রুশ ফিউচারিস্ট কবি ও নাট্যকার ভ্লাদিমির ক্লেভনিকভ শিল্প সাহিত্যকে বলেছিলেন ‘বাচনিক বাজার’, যে বাজারকে দখল করার জন্য লেখকেরা ‘অদৃশ্য যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়েছেন। জার্মান লেখক গ্যেটে সাহিত্যকে ‘বৌদ্ধিক পণ্যের বিশ্ববাজার’ বলেছিলেন। ফরাসি কবি পল ভ্যালেরি বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি হচ্ছে পুঁজি’, আর সাহিত্য হচ্ছে এই সংস্কৃতিরই উজ্জ্বলতম শস্য। মানে শিল্পসাহিত্যেরও বাজার থাকে। সেই বাজার বইপাড়ায়। কিন্তু যে কবি কবিতার নেশায় বুঁদ হয়ে এসেছে শহরে, পায়নি তার লেখা কোনো প্রধান সাময়িকীগুলোতে ঠাঁই, এগিয়ে আসেন না প্রকাশক, তার কবি হওয়ার ইচ্ছা কি তবে মরে যাবে? একসময় বলা হতো কেন? বটতলায় যাও। বটতলাটা জানি কোনদিকে?
বটতলা কলকাতা তথা বাংলার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের পুরনো স্থান। বর্তমানে এটি কলকাতার একটি থানার নাম। শোভাবাজার-চিৎপুর এলাকার একটি বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে এই নামের উৎপত্তি হয়। ঊনিশ শতকে বাংলার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প এখানেই শুরু হয়েছিল। এই বটগাছ এবং তার পাশের এলাকায় যে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠেছিল, তা প্রধানত সাধারণ ও অর্ধশিক্ষিত পাঠকের চাহিদা মেটাত। তাদের রুচি অনুযায়ী গ্রন্থ, যেমন পুথি, পাঁচালি, পঞ্জিকা, পুরাণ, চটি, লোককাহিনী ইত্যাদি এখান থেকে প্রকাশিত হতো। হীনার্থে ‘বটতলার পুথি’ নামে খ্যাত ছিল। তবে ঊনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত দেশের প্রকাশনা শিল্পে বটতলা সাহিত্যের নিজস্ব একটা স্থান ছিল। এর যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের একটি উক্তিতে। তিনি দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) উপন্যাসে বটতলার দেবীর নিকট নিজের লেখনীশক্তির বৃদ্ধি কামনা করেছেন, যাতে লেখার মাধ্যমে তিনি প্রচুর অর্থ লাভ করতে পারেন। এ উক্তির পেছনে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ থাকলেও এর মাধ্যমে তৎকালে বটতলা সাহিত্যের ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাবের চিত্রটিই ফুটে উঠেছে।
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অধিকাংশ পুস্তক ও প্রচারপত্র এই বটতলা থেকেই প্রকাশিত হতো। কিন্তু ১৮৫০-এর দশক থেকে বটতলা মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে তার পূর্ব ঐতিহ্য হারাতে থাকে। কিন্তু যতদিন যায়, সময় পাল্টায়, প্রকাশনা শিল্পের উন্নতি হতে শুরু করে। রুচিসম্পন্ন লেখক ও প্রকাশকরা বটতলাকে একটি উপহাসের বিষয়ে পরিণত করেন। এসব হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের শুরুর দিকের গল্প। মধ্যে একটা কথা বলি বাংলাদেশের রিজিয়া রহমানের যে ‘বটতলার উপন্যাস’ এটি কিন্তু বটতলার না। তবে চট্রগ্রামের রমা দেবী বন্দরনগরীতে ঠিকই নিজে বই লিখে হেঁটে হেঁটে ‘বই নেবেন বই’ বলে বিক্রি করতেন। রমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন । ১৯৬২ সালে কক্সবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। সেই থেকে ১৬ বছর শিক্ষকতা করেছেন ।কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বদলে দেয় তার জীবন। যুদ্ধে পাক বাহিনীর কাছে সম্ভ্রম হারিয়ে হন বীরাঙ্গনা। ’৭১-এর ১৩ মে, পাকহানাদার বাহিনী সর্বস্বান্ত করে তাঁকে। তাঁর স্বামী তখন ভারতে। সেদিন তিন সন্তান নিয়ে তিনি ছিলেন পোপাদিয়ায় তার বাবার বাড়িতে। ওই এলাকার পাকিস্তানী দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর লোকজন তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। সে সময় সেখানে ছিল তাঁর মা ও তিন শিশু সন্তান। কোলে দুগ্ধপোষ্য সন্তান থাকা সত্ত্বেও নির্দয় পাকবাহিনী নিস্তার দেয়নি তাঁকে। পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তাঁকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানী খানসেনা। পরবর্তী ধর্ষণের ভয়ে হানাদারদের কাছ থেকে কোনোমতে মুক্ত হয়ে পুকুরপাড়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি নর পিশাচরা। চোখের সামনে গানপাউডার দিয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকসেনারা। নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল পরিবারটিকে। ঘরের মূল্যবান মালামাল আর তাঁর লেখা সাহিত্য কর্মগুলো পুড়ছিল চোখের সামনেই।
আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত
পরের ইতিহাস আরো করুণ আরো বেদনার। এবার শুরু হলো নিকটজন আর সমাজের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার পালা। সমাজের চোখে তখন তিনি একজন ধর্ষিতা নারী। সামাজিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার রমা তখন সম্ভ্রম হারানোর মর্মান্তিক ঘটনাকে আড়াল করে তিন সন্তান আর মাকে নিয়ে পথে পথে। মেলেনি নিরাপত্তার আশ্রয়। দিনান্তে জোটেনি দু মুঠো ভাত। সহযোগিতা, সহমর্মিতা আসেনি কারো কাছ থেকেই। সবকিছু হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন রমা চৌধুরী। ‘একাত্তরের জননী’সহ ১৮টি বই লিখেছেন তিনি। জীবিকার প্রয়োজনে সেই বই ফেরি করেছেন পায়ে হেঁটে, চট্টগ্রামের পথে পথে। প্রথমে লিখতেন একটি পাক্ষিক পত্রিকায়। সম্মানীর বদলে পেতেন প্রত্রিকার ৫০টি কপি। পরে নিজের লেখা বই নিজেই প্রকাশ করে ফেরি করেছেন। বই বিক্রি করতে পারলে আহার জুটত, না হলে উপোস। সেই রমা চৌধুরীকে আমরা কি মনে রেখেছি? তাঁর বই না পড়ি তাঁর বেদনাগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। উত্তর সম্ভবত, না। ইউরোপে অবশ্য স্ট্রিট লিটারেচার মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল অনেক আগে।
কবি-লেখকরা প্যারিসের রাস্তায় বসে বই লিখতেন শাদা কাগজে। এরপর এটিই কার্বনকপি করে বিক্রি করতেন। প্যারিসের মঁ মার্ত্র আর মুল্যাঁ রুজ দুটি ছিল ক্যাবারে কাফে। এর সামনে ভিড় জমাতেন কবি-শিল্পীরা। এঁকে যেতেন একের পর এক মানবীশরীর। সেইসঙ্গে তাদের ঘিরে সামাজিক অনুষঙ্গ। রেখায় অবাক করা বোল্ডনেস। সে যেন তাঁর মেজাজের মতোই একরোখা। অল্প কটি বলিষ্ঠ রেখায় ফুটে উঠছে সেসময়কার ডাকসাইটে সব সুন্দরীদের শরীরী বিভঙ্গ। দেহোপজীবিনীদের উন্মত্ত ব্যালে নাচ ক্যানভাসে ফুটে উঠত।
এগুলোর পাশে ছিল আরো পাশাপাশি কয়েকটা গলি। পাথুরে রাস্তায় বিকেলের রোদ্দুর। পেছনে পাহাড়। এসব গলিতে ছবি এঁকে চলেছেন শিল্পীরা। ছবি আঁকা দেখতে ভিড় জমে শিল্পীকে ঘিরে। কেউ আবার আঁকা ছবির পশরা সাজিয়ে বসেছেন। এ ছবি, ও ছবি দেখতে দেখতে কেউ কিনে নেন একটা। এভাবেই স্মৃতির এক টুকরো প্যারিস তাঁরা নিয়ে যাবেন নিজের শহরে। এদিকে ওদিকে সালঁ, রেস্তোরাঁ। সন্ধেকে স্বাগত জানিয়ে রাস্তার নিয়নবাতি জ্বলার আগে থেকেই সেখানে শুরু হয়ে যায় রঙিন নেশায় ভাসা। হাওয়ায় ভেসে আসে ভায়োলিনের সুর। যে সুরে যেন মন হুহু করে কেঁদে উঠে। চারদিকে এত অফুরন্ত প্রাণ, এত বেদনা। এত এত।
মঁ মার্ত্রেতে গেলেই যারা শিল্পবোদ্ধা তাদের মনে পড়বেই ফরাসি শিল্পের জগতে আরেক বিস্ময় তুলুস লোত্রেক-এর কথা। আর আমার মতো যারা যাননি তারা গুগলে সাধ মেটাবেন। লোত্রেকের ছবি দেখেছি। তাঁর জীবন উপলব্ধি না করলে বোঝা যায় না তাঁর ছবির সাবলীল আর শক্তিশালী রেখাগুলোর উৎস কী। যখন একটু একটু করে মানুষটাকে ধরা যায়, তখনই আরো বেশি করে চেনা যায় লোত্রেকের ছবির বলিষ্ঠ রেখা, রঙের আশ্চর্য বিন্যাস। মাত্র ৩৬ বছরের জীবন। এত কম সময় নিয়ে এসেছিলেন। জিনগত অসুখের প্রকোপে লোত্রেকের সারাটা জীবন কেটেছে অসীম শারীরিক ও মানসিক দোলাচলে। ছোটবেলায় পর পর দু বছর দু পায়েরই ফিমার ভেঙে গিয়েছিল মাঝখান থেকে। তাই মানুষটির উচ্চতাই আর বাড়ল না। আটকে গেলেন সাড়ে চার ফুটে। কিন্তু ক্ষুদ্রকায় এই মানুষটি তার ছবিকে নিয়ে গেলেন অসামান্য এক উচ্চতায়।
কাউন্টের ছেলে লোত্রেক স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে না পেরে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন রঙের জগতে, ছবির দুনিয়ায়। তাঁর অনেক ছবিই আঁকা মঁ মার্ত্র আর মুল্যাঁ রুজে বসে। কখনো কখনো বিয়ারের টাকার ঘাটতি দেখা দিলে দাঁড়িয়ে যেতেন রাস্তায়। বেশি না, অল্প কিছু ফ্রাঁ। যতটুকু ফ্রাঁ হলে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা যায়। এঁকেছেন একের পর এক মানবীশরীর। সেইসঙ্গে তাদের ঘিরে সামাজিক অনুষঙ্গ। রেখায় অবাক করা বোল্ডনেস। সে যেন তাঁর মেজাজের মতোই একরোখা। অল্প কটি বলিষ্ঠ রেখায় ফুটে উঠছে সেসময়কার ডাকসাইটে সব সুন্দরীদের শরীরী বিভঙ্গ। দেহোপজীবিনীদের উন্মত্ত ব্যালে নাচ তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠছে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা আর অসামান্য ভারসাম্যে। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট যুগের সমকালীন শিল্পীরা মুগ্ধ ছিলেন তাঁর ড্রয়িংয়ে।
শেষ জীবনে অনেকদিন আর ছবিই আঁকতে পারেননি লোত্রেক। দু’পা অকেজো হয়ে যায় ক্রমশ। অনিয়ন্ত্রিত, বোহেমিয়ান জীবনযাপনে দু-দু’বার হৃদরোগ। শরীরে সিফিলিসের বিস্তার। তবু সেই অপরিসীম শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁর ছবির সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজারের ওপর। তার মধ্যে ৭৩৭টি ক্যানভাস অনায়াসে তাঁকে নিয়ে যায় প্রতিষ্ঠার শিখরে। তাঁর শিল্পসৃজনকে স্বীকৃতি দেয় ইতিহাস। স্পেস সৃষ্টির ক্ষেত্রে লোত্রেকের ছবিতে জাপানী শিল্পের প্রভাব পড়েছিল। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আর্টকে সেটাই খোঁজ দিল নতুন দিগন্তের।
