধরেন যেসব কবি-লেখকরা তাদের গ্রুপের নাম, ‘ফেপফে’ জেনারেশন। ‘ফেপফে’র পুরো মিনিং হলো ‘ফেমিনিজম পলিটিক্যাল ফেনামেনা’। এ জেনারেশনের নেতৃত্ব দেন জুডিথ অ্যাস্টেলারা। এ গ্রুপের জন্ম ২০০৭ সালে। নারীবাদী তত্ত্বের বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে, এর মধ্যে লিবারেল, মার্কসিস্ট বা সোশ্যালিস্ট, রাডিকাল, ইকো, কালচারাল, গ্লোবাল—এ জাতীয় নানা শ্রেণী বিন্যাস করে বিভিন্ন বিশ্লেষক, গবেষক তার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং গবেষণা দ্বারা নারীবাদের প্রকারভেদ নির্ধারণ করেন। জুডিথ অ্যাস্টেলারা তার বই ‘Political Feminism’-এ বলেছেন, “নারীবাদ হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন ও আন্দোলনের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা, যা নারী নিপীড়ন বন্ধ করার লক্ষ্যে চেষ্টা করে থাকে। এ প্রসঙ্গে ভার্জিনিয়া উলফের একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার মতে, আত্মার মাঝে দু ধরনের শক্তি রয়েছে—পুরুষ সুলভ ও নারী সুলভ। পুরুষদের মস্তিষ্কে নারীসুলভ শক্তির ওপর পুরুষসুলভ শক্তি প্রাধান্য বিস্তার করে আর মেয়ের মস্তিষ্কে এর বিপরীত। স্বাভাবিক ও সুখকর অবস্থা তখনই আসবে যখন এ দুয়ের সমন্বয় সাধন ঘটবে। পুরোপুরি পুরুষসুলভ ও পুরোপুরি নারীসুলভ মন কোনোটাই সম্ভবত সৃষ্টিশীল কিছু ভালোমতো করতে পারে না।”
আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত
এই জেনারেশনের লেখকদের মতোই মেইনস্ট্রিম কালচারের বিরুদ্ধে ক্রিটিক করার জন্য তৈরি হয়েছিল বিট জেনারেশন। এই আন্দোলনটি গড়ে তোলেন প্রথম দিকে আমেরিকার কয়েকজন কবি তারপর এটি নিউইয়র্কসহ কয়েক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনটি ১৯৫০-৬০ সালের দিকে শক্তিশালী রূপ নেয়। এই বিট জেনারেশনের কবি লেখকরা সাধারণত লিটলম্যাগাজিনগুলোতে লিখতেন। তবে পোস্ট মডার্ন যুগে এই বিট জেনারেশনের সাহিত্যকে অস্বীকার করার জো নেই। এটা এমন একটা সমাজ যেখানে সবাইকে আইন, আদেশ আর জাগতিকতাকে মেনে চলতে হবে। ৫০ সালের দিকে বিট আন্দোলন আরো বেড়ে উঠতে থাকে। নিউইয়র্কের গ্রির উইচ ভিলেজ আর সান ফ্রান্সিকোর নর্থ বিচ এই আন্দোলনের পুণ্যভূমি হিসেবে খ্যাত। বিট সরাসরি সমাজের যে কোনো বিষয়কে ও প্রতিষ্ঠিত আইনকে চ্যালেঞ্জ জানায়। তারা আমেরিকার রূপ নিয়েও প্রশ্ন তোলে। এই জেনারেশনের একজন উল্লেখযোগ্য হলেন জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ, বব কাউফম্যান। তিনি তার ব্যকইত্ব দিয়ে এই বিট আন্দোলনের আত্মাকে সামনে টেনে আনেন। তিনি একমাত্র যিনি পঞ্চাশের সেই সময়টায় বিট স্বরকে প্রোজ্বলিত করে তোলেন এবং তার যুগে কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অনেক বিট জেনারেশনের অনুসারীদের মতো তিনিও নিউইয়র্ক থেকে শুরু করেন এবং পরে তার ঠিকানা মেলে সান ফ্রান্সিসকোতে। এখানে এলেই গিন্সবার্গ কবিতা পড়তেন, কাউফম্যান পেয়ে যান আরকেটি পথ। তিনি রাস্তার কবি বিষয়ে একটা কিছু ভাবতে থাকেন। কাউফম্যানের কবিতাগুলো এমন যেখানে তার পরাবাস্তব একটা চেহারায় পাওয়া গেলেও তাতে থাকে উচ্চণ্ড একটা স্বভাব আর রাজনৈতিক সংলাপ। কাউফম্যান নিজেকে বুদ্ধবাদী বলে দাবি করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কবিতায় এমন কিছু আছে যা উচ্চমার্গীয় একটা কিছু করার আদেশ করে। তিনি আধ্যাত্মিকতার চর্চা শুরু করেন। এবং বস্তুবাদকে অস্বীকার করেন। এমনও হতো মানুষ ব্যাগল শপ নামক একটি জায়গায় জড়ো হতেন তার মুখে কবিতা শোনার জন্য, তিনি একটি টেবিলে লাফ দিয়ে উঠে পড়তেন একটি নতুন কবিতা বের করতেন অথবা এলিয়ট, পাউন্ড বা ব্লেকের মতো কারো কবিতা পড়তেন। তিনি যখন কবিতা পড়তেন চারপাশ নিশ্চুপ হয়ে যেত। তার প্রতিটি শব্দেই যেন শ্রোতারা একটা বিশেষ কিছু পেতেন। একসময় তিনি পুলিশের নজরে পড়লেন। ৬০-এর দিকে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেন। তখনই