রহিমা আখতার কল্পনার একগুচ্ছ কবিতা

, শিল্প-সাহিত্য

রহিমা আখতার কল্পনা | 2023-08-31 06:53:21

মগ্ন জলের মন্দিরা

ভরা বরষায় তাপিত শরীর ভেজে মন্থর বৃষ্টিতে
উতল জোয়ারে মন মজে আছে ওই দুরন্ত ইষ্টিতে।

বরষা-কূহকে বাজে রিমিঝিম মগ্ন জলের মন্দিরা
অভিমান ভুলে চুপে কথা বলে মৃদু সুমন্ত সন্ধিরা।

কেঁদে ফিরে যায় তরুণ তাপস, তবু আনন্দী ঘুমন্ত
দেখেও দ্যাখে না ভেসে গেছে পাড়, মন-সীমান্ত ডুবন্ত।

ভাঁটফুল ফোটে, বৃষ্টির সূঁচ বিঁধে যেন তার অন্তরে
কাঁপছে পাপড়ি পেলব শীতল, মৃদু হাসে কোন মন্তরে !

থিরথির কাঁপে আকন্দ ঝাড় গহীন গোপন আনন্দে
বরষা-বিভোর মাঝ দুপুরেও তমসা নামছে সানন্দে।

বীজের গভীরে ঘুমভাঙা চোখে পৃথিবীর ছায়া স্পন্দিত
শেকড়ে আশার ওম লেগে আছে, আগামীর পথ নন্দিত।

জলের আদরে দলিত ফুলেরা—ম’রে বাঁচি তবু শ্রাবন্তী
উদাসী শ্রমণ, তারো ভেজে মন—বুঝে গেছে গৃহী সীমন্তী।

এসো ধারাজল, জ্বলছে অনল ধ্যানীর বুকের অন্দরে
ধূমল ঝড়েই ঢালো সোমরস ধূধূ রোদজ্বলা বন্দরে।

বালিকা ও ছায়াবাজি

আজকাল এক নতুন কলের ছোঁয়াছুঁয়ি জগত হয়েছে—
সখার দুনিয়া
পর্দায় পর্দায় আর ছবিতে ছবিতে লেখায় কথায়
খুব বেশি ভালোবাসাবাসি
পলকে সুহৃদ জোটে, পলকে টোকায় ভাঙে ‘বড়’র পীরিতি
সেই ছায়াবাজির জগতে শোলের পোনার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে পরজীবী
ঝাঁকে ঝাঁকে অশরীর শুঁয়োপোকা নিত্য কর্মরত,
কোনো কোনো মোহাবিষ্ট শ্যাওলা-সবুজ মৎস্যকুমারী
পাকে চক্রে সে জগতে এসে মায়া খোঁজে।
কুহক ছড়ানো অন্তর্জালে ছায়ার বাণিজ্য চলে দিনমান
অজস্র মিথ্যার কারুকাজ, অজস্র সত্যের দেহে কাফনের আবরণ
এবং বিকৃতি
এবং বিকৃতি
এবং বিকৃতি সীমাহীন, পরিমাপহীন।
শান্তরক্ত মৎস্যনারী হে, চিল শকুনের লোহু চিরকাল তপ্ত হয়,
তোমাকে পুরোটা ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবার পরেও তাদের আবিল শিরা
তৃষ্ণার্তই থেকে যাবে।
জলের জগতে ফিরে যাও, মায়ার জগতে—রূপকুঁড়ি
শ্যাওলা-শীতলে ঠাঁই নাও, বাৎসল্যের বন্ধনে, জলপরী !
জলের ওপরে রোদ, জলের কিনারে স্থলভাগ, মুক্ত অরণ্যানী
রোদ আর স্থলের মধ্যমবিন্দু জুড়ে আছে অনিবার্য ছায়া
ছায়াতে বিভ্রম, ছায়াতেও নষ্ট মানুষের ষড়জাল।
তুমি স্বচ্ছ জলের কুমারী
সভ্যতার নাম ধরে গড়ে ওঠা পঙ্কিল অরণ্যে পা রেখো না তুমি।
ধারাজল, ধারার পবিত্রতা আজন্ম তোমাকে লালন করে
তোমাকে সতেজ করে
তুমি হয়ে ওঠো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলোকবর্তিনী,
ছায়া বাজিকর আততায়ীদের ভিড়ে নাগরিক জঙ্গলের এই
নামহীন অচেনা আঁধারে ফাঁদবন্দী হয়ে যেতে কখনো এসো না।

বীরাঙ্গনা ও বিবাদী ময়ূরগণ

তাদের কলাপগুলো রঙদার খুব, রঙধনু খেলে পাখনায়
হৃদয় তাদের দারুণ হিসেবি
অসতর্কে ঠকে যেতে কখনো ছিল না তারা সামান্য সম্মত
তাই সাফ-কবালায় ভয় ছিল সেই প্রেমিক ময়ূরদের
তাই সে কখনো কারো মহিমা-শোভিত দলিলবদ্ধ জীবনসঙ্গী
হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি
সে এক সাহসী বীরাঙ্গনা, যোদ্ধা নারী আগুনের ফণা
পরিণামে ‘ওকে আর করল না কেউ বিয়ে ...’
তারও দীর্ঘ যুদ্ধ ছিল, যুদ্ধে কাটে এ জীবন, সাধভরা একটি জীবন।