মুল্যাঁ রুজ ধরা দিয়েছে লোত্রেকের ক্যানভাসজুড়ে। শুধু লোত্রেকেরই নয়, ভ্যান গঘেরও মুল্যাঁ রুজের জীবন শিল্পের দুনিয়ায় যুক্ত করেছে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। মুল্যাঁ রুজ ১৮৮৯ সালে প্রথম তৈরি হয়েছিল। প্যারিসে বেড়াতে গিয়ে মুল্যাঁ রুজের ফেরি শো আর ফ্রেঞ্চ ক্যানক্যান ডান্স না দেখতে পেলে অনেকেরই খুব আফসোস হয়। মুল্যাঁ রুজ নিয়ে ছবিও হয়েছে। একবার ১৯৫২-তে। পরে ২০০১-এ আর একবার। সেটা ছিল নিকোল কিডম্যান অভিনীত এক হলিউডি মিউজিক্যাল।
শুধু কি প্যারিসের লোত্রেককে মনে পড়লে হয়? লোত্রেককে মনে পড়া মানেই ইতালির মিলান শহরের ভেনিচে রেস্তেরাঁর পাশের গলিতে যে কবি কবিতা লেখে বিক্রি করতেন সেই মহান সংগ্রামী লিওপার্দিকে ভুলে যাব? সেই করুণ জীবন। ইতালির লিওপার্দি (১৭৯৮-১৮৩৭) যিনি ছিলেন রোমান্টিকতাবাদী কবি। তাঁর কবিতাগুলো অনুবাদ করেই প্রকাশ করা হয় ‘কমপ্লিট পোয়েমস বাই গিয়াকোমো লিওপার্দি’।
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে যৌনতা
লিওপার্দির বেশিরভাগ কবিতায় গভীর জীবনবোধ প্রকাশিত হয়েছে। জীবনের দুঃখ ও ভোগান্তিকে তিনি ক্ষণস্থায়ী বলেছেন। তিনি বলেছেন, মৃত্যুই মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও সুখ এনে দিতে পারে। শুধু জীবনবোধ নয়, প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন মুগ্ধ কবি লিওপার্দি। এই লিওপার্দি মিলান শহরের একটি গলিতে কবিতা লিখতেন এবং বিক্রি করতেন। শাদা কাগজে লিখে বিক্রি করতেন। তখনও তার বই বের হয়নি। পরে প্রথম বই ‘দ্য বুক অব ডার্কনেস’ও রাস্তাতেই ফেরি করে বিক্রি করেছেন। সাহিত্যমহলে তিনি তখনও অস্পৃশ্য। পুরো নাম গিয়াকোমো তালদেগার্দো ফ্রান্সেসকো দি সেলস সাভেরিও পিয়েত্রো লিওপার্দি। ইতালীয় এই কবির জন্ম ১৭৯৮ সালের ২৯ জুন। ইতালির মাখশে অঞ্চলের রেকানাতির এক অভিজাত পরিবারের জন্ম লিওপার্দির। তাঁর বাবা ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমী। সুখী পরিবারে বেড়ে ওঠা লিওপার্দির শৈশব ছিল আনন্দময়। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন বিষয় পড়তে শুরু করেন। এটাই তাঁর কবি হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী লিওপার্দির লেখাপড়া শুরু হয় যাজকদের কাছে। তবে তাঁর বেশিরভাগ সময়ই কাটত বাবার পাঠাগারে। সেখান থেকেই তিনি বিভিন্ন বিষয়ে জানতে শুরু করেন। এটাই তাঁর মনের বন্ধ দুয়ার খুলে দেয়। বাবার তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্রুপদি সংস্কৃতি ও দর্শনে ভালো দখল চলে আসে লিওপার্দির। কিন্তু সময়ের চাইতে এগিয়ে তাকা লিওপার্দি সেই নিঃসঙ্গ শেরপা যিনি হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করেন জগতের সবচেয়ে একা ও সঙ্গীহীন মানুষ হিসেবে। শুরু হয় মাদক সেবন। শৈশবের শহর ছেড়ে চলে আসেন মিলানে। তখন তার বয়স কতই বা হবে, মাত্র তেইশ।
১২ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত প্রচুর লেখাপড়া করেন লিওপার্দি। লাতিন, গ্রিক ও হিব্রু ভাষায় অনর্গল বলতে ও লিখতে পারতেন তিনি। ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে তাঁর জানার পরিধি বিশাল ও বিস্তৃত। এসবই পরে তাঁর লেখালেখিকে প্রভাবিত করেছে। ও আচ্ছা মিলানের সেই ভেনিচে রেস্তেরাঁয় অভিজাতরা আড্ডা দিতে যেতেন। সেসময় নেশাতুর ঢুলুঢুলু চোখে লিওপার্দি প্রায় ভিক্ষুকের মতোন বলতেন, ‘একটা নতুন কবিতা, প্লিজ কিনে নেন। আমাকেও আনন্দের ভাগীদার করুন।’ আজ তিনি বিশ্বসেরা। সেই তিনি ১৮৩৭ সালের ১৪ জুন মারা যান।
এমিলি ব্রন্টির মুখ ভাসছে। একটু পরাবাস্তবভাবে। কালো শ্লেট। এর দিকে আমি তাকিয়ে আছি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আকাশ যেমন টুকরো টুকরো মতোন ভেঙে পড়ে, ঠিক সেরকম কালো শ্লেটের ভেতরে একটি গোল্ডেনহোল বড়ো হয়ে উঠছে। একটি মেয়ে গম ক্ষেত দিয়ে দৌড়াচ্ছে। কিশোরী। এরপর লন্ডনের রাস্তা। এক তরুণী তার বই বিক্রি করার জন্য ট্র্যাফিক মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গাড়িগুলো উল্কাগতিতে এসে থামলেই যেন সেই তরুণীর কাজ একটা বই এগিয়ে দিয়ে বলা ‘এটি আমার লেখা নভেল। নেবেন?’ এই বলার মধ্যে একটু জড়তা। কিন্তু কী করবেন। তিনি বই বের করেছেন। এই বই বিক্রি করেই তো চলতে হবে যে। আমাদের রমা চৌধুরীর মতো।
এমিলি ব্রন্টি একজন ইংরেজ ঔপন্যাসিক ও কবি। তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘উদারিং হাইটস’। এই বই বিক্রির ফলেই তিনি হয়ে ওঠেন সর্বাধিক পরিচিত। এই বইটিকে এখন ইংরেজি সাহিত্যে একটি ধ্রুপদি রচনা মনে করা হয়। ১৮১৮ সালের ৩০ জুলাই উত্তর ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট রাইডিং অব ইয়র্কশায়ারের থর্নটন গ্রামে এমিলি ব্রন্টির জন্ম। তার মায়ের নাম মারিয়া ব্র্যানওয়েল ও বাবার নাম প্যাট্রিক ব্রন্টি। বাবা ছিলেন আইরিশ। ১৮২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তার মায়ের মৃত্যু ঘটে। এমিলির বয়স সেই সময় ছিল তিন। তার তিন দিদি মারিয়া, এলিজাবেথ ও শার্লট কওন ব্রিজের ক্লার্জি ডটার্স স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তাদের নিগ্রহ ও দারিদ্র্যের সম্মুখীন হতে হয়। এই অভিজ্ঞতার উল্লেখ পাওয়া যায় শার্লটের জেন আয়ার উপন্যাসে। ছয় বছর বয়সে কিছু দিনের জন্য এমিলি তার দিদিদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৮২৫ সালের জুন মাসে তিনি শার্লট ও এলিজাবেথের সঙ্গে এমিলিও স্কুল ছাড়েন। প্রথাগত শিক্ষা না পেলেও এমিলি ও তার ভাইবোনরা অনেক বইপত্র পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের প্রিয় ছিল ওয়াল্টার স্কট, লর্ড বায়রন ও শেলির রচনা এবং ব্ল্যাকউড’স ম্যাগাজিন। ১৮৪৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। সেই এমিলি ব্রন্টি কি বলতেন জানেন, এটিকে তার বিখ্যাত উক্তি হিসেবেও অনেকে মুখস্থ করেছেন। সেই উক্তিটি ছিল, ‘মানুষ ভীষণ অদরকারি কথা বলে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটায়!’
এমিলি ব্রন্টিকে না ভালোবেসে পারি? যে প্রতিসকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবত আজই তার জীবনে শেষ দিন। আর দিনের শুরুটা করত আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সম্বোধন করেই ‘হ্যালো এমিলি, লাইফ ইজ বিউটিফুল।’