তাকে নিউইয়র্কে একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বিটরাই একমাত্র আন্দোলনকারী যারা তাদের জীবনকেই একটি আখ্যান করে ফেলতেন, এবং তারা তাদের জীবনকে পৃথিবীর সমগ্র পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন। ১৯৫৮ সালের দিকে বিট জেনারেশনের লেখকেরা সান ফ্রান্সিসকো থেকে মেক্সিকো, ভেনিস ও ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে আসতে থাকে। বিটনিক থেকে তাদেরকে বলা হতে থাকে ব্রান্ট অফ জোক্স (brunt of jokes). গণমাধ্যম কেবল তাদের দুইটি বিষয়কেই সামনে টেনে আনে—১. তাদের জীবন আর ২. তাদের প্রতিবিম্বিত শিল্প।
বিট প্রজন্মেরই অনন্য সাহিত্য প্রতিভা জ্যাক কেরুয়াক। তিনি বলেন, “গিন্সবার্গ বামপন্থী রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে পড়ল। জয়েসের মতো বলছিলাম আমি, ’২০-এ এজরা পাউন্ডকে জয়েস বলেছিল, ‘রাজনীতি নিয়ে বিরক্ত কোরো না আমায়, স্টাইল ছাড়া আর কোনো কিছুতে আমার আগ্রহ নেই। তা ছাড়া, এসব নব্য আঁভ-গার্দ আর আকাশছোঁয়া ইন্দ্রিয় ঘনতায় মহাবিরক্ত ছিলাম আমি। তখন পাসকাল পড়ছি, ধর্ম সম্পর্কে নানা কথা টুকে রাখছি। এখন তো যত অ-বুদ্ধিবাদীদের সঙ্গে মিশি আমি, কোনো দলে ফেলে নাম লেখাতে রাজি নয়কো মোটেই। এখন তো ওরা হ্যাপিনিংয়ে মুরগি ধরে ধরে ক্রুশুবিদ্ধ করেছে—কী করবে এর পরে...আস্ত মানুষকে ধরে ঝুলিয়ে দেবে, অ্যাঁ?...হ্যাঁ, ’৬০-এ সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, যে যার পথে গেছে, আমার এ-ই পথ : ঘরোয়া জীবন, কখনো-সখনো স্থানীয় শুঁড়িখানায় দু-পাত্তর মেরে আসি।”
অ্যালেন গিন্সবার্গ তিনি মার্কিন সামরিকতন্ত্র, অর্থনৈতিক বস্তুবাদ এবং যৌন নিপীড়ন বিষয়ে জোরালোভাবে বিরোধিতা করেন। শুরুতে গিন্সবার্গ তার ‘হাউল’ (১৯৫৬) মহাকাব্যের জন্য সর্বাধিক পরিচিত হন; যেখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক শক্তিকে নিন্দা করেন। এই কবিতাটি লিখেছিলেন তার বিট প্রজন্মের বন্ধুদের বরণ করে নিয়ে এবং বস্তুবাদের ধ্বংসাত্মক শক্তিকে আক্রমণ করে। কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ছিলেন বাংলাদেশের বন্ধু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল, যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কলকাতা ও বাংলাদেশের মধ্যে সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করত ‘যশোর রোড’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক বৃষ্টি হওয়ায় যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়কপথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর আসেন। তার সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নিরীহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি গিন্সবার্গ ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটিতে। তিনি তিন দিন বসে দীর্ঘ এই কবিতাটি লেখেন।
কলকাতাতেও শুরু হয়েছিল হাংরি জেনারেশনের লেখালেখি ষাটের দশকে। দেশভাগের পর পশ্চিম বাংলায় এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। একদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে উদ্বাস্তু কলোনিতে বাড়ছে মানুষের ভিড়, অন্যদিকে স্বরাজের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে চলছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির নগ্ন খেলা। ঠিক এই সময় আবির্ভাব ঘটল একদল তরুণ কবির।
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে যৌনতা
কোনো কবিতার প্রথম লাইন “আমি খালি পেটে ইন্টারভ্যু দিতে গিয়ে বলে এলুম অর্থমন্ত্রীর কাকিমার নাম।” বাংলা সাহিত্যকে এই প্রথমবারের মতো বুদ্ধিজীবীদের সভা থেকে নামিয়ে আনা হলো রাস্তায়, সাধারণ মানুষের মাঝে। যে ক্ষুধার্ত তরুণ কবিরা এই বিপ্লব ঘটাল, তাদের নেতৃত্ব দেন ২১ বছরের এক তরুণ, মলয় রায়চৌধুরী; ভবিষ্যতে যিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলবেন, “একজন কালচারাল বাস্টার্ড।” তিনি এখনো জীবিত ও ফেসবুকে সক্রিয়। হাংরি আন্দোলনকারীরা তাদের মুভমেন্টকে ‘কালচারাল কাউন্টার’ বলতেন। পশ্চিমা বিশ্বে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী একটি প্রজন্ম, কালচারাল কাউন্টার ঘটিয়ে নতুনধারার এক সমাজের বীজ বুনে ফেলেছে। আমেরিকার ‘বিট জেনারেশন’ আর ব্রিটেনের ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ গোষ্ঠীর লেখকেরা মূলধারার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আঘাত হেনে বিশ্বে জনপ্রিয়। অনেকে এজন্য হাংরি জেনারেশনকে বিট জেনারেশনের সাথে তুলনা করলেন। বিট জেনারেশনের অনুপ্রেরণাতে হোক বা যেভাবেই হোক না কেন, ১৯৬১ সালে পাটনা থেকে রীতিমতো ইশতেহার ছাপিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন মলয় রায়চৌধুরী। বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন প্রচলিত ধারার সাহিত্য আর সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কবিতার ইশতেহারে তিনি লিখলেন, “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত।” লিখলেন, “এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।”
আমাদের দেশেও এমন জেনারেশন বা গ্রুপ তৈরি করেছিলেন কবি রফিক আজাদ। এর নাম, স্যাড জেনারেশন। রফিক আজাদ এখন আর জীবিত নেই। তিনিই লিখেছিলেন কবিতায়, “ভাত দে হারামজাদা, নাইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাব।” মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মধ্যে ‘ইরোস’ আর ‘থ্যানাটোস’ নামে পরস্পরবিরোধী দুটি শক্তি সমভাবে ক্রিয়াশীল; একটির কারণে মানুষ জীবনবাদী হয়, সৃজনশীল পথে চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। আর থ্যানাটোসের কারণে মানুষ হয় মৃত্যুমুখী—অন্ধকার আর ধ্বংসাত্মক পথে যার প্রকাশ ঘটে। স্যাড জেনারেশনের অন্যতম প্রবক্তা এই কবি জীবনকে মেপেছেন দুঃখ আর যন্ত্রণার চামচে। T. S Eliot এর J. alfred prufrock-ও জীবনকে মেপেছিলেন কফির চামচে—I have measured out my life with coffee spoons. চলুন তার একটা আমার প্রিয় কবিতা পড়ি।
বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
বালক জানে না তো পুষবে অনুরাগ
হৃদয়ে কতদিন, কার বা চলা-পথে
ছড়াবে মুঠো-মুঠো বকুল ফুলগুলো;
কোথায় যেতে হবে, যাবে না কোন দিকে,
ব্যাপক হাঁটাহাঁটি করবে কোন পথে!
বালক জানল না—মানুষ ম্লানমুখে
কেন যে তারা গোনে; পায়ের নিচে কার
কেন যে ফুল ঝরে, কতটা ফুল ঝরে!
মানুষ ভুল পথে গিয়েছে কত দূর,
বেপথু কাকে বলে বালক জানে না তা!
বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই—থাকে না, নিরুপায়—
যে আসে সে-ই জানে—ভুলের দামে কিনে
আনে সে প্রিয় ম্যাপ—পথিক ম্রিয়মাণ,
উল্টোরথে চ’ড়ে চলেছে মূল পথ!বালক জানে না তো অর্থনীতি আর
মৌল রাজনীতি—উল্টো ক’রে ধরে
সঠিক পতাকাটি—পতাকা দশদিশে
যেনবা কম্পাস স্বদেশ ঠিক রাখে।
বালক জানে না সে বানানে ভুল ক’রে
উল্টাসিধা বোঝে : সঠিক পথজুড়ে
পথের সবখানে কাঁটার ব্যাপকতা!
বালক ভুল ক’রে পড়েছে ভুল বই,
পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই!
বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল,
সাঁতার না শিখে সে সাগরে ঝাঁপ দ্যায়,
জলের চোরাস্রোত গোপনে ব’য়ে যায়,
বালক ভুল ক’রে নেমেছে ভুল জলে!
বালক জানে না তো জীবন থেকে তার
কতটা অপচয় শিল্পে প্রয়োজন।
পাথর বেশ ভারী, বহনে অপারগ
বালক বোঝে না তা—বালক সিসিফাস
পাহাড়ে উঠে যাবে, পাথর নেমে যাবে
পাথুরে পাদদেশে!—বিমূঢ়, বিস্মিত
বালক হতাশায় অর্তনাদ ক’রে
গড়িয়ে প’ড়ে যাবে অন্ধকার খাদে।
বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল,
ফুলের নামে কত কাঁটারা জেগে থাকে
পুরোটা পথজুড়ে, দীর্ঘ পথজুড়ে—
বালক জানে না তা, বালক জানে না তো!
বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।