তার ছিল সুরভিত কস্তুরি গোপন
আজও ত্রাসে কাঁপে সুরভিত কস্তুরি গোপন তার
তার ছিল পথভরা কণ্টক সুচালো
আজও তার হাঁটাপথে পথভরা কণ্টক সূচালো জাগে,
দিবারাত্রি ছিল তার গোলাপের শঙ্কিত রোদন—
আজও তার গোলাপের শঙ্কাময় ধ্বনিত রোদনে
রোদভাসা শীতের সকালে মন্দ্রিত ভৈঁরোর সুর ম্লান হয়ে যায়
ব্র‏হ্মাণ্ডের অকূল সায়রে ক্ষুদ্র বিন্দু হয়ে ভাসে তার সঙ্গহীন ভেলা।
সে কেবল দিন গোনে
তার মতো অজস্র শেকলবিহীন বন্দী পরিত্রাণের দিন গোনে,
বিপরীতে
উল্লসিত রঙ চকমকি অশুভ পুতুল নাচে মত্ত ব্যাঘ্রনাচ
জীবনমঞ্চের মেঝে চৌচির করার পালা শেষ করে
মেদিনীর সর্বসহা বুকটাও চিরে দিতে চায় বুঝি শস্ত্রের উচ্ছ্বাসে।

অথচ কী নিদারুণ হায়—সময় ফুরায় সন্তর্পণে
জ্যোতির কুপিটি সকলের অগোচরে নিভে আসে অমরায়
মানুষের মন তবু অন্তিম মুহূর্তটুকুতেও বুঝি শান দেয়
সযত্নে লুকিয়ে রাখা সূচাগ্র সরস শরগুলো, কাঁটাগুলো।

আমরা কি তবে দরোজা জানালাহীন অন্ধকার মৃৎঘরে
অথবা লাকড়িমে দাহ্য তরলের গন্ধে মূহ্যমান অমোঘ চিতায়
অথবা শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া কফিনের ভেতরেও
প্রতিপক্ষ দেখি !
শ্বাসবায়ু যতক্ষণ, ততক্ষণ আশ রাখি পরস্পর যুদ্ধ-প্রস্তুতির!

কর্দমাক্ত জলকণা

নদী-শিকস্তির কালে আকস্মিক জেগে ওঠা
চকচকে রুপালি ইল্শে-বুক চরের মতন
আমার নিজের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে অচেনা ভিন্নতা।

নিজের ভেতর জেগে ওঠা ভিন্নতার কাছে ক্ষিপ্র সমর্পণে
ক্রমাগত মরে যাচ্ছি খুব চেনা আমি
কখনো কখনো মৃত্যুও নন্দিত হয়, কে না জানে!
সন্তর্পণে তাই সরে যাচ্ছি জীবনের পুরনো বাথান থেকে
বাথান, কেন না—আমি ঠিক শূয়োরের মতো
শূয়োরের বাথানেই শিঙ্ ঠেলাঠেলি করে এতকাল
অযথাই কর্মমগ্ন, অযথাই বহুদিন অপচিত বন্দি সূর্যরেখা,
বহুদিন নিজের শুভ্রতা থেকে
নিষ্কলুষ আত্মার সবুজ মধু থেকে দূরে আছি,
সরে আছি ভীষণ উপায়হীন।

আজ আর ‘আমাকে বাঁচাও’ বলে কাঁদব না কোনো
মানুষ-আদল কদাকার কাষ্ঠখণ্ড নাছোড় আঁকড়ে ধরে।
সরে যাব।
হাঁসের স্বভাবে আমি মায়াশূন্য ঝেড়ে ফেলে দেবো
পাখনায় লেগে থাকা পরিত্যাজ্য কর্দমাক্ত জলকণা।
ভালোবাসা বলে কিছু নেই
মুদ্রা উল্টে দেখো পুষ্পশরের বিম্বিত বিপরীত মুখ—
পর্দা উন্মোচিত হলে শাশ্বত ঘৃণাই সর্বশেষ সত্য।

বনের পালোই

চিনো গো কুডুম হুনো—কারে ডাহে উজানী বাতাস
কার কান্দনের সুরে বাঁশবনে বাজে হা-হুতাশ
ম্যাঘের লাহান কার কালাচুল আসমানো উড়ে
পালছিঁড়া নাও কার বেদিশায় ঘাডে ঘাডে ঘুরে।

দুঃখের চপট্ খায়া কেডা করে এমুন মাতম
তোমার বিছন তারে ক্যান দিলা কও গো আদম!
যদি তারে শেষকালে না-ই দিবা পরিচয় চিন্
কী আশায় ভুলাইলা অবলারে, দ্যাহায়া সুদিন।

ক্যান তুমি ভাবো নাই, চিরকাল থাহে না সরল
জীবনের ভরাগাঙ, পেডো ধরে বেবাক গরল—
মাইল্লা গরল তুমি দিলা খালি তার কপালোই
গর্ভের যন্ত্রণা লৈয়া ঠাঁই নাই—বনের পালোই।

হগল আপনজনে বৈরি বুঝে, হগলে বে-দীল
চিনা কুডুমের মুখ দূরে থাহে—থাফা মারে চিল
তবু তো রাজার ধন বুহো লইয়া বুক চিন চিন
কও, ফাঁড়াকাল শেষে কবে তার ফিরাইবা দিন।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর